আগামী জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীনরা যেন ততই চাপ অনুভব করছে। নেতা ও মন্ত্রীদের কথাবার্তা খেয়াল করলে তা বোঝা যায়। এই চাপ মূলত আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা নিয়ে। ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জানে, নির্বাচন দুটি ছিল অত্যন্ত ত্রæটিপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য। এ বিবেচনায়, আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে, দেশ-বিদেশ থেকে এমন একটা চাপ ক্ষমতাসীন দলের ওপর প্রবল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে কূটনৈতিক ভাষায় বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য সরকারকে তাকিদ দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল দেশের জনমতকে খুব একটা আমলে না নিলেও, বিদেশিদের বক্তব্য-বিবৃতি ও মনোভাব উপেক্ষা করতে পারছে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মূলত এ কারণে, দলটির মন্ত্রী ও নেতাদের অন্তরে যাই থাকুক, মুখে বলছেন, আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। তবে তারা এ কথা সবসময় বললেও এবারের বলাটা যে চাপের মুখে বলা এবং পশ্চিমাদের শোনানোর জন্য, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যদিও তারা বলছে, তাদের অধীনে নির্বাচন হবে। বিগত দুটি নির্বাচনও তাদের অধীনেই হয়েছে এবং তা কেমন হয়েছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। এবারও যে ওরকম হবে না, তার গ্যারান্টি কি? তার নজির হচ্ছে, সংসদ থেকে বিএনপি’র পদত্যাগ করা ৬টি আসনের উপনির্বাচন। ক্ষমতাসীন দলের নিজের ও জোটের প্রার্থীদের মধ্যে করা এ নির্বাচনেও জোরজবরদস্তির অভিযোগ উঠেছে এবং ভোট পড়ার হার গড়ে ১৬ শতাংশের কিছু বেশি। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে, তার কোনো আলামত নির্বাচনেও দেখা যায়নি। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে ক্ষমতায় থেকে নিজের জয় নিশ্চিত করা ছাড়া পরাজয়ের কোনো নজির নেই। পরাজিত হয়ে বিজয়ী দলকে অভিনন্দিত করে ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার বিরল ঘটনা দেখার সৌভাগ্য দেশের মানুষের হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের কথা বলে বা আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলবৎ আছে, ক্ষমতায় থেকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পরাজয় বরণ কিংবা ক্ষমতায় থাকার মতো গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত আজও পূরণ করতে পারেনি। দেশ গণতান্ত্রিক, এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ‘হাইব্রিড রেজিম’-এ রয়েছে। এ তালিকায় বহু বছর ধরেই আছে। এ থেকে বের হতে পারেনি। বলা বাহুল্য, গণতন্ত্রের অন্যতম সৌন্দর্য ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া, যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। সেখানে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে পরায়জয় স্বীকার করে চলে যাওয়া বা বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় থাকার ঘটনা নিয়মিত। এমন ঘটনাও অহরহ ঘটে, ক্ষমতাসীন দল তার ব্যর্থতার কথা উপলব্ধি করে মেয়াদের আগেই নিজ থেকে ক্ষমতা থেকে সরে যায় এবং নতুন নির্বাচন দেয়। আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দল এটা স্বপ্নেও ভাবে না। ফলে আমরা নামে গণতান্ত্রিক দেশ হয়ে আছি, আচরণে গণতান্ত্রিক হতে পারিনি।
দুই.
সাধারণত আমাদের দেশে নির্বাচনের বছরটি রাজনৈতিক অঙ্গণে উত্তাপ ছড়ায়। বিরোধীদল ক্ষমতাসীন দলকে হটানোর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে। এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে যে, সরকারের জনপ্রিয়তা বলতে কিছু নেই এবং আগামী নির্বাচনে তাদের বিজয় অবশম্ভাবী। এ ধরনের আন্দোলন করে নিজের শক্তির জানান দিতে। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদলের আন্দোলন দমন করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রসহ নিজের শক্তি ব্যবহার করে জানান দিতে চায় তারা শক্তিশালী। এটা নির্বাচনের আগে এ ধরনের মনস্তাত্তি¡ক লড়াই। এ লড়াই ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে, যখন তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। সে সময় পর্যন্ত দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল বরাবরই ব্যাকফুটে ছিল। শাসন ব্যবস্থার ত্রæটির কারণে জনমত তার বিপক্ষে চলে গেছে। বিরোধী দলের আন্দোলনের বাইরেও জনমনে এমন একটা ধারণা জন্মাতো, এবার ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হতে পারবে না। পরাজিত হলেও সম্মানজনক আসন নিয়ে সংসদে বিরোধীদলে বসবে। এ ধারাটা বিগত একদশকে পরিবর্তন হয়ে গেছে যখন ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন হওয়া শুরু হয়। এ সময়ে জনগণের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন মানেই তার জয়জয়কার এবং বিরোধীদল তলানিতে পড়ে থাকা। কেয়ামত পর্যন্ত বিরোধীদলের ক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভাবনা নাই। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতা থেকে সরানোর কোনো পথ নেই। এমন এক পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তা নাহলে, সমস্যা দেখা দেবে। এটা আরও প্রায় এক বছর পরের কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলই যদি নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকে, তাহলে কিভাবে সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে? নির্বাচনের সময় সরকার রুটিন ওয়ার্ক করবে বললেও বাস্তবতা হচ্ছে, প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয়করণের ফলে তার নিয়ন্ত্রণেই থাকবে কিংবা স্বংক্রিয়ভাবেই তার পক্ষে কাজ করবে। বিগত দুটি নির্বাচনে তাই দেখা গেছে। আর সরকারের আচরণে এমন পরিবর্তন হয়নি যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত করবে এবং হেরে গেলেও সে ক্ষমতা থেকে চলে যাবে। এখন পর্যন্ত সরকারের যে মনোভাব ও অবস্থান, তাতে তার সাজানো-গোছানো প্রশাসনের অধীনে ছাড়া কোনোভাবেই নির্বাচন হতে দেবে না। অন্যদিকে, বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো তত্ত¡াবধায়ক সরকারের ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে অনড় অবস্থানে রয়েছে। তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার জোরালোভাবে বলেছে, বিরোধীদল আন্দোলন করে সরকারকে কিছুই করতে পারবে না। অর্থাৎ হটাতে পারবে না। প্রথমত সে নিজেই নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকবে। দ্বিতীয়ত আগামী কয়েক মাস আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিরোধীদলের জন্য অনুকূল নয়। সামনে রোজা, কোরবানি ঈদ ও বর্ষা। সব মিলিয়ে চার-পাঁচ মাস চলে যাবে। এতে বিরোধীদলের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বড় ধরনের ছেদ পড়বে এবং নির্বাচন কাছাকাছি চলে আসবে। ধারাবাহিকতায় বিঘœ ঘটায় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে আন্দোলন করে সরকারকে চাপে ফেলা বা দাবি আদায় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন বলেছে নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা করা হবে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। ফলে বিরোধীদলের আন্দোলন করার সময় খুবই কম। এ কারণেই সরকার বলছে, বিরোধীদল আন্দোলন করে সরকারের কিছুই করতে পারবে না। এ সময় সরকারও সময় পাবে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার। আগামী নির্বাচন কিভাবে করা হবে, তার কৌশলও করে ফেলবে। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে এক সময় নির্বাচনের আগের তিন মাস বিরোধীদলগুলো আন্দোলন করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং তাদের দাবি মানতে বাধ্য করার এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল। এ সংস্কৃতি এখন বদলে গেছে। বিরোধীদলগুলো বিগত দুটি নির্বাচনে এ ধরনের আন্দোলন করে ব্যর্থ হয়েছে। বলা যায়, ক্ষমতাসীন দল কঠোর অবস্থান নিয়ে তাদের আন্দোলনকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরার জন্য যা যা করার দরকার তাই করেছে। কেউ কেউ সরকারের এ আচরণকে নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করে সফল হওয়ার নীতি বলে অভিহিত করেছে। বিরোধীদলগুলোকেও এ নীতির কাছে হেরে এবং জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের বদনাম নিয়ে রণেভঙ্গ দিতে হয়েছে। সরকারের আচরণ যদি এমন হয়, তাহলে বিরোধীদলের পক্ষে আন্দোলন করে ক্ষমতাচ্যুত করা অত্যন্ত কঠিন। এ প্রেক্ষিতে, আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার বিরোধীদলগুলোর দাবী আদায় করা কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কি হবে, তা একপ্রকার ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়ে গেছে।
তিন.
ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিধারা যাই হোক না কেন অস্বীকার করার উপায় নেই, বিএনপির আন্দোলনে এক ধরনের নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে। দলটির মধ্যে সহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে গত বছর ক্ষমতাসীন দলের নানা বাধা-বিপত্তি ও উস্কানি সত্তে¡ও দশটি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ যেভাবে করেছে, তাতে দলটি চরম সহিষ্ণুতা দেখিয়েছে। এমনকি দলের ১৫ জনের মতো নেতাকর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পরও দলটি উত্তেজিত না হয়ে ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিয়েছে। এতে কাজও হয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশগুলোতে যোগ দিয়েছে। সেসব সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করতে পেরেছে। এরপর যে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ ও কর্মসূচি পালন করেছে, তাতে দলটি কোনো ধরনের অসহিষ্ণু আচরণ করেনি। বরং আন্দোলন কর্মসূচিতে ভিন্নতা এনেছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে মানববন্ধন করার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে। সর্বশেষ যে কর্মসূচি যুক্ত করেছে, তা আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে আমাদের দেশে নতুন। কর্মসূচিটি হচ্ছে পদযাত্রা। রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চারদিন ব্যাপী এই পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছে। আমরা লংমার্চ দেখেছি, তবে এ ধরনের পদযাত্রার কর্মসূচি দেখিনি। বিএনপি আন্দোলনে এ ধরনের কর্মসূচি যুক্ত করে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে। ১১ ফেব্রæয়ারি এই পদযাত্রা করেছে দেশের সব ইউনিয়নে। বলা হয়ে থাকে, মৌনতা অনেক কথার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। চুপ করে থাকলে প্রতিপক্ষের মধ্যে মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়। ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। কিছু বলতেও পারে না, সইতেও পারে না। বিএনপির এই পদযাত্রা যে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে একধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে, তা তার নেতাদের বক্তব্যে বোঝা যায়। ফলে বিএনপির পদযাত্রাকে কটাক্ষ করে মরণযাত্রা, শোকযাত্রা ইত্যাদি ভাষায় ব্যাঙ্গ করে মনের ঝাল মিটাতে চাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, পদযাত্রায় শুধু দলটির নেতাকর্মীই নয়, অনেক সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি সড়কের পাশ দিয়ে যে মানুষটি হেঁটে যাচ্ছিল, সেও পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করে তা এগিয়ে দিয়েছে। ভারতে কয়েক মাস আগে কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো’ পদযাত্রা হয়েছে। ভারতের দক্ষিণে কন্যাকুমারী থেকে উত্তরে শ্রীনগর পর্যন্ত প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ দলটির নেতা রাহুল গান্ধী নেতাকর্মীদের নিয়ে হেঁটেছেন। এতে সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করেছে। তাদের সাথে মতবিনিময় করেছেন। সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছেন। অহিংস এবং নীরব এ পদযাত্রা মোদী সরকারকেও ভাবিয়ে তুলেছে। নানা জায়গায় বাধা দিয়েও সফল হয়নি। এ ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিতে গেলে উল্টো সরকার বেকায়দায় পড়ে। জনমত তার বিপক্ষে চলে যায়। উভয় সংকটে পড়ে। বিরোধীদলের দাবি জোরালো হয়, সরকারের বিপক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়। বিএনপি’র পদযাত্রার ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমন দেখা গেছে। দলটির আন্দোলনের নতুন এই ধারার মাধ্যমে একদিকে নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও অংশগ্রহণ জোরালো করতে পারছে, অন্যদিকে জনমত সৃষ্টির সহায়ক হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে সরকারের ওপর মনস্ত¡াত্তিক চাপও সৃষ্টি হয়েছে। এই চাপ সামলানোর জন্য সরকারও বিএনপি’র কর্মসূচির সমান্তরালে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি পালন করে সমালোচনা ও ব্যাঙ্গ-বিদ্রæপ করছে। বিএনপি’র অতীত ইতিহাস তুলে ধরে তিরস্কার করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কোনটিকে বিবেচনায় নেবে? অতীতকে নাকি বর্তমানকে? আমাদের দেশের মানুষ অতীতের চেয়ে বর্তমানকেই বেশি প্রাধান্য দেয় এবং তাদের মধ্যে অ্যান্টি গভর্নমেন্ট সেন্টিমেন্ট বেশি কাজ করে। তাদের মধ্যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর সরকার পরিবর্তনের প্রবণতা প্রবল। এ ধারার ব্যত্যয় ঘটেছে বিগত দুটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে। এ সময়ে সরকার বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের স্মারক তুলে ধরেছে বটে, তবে তার চেয়ে বেশি সুশাসন ও আইনের শাসনের অভাব, দুর্নীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করা, বিরোধীদলকে দমন এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দোর্দÐ প্রতাপের চিত্র বেশি ফুটে উঠেছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতাই আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য সরকারের ওপর প্রবল চাপ হয়ে এসেছে।
চার.
বিএনপি’র শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে জনমত সৃষ্টি হচ্ছে কিংবা সরকার পরিবর্তনের মনোভাব মানুষের মধ্যে আগে সৃষ্টি হলেও প্রশ্ন হচ্ছে, দলটি তা কতটা কাজে লাগাতে পারবে? দলটির গণসমাবেশ থেকে শুরু করে মিছিল ও অন্যান্য কর্মসূচিতে নেতাকর্মী, সমর্থকসহ ব্যাপক মানুষ উপস্থিত হচ্ছে। দলটির শীর্ষ দুই নেতার অনুপস্থিত থাকা সত্তে¡ও অন্যান্য নেতার কথা শুনতে আসছে। এই যে নানা বাধা-বিঘœ, হামলা-মামলা, গ্রেফতারের মধ্যেও কষ্ট করে নেতাকর্মীরা দলটির কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছে, তারা কি আশা নিয়ে যাচ্ছে? গত বছরের বিভাগীয় গণসমাবেশে যে ত্যাগ তারা স্বীকার করে অংশগ্রহণ করেছে এবং সরকারকে ১০ ডিসেম্বরের ডেডলাইন দেয়াÑএসবের ফলাফল কি? তারপরও দলটির নেতাকর্মীরা ধৈর্য্য ধরে আশায় আশায় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ১০ ডিসেম্বরের ডেডলাইন দেয়া এবং তা বাস্তবে রূপ দিতে না পারার মতো সিদ্ধান্ত ছিল অবিমৃষ্যকারি। এতে কিছুটা হলেও দলটির আন্দোলনের গতিতে ভাটা পড়েছে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলকেও ব্যাঙ্গ-বিদ্রæপ করতে দেখা যায়। ডেডলাইন দেয়া এবং তা বাস্তবায়নের যে নেতৃত্ব, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত থাকা দরকার তা দলটির এ সময়ের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দেখাতে পারেনি। এতে দলটির দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে হোঁচট খাওয়া এবং আবার চলতে থাকা স্বাভাবিক। এই চলার ফলাফল যদি না আসে তাহলে তা দিকভ্রান্ত চলা হিসেবে গণ্য হয়। বিএনপি এখন পদযাত্রার মতো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি পালন করছে এবং তার নেতাকর্মী ও সমর্থক এমনকি সাধারণ মানুষও তাদের জীবনযাপনের কঠিন সময়ে আশা নিয়ে অংশগ্রহণ করছে ও করবে। এতে সরকারও চাপ অনুভব করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারবিরোধী প্রবল জনমত যেকোনো সরকারের জন্যই চাপের বিষয়। এ চাপ বেগবান ও কাজে লাগাতে হয় বিরোধীদলকে। বিএনপি চাপ সৃষ্টি এবং সৃষ্টি হওয়া জনঅসন্তোষ কি কাজে লাগাতে পারবে? সরকার চাপ অনুভব করে কি বিএনপির দাবি মেনে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবে? কিংবা বিএনপি কি তার দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে পারবে? নাকি সাধারণ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হতাশ করে আপসকামী নেতৃত্বের কারণে এ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাবে?
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন