বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

ঈদে মিলাদুন্নবি সা. : কয়েকটি প্রশ্ন ও তার খন্ডন

মুহাম্মদ বশির উল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট ও সর্বশেষ নবি হিসেবে আরবের প্রসিদ্ধ মক্কা নগরিতে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ গোত্রের হাসেমী বংশে ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার, রজনীর মহা-সন্ধিক্ষণে বরকতময় সুবহে সাদিকের শান্ত স্নিগ্ধ সময় ধরার বুকে আগমন করেছেন। তাঁর এই আগমনের সময়টিকে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) বলা হয়। আর ঈদ-ই-মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলতে প্রকৃতপক্ষে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানিকতাকে বুঝায়। প্রতি বছর ১২ই রবিউল আউয়াল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর জন্মোৎসব তথা ঈদ-ই-মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম পালিত হয়। এটি মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্টতম দিবস। এটি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, মহব্বত প্রকাশের অন্যতম প্রকৃষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে ইসলামে প্রায় সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলমান বিশেষ কিছু আমল করে থাকেন। যেমন, কুরআন তিলাওয়াত, হামদ ও নাত, তাসবিহ-তাহলিল, ওয়াজ-মাহফিল, মিলাদ-কিয়াম, দান-খায়রাত এবং তবারক বিতরণ আত্যাদি। কিন্তু বর্তমান যুগে সমাজকে বিভ্রান্তির ধূম্্রজালে পতিত করতে, ঈমান হারা করার ও মানুষের মন থেকে রাসূল প্রেম মুছে দিতে কয়েকটি ক্ষূদ্রতম দল মাথাচারা দিয়ে উঠছে। তারা ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম, কিয়াম, ফরজ নামাযের পর হাত তুলে দু’য়া করা সহ আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উম্মতে মুহাম্মদির মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করতেছে। তাদের এ অন্ধ চোখকে খুলেদিতে তাদেরই দেয়া কয়েকটি প্রশ্ন ও তার খন্ডন সম্মানিক পাঠকদের খেদমতে খুবই বিনয়ের সঙ্গে এখানে উল্লেখ করা হলো।
প্রথম প্রশ্ন : ইসলামি শরীয়তে দু’টি ঈদের কথা আছে। সেখানে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম নামে তৃতীয় ঈদটি কোথায় পেলেন?
উত্তর: তৃতীয় ঈদ, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম সহ আরো ১৩৭ টি ঈদ আমরা হাদিসে পেয়েছি। তাহলে এবার আসা যাক, বুখারী ১ম খন্ড ৩৫ পৃষ্ঠা হাদিস নং ৪৩, ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে ছাপা। হযরত ওমর রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। একদা একজন ইয়াহুদী ব্যক্তি তাকে সম্মোধন করে বললেন, হে আমিরুল মু’মিনীন! আপনার ধর্ম গ্রন্থ আল কুরআনে এমন একটি মর্যাদাবান আয়াত আছে যা আপনারা সচারাচর পড়ে থাকেন। সে আয়াতটি যদি আমাদের ধর্মগ্রন্থে নাযিল হতো তাহলে নাযিলের দিনটিকে ঈদের দিন বানিয়ে নিতাম। হযরত ওমর রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু তাকে বললেন, কোন সে আয়াত? সে বললো, আয়াতটি হলো “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম।” (সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত নং ৩)
এ আয়াতটি শোনার পর হযরত ওমর রাদি-আল্লাহু তাআলা আলাইহি বললেন, এ আয়াত যে দিন এবং যে স্থানে আবতীর্ণ হয়েছে তা আমরা ভালোভাবেই জানি। সে দিন তিনি আরাফাতে ছিলেন ও সে দিনটি ছিলো শুক্রবার।
উক্ত হাদিস শরিফের ব্যখ্যায় আল্লামা কিরমানী রহমাতুল্লাহ বলেন, হযরত ওমর রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু বলেছেন, আমরা ঐ দিনটিকে ঈদ হিসেবেই গ্রহণ করেছি এবং এ স্থান কেও সম্মানের পাত্র হিসেবে গ্রহণ করেছি। তিরমিযী শরিফের ২য় খন্ডের ১৩৪ পৃষ্ঠায় আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, হযরত ইবনে আব্বাস রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, আয়াত খানা যেদিন নাযিল হয়েছে সে দিন ছিল দুই ঈদের দিন। একটি হলো আরাফা অপরটি হলো জুম’আ। তিরমিযী শরিফের ১৬০ পৃষ্ঠার একটি হাদিস থেকে জানা যায়, ঈদুল আযহা তার পরবর্তী ১১,১২,১৩ জিলহজ্জ, আরাফার দিন, জুম’আর দিনও ঈদের দিন। তাহলে বছরে ৫২ সপ্তাহে ৫২টি শুক্রবার ৫২টি ঈদ।
উপরিউক্ত প্রমাণসমূহ দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট, নির্দিষ্ট কিছু আহকাম পালন করে দু’টি ঈদ আমাদের পালন করতে হয় যা সবার জানা। এ ছাড়া অনেক ঈদ আমাদের জীবনে রয়েছে।
বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত নাযিলের দিনটি যদি ঈদের দিন হয় তবে সাহেবে কুরআন, কুরআনের ধারক, যার উছিলায় কুরআন, যার উপরে নযিল হয়েছে ঐ আয়াতটি, কুরআন যার চরিত্র তার শুভাগমনের দিন কী ঈদের দিন হবে না? নিশ্চয় হবে।
২য় প্রশ্ন: প্রশ্ন করা হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম সোমবার দিন জন্মগ্রহন করেছেন এবং সোমবার দিনই ইন্তেকাল করেছেন। একই দিনে শোক ও খুশি মিশ্রিত রয়েছে। অথচ শোক পালন না করে খুশি পালন করা কিভাবে বৈধ হয়?
উত্তর : হযরত আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযির রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, জুম’আর দিন সকল দিনের সর্দার এবং সকল দিন অপেক্ষা আল্লাহর নিকট সম্মানীত দিন। তা ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিন থেকে অধিক সম্মানীত। তাতে পাঁচটি বিষয় আছে। (১) এ দিনেই আল্লাহ তা’আলা আদম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়া-সাল্লাম কে সৃষ্টি করেছেন। (২) এ দিনেই তাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। (৩) এ দিনেই তাকে মৃত্যু দান করেছেন। (৪) এ দিনে এমন একটি মূহুর্ত আছে, যদি কোনো বান্দা সে মূহুর্তে আল্লাহর নিকট কিছু প্রার্থণা করেন তিনি তাকে তা নিশ্চয় দান করেন। যে পর্যন্ত না সে হারাম কিছু প্রার্থণা করে। (৫) এ দিনেই কিয়ামত সংগঠিত হবে।
এমন কোনো সম্মানীত ফিরিশতা নেই, আসমান নেই, জমিন নেই, বাতাস নেই, পাহাড় নেই, সমুদ্র নেই যে, জুম’আর দিন সম্পর্কে ভীত নয়। অর্থাৎ কখন যে কিয়ামত হয়ে যায়। (মিশকাত : ১২০ পৃষ্ঠা, ইবনে মাজাহ : ১১৪ পৃষ্ঠা)
অত্র হাদিস থেকে প্রমাণিত হলো, জুম’আর দিনের মর্যাদা ঈদুল ফিতর, কুরবানি সহ সকল দিনের চেয়ে মর্যাদাবান। কুরআনে এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, হযরত আদম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়া-সাল্লাম এর জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে সংঘঠিত হওয়া সত্তে¡ও জুম’আর দিনকে আল্লাহ তা’আলা ঈদের দিন ঘোষণা করেছেন। তাহলে যার উছিলায় এ পৃথিবী, আদম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়া-সাল্লাম, রমজান, দু’ই ঈদ ইত্যাদি সেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম যে দিন জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং মৃত বরণ করেছেন সে দিনটি ও রাতটি জুম’আ, লাইলাতুর কদর, শবে বরাত, শবে মেরাজ, ঈদুল ফিতর ও আযহা এমন কি রমজান মাসের চেয়েও কি উত্তম নয়? অবশ্যই উত্তম। কারণ, এ গুলোর অস্তিত্ত¡ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর জন্যই। প্রমাণ হলো, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর জন্মদিন সোমবারের মর্যাদা অনেক অনেক বেশি এবং তা অবশ্যই ঈদের দিন হবে। (মাওয়াহেবুল্লাদ্দুন্নীয়া : ১ম খন্ড, ১৪৫ পৃষ্টা) ‘ফতওয়ায়ে শামী’তে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির মৃত্যুর শোক তিনদিন। তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর মৃত্যুর দিন হলেও শোক পালনের কোন কারণ অবশিষ্ট্য নেই।
অতএব, প্রমাণিত হল, জন্ম ও মৃত একই দিনে হলেও শরীয়াতের ফতওয়া মতে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর বিলাদাত শরীফ ও বেছাল শরীফের উভয়টি একত্রিত হলে তা আমাদের জন্য ঈদ বা খুশির দিন।
৩য় প্রশ্ন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর শুভাগমন দুনিয়াতে একবার ঘটেছে। অথচ প্রতি বছর তার মিলাদ বা জন্মদিন পালন করা হয় কেন?
উত্তর : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম হিজরত করে মদিনা আসলে ইয়াহুদিদেরকে দেখলেন, তাঁরা আশুরার দিনে রোজা রাখে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম তাদের কে প্রশ্ন করলেন, এই দিনে তোমাদের রোজা রাখার কারণ কি? তাঁরা বললো, এটা এমন একটি দিন এ দিনে আল্লাহ তা’আলা হযরত মুসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়া-সাল্লাম ও তার কাওমকে মুক্তি দিয়েছেন। ফেরাউন ও তার কাওমকে নীলনদে ডুবিয়ে মেরেছেন।
অতএব, হযরত মুসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়া-সাল্লাম এর শুকরিয়া স্বরুপ রোজা রেখেছিলেন তাই আমরাও রাখি। এ কথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বললেন, এ ব্যাপারে আমরাইতো অধিকতর হকদার। তখন থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম রোজা রাখলেন এবং আমাদেরকেও রোজা রাখতে নির্দেশ দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
(চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
khalid ahmed ৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ২:১২ এএম says : 0
আমরা যাদের মাধ্যমে দ্বীন পেলাম সেই সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী তবে তাবিয়ী বা চার ইমাম এগুলো পালন করেছেন এর কোন প্রমান থাকলে দয়া করে জানাবেন
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন