জ্ঞানে প্রবীণ এবং মৃত্যু ভয়ে ভীত বয়োবৃদ্ধদের হৃদয়ে ধর্মের আবেদন গভীরতর। এটা তিন হাজার বছর পূর্বে যেমন ছিল, আজও তেমনই আছে। নামাজের জামাাতের পর যে কোনো মসজিদের তোরণ দ্বারে দাঁড়িয়ে মুসল্লিদের দেখুন এ সত্য দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়ে উঠবে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ছিল দুনিয়ার ইতিহাসের একটি ক্ষেত্রে। তা হলো মুহাম্মদ (সা:) ইবনে আবদুল্লাহর প্রচারিত ধর্মের ইতিহাসে। আজকাল অবশ্য আমরা মহানবী (সা:) প্রচারিত ধর্মকে অনেক ক্ষেত্রে বিকৃত করে ফেলেছি, এটা এখন তরুন এবং নবীনদের নিকট আবেদন হারিয়ে আবার সেই সনাতন আদি ধর্মসমূহের রূপ পরিগ্রহ করেছে বলা যেতে পারে।
জ্ঞানচর্চার প্রতি উপেক্ষা : মহানবীর আদর্শ বিকৃত হলো কিভাবে এবং কেন? কারণ অনেক। তবে মৌলিক কারণ হলো কুরআন-সুন্নাহর প্রতি অনীহা এবং সামগ্রিক জীবন দর্শন হিসেবে মুসলমানগণ কর্তৃক ইসলামের প্রতি উদাসীনতা। মহানবী মুহাম্মদ (সা:) আমাদের নিকট দু’টি উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। এটা কে না জানে? উক্ত দু’টি মূল্যবান বস্তু হলো : কুরআন এবং সুন্নাহ। লক্ষ লক্ষ এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে দীন-ই-মুহাম্মদী কায়েমের জন্য মসজিদ নির্মিত হচ্ছে। পৃথিবীর দরিদ্রতম এই বাংলাদেশে দু’লক্ষ মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর এই সমস্ত ঘরে দুটো বস্তুর যথাযথভাবে চর্চা হচ্ছে বলে মনে হয় না। তা হলো আল্লাহর কুরআন এবং রাসূল (সা:)- এর হাদিসের অন্তর্নিহিত অর্থ জানার সাধনা।
আমাদের অমুসলমান পূর্বপুরুষদের বর্তমান বংশধরদের অনেকে মাটি দিয়ে মূর্তি বানিয়ে পূজা করে। আমরা কালেমা পাঠ করছি বলে মূর্তি বানিয়ে পূজা করতে পারি না। কিন্তু অনুমিত হয়, আমাদের অবচেতন মনে মাটির মায়া ঠিকই আছে। তাই আমরাও ইট-পাথর, সুড়কি-চুন দিয়ে মসজিদের দেয়াল মেহরাব বানিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করি, কিন্তু কুরআন-হাদিসের তরজমা তাফসীর কিনে ইসলামী সাহিত্য দিয়ে মসজিদকে সমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত করতে চাই না। আমাদের কাছে হাদিস-কুরআন পাঠ করে আল্লাহর দীনকে উপলব্ধি করা অপেক্ষা মোজাইক করা মেঝেতে সালাত আদায়ই যেন যথেষ্ট। অথচ আমাদের নবী শিক্ষা দিয়েছেন, ‘এক ঘণ্টা জ্ঞান চর্চা সত্তর বছরের ইবাদতের চেয়েও উৎকৃষ্টতর।’ জ্ঞানের সন্ধান, নারী-পুরুষ সকল মুসলমানের জন্য ফরজ। অথচ আমরা তা তরক করে নফল নামাজে সময় বেশি কাটাই। আল্লাহর নবীর শিক্ষার এমন অমার্জনীয় অবহেলা ও লংঘনের পর আমাদের ঔরসজাত সন্তানরাই যদি আমাদের অনুসৃত এবং অনেক ক্ষেত্রে কল্পিত ও পরিবর্তিত ইসলাম হতে বিমুখ হয়, তবে কি আমরা তাদের দোষ দিতে পারি।
প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর বিদ্যা অর্জন করতে হলেও সাতটি বই পড়তে হয়। ইসলামী শিক্ষার প্রথম দু’টি কিতাব হলো তরজমা-ই-কুরআন ও বুখারী শরীফ। কিন্তু খুব কম পরিবারেই এ দু’টি কিতাব তরজমাসহ পাওয়া যাবে। আমরা শুনে শুনে সুন্নি মুসলমান। আর যাদের কাছ থেকে শুনি, তাদের কাছেও কুরআন এবং বুখারী শরীফ বা ছয়টি সহীহ হাদীস শরীফের তরজমা থাকে না।
পূর্ণাঙ্গ আদর্শ রাসূলুল্লাহ (স:) : ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক জীবন-বিধান এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:) ছিলেন মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি বুদ্ধ, যীশুখ্রিষ্ট বা মহাবীরের মতো নিছক ধর্ম প্রচারক ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও দক্ষ প্রশাসক এবং ন্যায় বিচারক। মসজিদে ইমামতি, দোয়া-দরুদ ও ওয়াজ নসীহতের মধ্যে তাঁর কর্মসূচি সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর প্রথম খলীফা-চতুষ্টয়ের প্রধান পরিচিতি রাষ্ট্র পরিচালক হিসেবে। রাজনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন ছিল মহানবী (স:)-এর সুন্নত। এই সুন্নত পরিত্যাগ করে আমরা গ্রহণ করেছি মহানবী (স:)-এর জীবনের আংশিক এবং খন্ডিত রূপ। যুব-মন খন্ডিত আংশিক দর্শনে তৃপ্ত হয় না। তাই অতৃপ্ত মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সংস্কার ও পরিচালনার জন্য তারা ভিন্ন দর্শন, চিন্তাধারা এবং আদর্শের অনুসারী হবে, এটাই স্বাভাবিক। আংশিক আদর্শ নিয়ে পূর্ণ সমাজ সংগঠিত হতে পারে না।
নামাজ-রোজা বিয়ে-শাদীর জন্য সকল মুসলিমের আদর্শ মহানবী মুহাম্মদ (স:)। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বহু মুসলিমের আদর্শ প্লেটো, এরিস্টটল, ল্যাস্কি, লক, হিউম, জেফারসান, আব্রাহাম লিংকন। অর্থনীতির জন্য আমাদের অনেকের আদর্শ কার্ল মার্কস বা মাও সেতুং। মহানবী (স:)-এর ইসলাম যদি জীবনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার প্রকৃষ্টতম পন্থা হিসেবে শিক্ষিত যুবশ্রেণীর নিকট ইসলামী সাহিত্যের মাধ্যমে তুলে ধরা না হয়, তাহলে তারা ইসলাম হতে দূরে সরে যাবে, তা নিতান্তই স্বাভাবিক।
অশিক্ষিতদের নিকট আল্লাহর দ্বীন প্রচারের মাধ্যম হলো ওয়াজ-বক্তৃতা। কিন্তু এ যুগে শিক্ষিত সমাজের নিকট যে কোনো আদর্শ প্রচারের মাধ্যম হলো পুস্তক-পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশন। আমরা এসব মাধ্যমকে অবহেলা করে শিক্ষিত যুবশ্রেণীর নিকট ইসলামকে পৌঁছতে দিচ্ছি না।
মহানবী (স:)-এর আদর্শের যে আবেদন তাঁর সমকালীন তরুণ ও যুবকদের মাঝে ছিল, আজ তা কেন হ্রাস পেল? আমরা জানি, মহানবীর আদর্শ মানব-প্রকৃতির ওপরে স্থাপিত। এবং এ কারণে অপরিবর্তনীয় যুব মানসের ধর্ম বা প্রকৃতি চিরন্তন, চির সবুজ। কিন্তু তবু কোথায় যেন একটা গোল বেধেছে। অথচ বামপন্থীদের সভা-সমিতি, শোভাযাত্রা, মশাল মিছিলের দিকে তাকান, লক্ষ করবেন, এসবে বৃদ্ধ বা মধ্যবয়সী অপেক্ষা যুবক-তরুণদেরই ভিড় বেশি।
মহানবী (স:)-এর বয়োকনিষ্ঠ সাহাবায়ে-ই-কিরাম : ইসলামের ইতিহাসে যাঁরা অবদানের জন্য অমর হযে আছেন, তাঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন মহানবীর বয়োকনিষ্ঠ। বিবি খাদিজা (রা:) এবং বিবি সওদা ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ। সাহাবীদের মধ্যে প্রথমেই আমরা পাই হযরত আবু বকর (রা:)-কে। তিনি ছিলেন মহানবী (স:) থেকে তিন বছরের ছোট। উমর (রা:) ও উসমান (রা:) ছিলেন মহানবী (স:)-এর আরো ছোট, সাহাবীদের তালিকা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মক্কা বিজয়-পূর্বকালের সাহাবীদের শতকরা ৯৫ জনের বেশি ছিলেন তরুণ এবং যুবক অর্থাৎ মুহাম্মদ (স:)-এর আদর্শের আবেদন মক্কার মধ্যবয়স অতিক্রান্ত বা মৃত্যুভয়ে ভীত বয়োবৃদ্ধ অপেক্ষা তরুণ ও যুবকদের কাছেই ছিল গভীরতর। পরম পরিতাপের বিষয়, অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু কেন?
আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে মহানবী (স:)-কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তাঁর পিতৃব্য আবু তালিব। আট বছর বয়স হতে তাঁকে তিনি শুধুমাত্র লালন-পালনই করেননি, চরম বিপদের দিনে ঢাল হিসেবে সকল অত্যাচার নিজের পিঠে নিয়ে তাঁকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন। একমাত্র আবু তালিব ভিন্ন মক্কার অন্য কোনো অমুসলিমের নামে কোনো মুসলিম শিশুর নামকরণ হয় না। মহানবী (স:)-এর আদর্শের সত্যতায় আবু তালিবের ছিল দৃঢ় প্রত্যয়। কিন্তু সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি ইসলাম গ্রহণ করতে পারেননি। বরং আবু তালিবের পুত্র বালক আলী (রা:)-এর হৃদয় সত্যের প্রথম আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে ওঠে। পুত্র আলীর ইসলাম গ্রহণে আবু তালিব ক্ষুব্ধ হননি, বরং খুশিই হয়েছিলেন।
শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন কল্পনা : মুহাম্মদ (স:) প্রচারিত আদর্শের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য ছিল যা যুবকদের আকর্ষণ করত। যুবমন কল্পনাপ্রবণ, রোমান্টিক ও স্বপ্নাশ্রয়ী। তারা অভাবহীন সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে, শোষণমুক্ত সমাজের কল্পনা করে। তাদের সামনে থাকে একটি রঙিন পৃথিবীর স্বপ্ন, যেখানে থাকবে না কোনো অত্যাচার-অনাচার, থাকবে না কোনোরূপ শোষণ-জুলুম। যেখানে মানুষ হবে মানুষের ভাই। কেউ হবে না ভৃত্য, কেউ থাকবে না প্রভু। সকলেই নিজ নিজ কর্তব্য করবে। সাধ্যমতো পরিশ্রম করবে এবং জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন ও চাহিদা মেটানোার সুযোগ পাবে। মুহাম্মদ (স:) প্রথম জীবনে হিলফুল-ফুজুল নামক সংস্থার মাধ্যমে সংস্কারমূলক কিছু কিছু কাজ করেছেন। কিন্তু তাতে তাঁর বিক্ষুব্ধ আত্মা তৃপ্ত হতে পারেনি। তিনি কল্পনা করতেন শোষণহীন ইনসাফভিত্তিক মানব সমাজের। চল্লিশ বছর পর্যন্ত তিনি স্বপ্ন দেখেছেন জাহেলিয়াত ও কুসংস্কারমুক্ত নতুন পৃথিবীর।
আবদুল মুত্তালিব পরিবার, বনু হাশিম বংশ কোরেশ গোত্র এবং তৎকালীন আরব সমাজের নেতৃত্ব যুবক মুহাম্মদের (স:) কল্পনা এবং স্বপ্নের প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিল না। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, মক্কার সাহিত্যিক ও বিদগ্ধ মহলে তিনি তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও কল্পনার খোরাক পেতেন না। তিনি আরবের মরু প্রান্তরে একাই ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু দিনের পৃথিবী, রাতের আকাশ কিছুই তাঁর মনের ক্ষুধা মেটাতে পারত না। আশ্রয় নিতেন তিনি হেরা গুহার নির্জনতায়। তিনি ভাবতেন, কল্পনা করতেন, সত্য অনুসন্ধান করতেন। মানবতার অবমাননায় বিক্ষুব্ধ চিত্তে এবং সুন্দরতর পৃথিবীর কল্পনায় তিনি ধ্যানমগ্ম হয়ে থাকতেন। অবশেষে তিনি দিব্যজ্ঞানের মাধ্যমে পেলেন শাশ্বত সত্যের সন্ধান। বিনা ক্লেশে সত্য তাঁর হৃদয়ের পর্দায় আপনাআপনিই প্রতিফলিত হয়নি। এ জন্য তাঁকে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়েছিল। যুবক মুহাম্মদ (স:)-এর সত্যের আহ্বান তৎকালীন আরবের যুবকদের মধ্যেই দাগ কেটেছিল বেশি।
সংগ্রামী চেতনা : মানুষের ওপর মানুসের জুলুম-অত্যাচার, শোষণ ও বীভৎসতায় যুবক মুহাম্মদ (স:)-এর মন বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তদানীন্তন শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। শুধুমাত্র কন্যাশিশু নয়, আরব সমাজে জীবনের নিরাপত্তা ছিল না। পথে-ঘাটে রাহাজানি, লুটপাট, হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। আরব মরুভূমির দেশ। আয়ের জন্য অনেককে বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু এক সঙ্গে সশস্ত্র আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিয়েও বাণিজ্য কাফেলা শত্রুর আক্রমণ থেকে নিস্তার পেত না। এরূপ রাহাজানি, ডাকাতি চলতে থাকলে কেউ শান্তিতে বাস করতে পারে না। সারা জীবন যারা এ কাজ করে এসেছে বা যাদের সম্পদ মরুর বুকে লুণ্ঠিত হয়েছে তাদের কাছে এ তত্ত¡ শ্রুতিমধুর মনে হতো না। তবে রাহাজানি, হত্যা, লুট ইত্যাদিতে নবাগত এবং অনভ্যস্ত যুব সমাজের নিকট এই আবেদন ছিল গভীর। আরবদের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রচলিত অপরাধপ্রবণতা সমূলে উৎপাটিত হয়েছিল মহানবী (স:)-এর শিক্ষার গুণে।
সংগ্রাম যৌবনের ধর্ম। যুবমন সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। যুবসমাজ সংগ্রাম করতে চায়, সকল অন্যায় ও অধর্মের বিরুদ্ধে। অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে। তারা চির বিদ্রোহী। অন্যায়-অবিচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের মন বিক্ষুব্ধ। অন্যায়ের প্রতিবাদ, মজলুমের পক্ষে জিহাদ, নিপীড়িতের পক্ষে আত্মত্যাগ নবীনেরা যতটুকু করতে পারে, প্রবীণেরা ততটুকু পারে না। নির্যাতিত মজলুমের ব্যথায় তরুণেরা ব্যথিত হয় বেশি। নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করেও তারা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। যুবমন সংগ্রামী নেতৃত্বের পেছনে কাতারবন্দী হয় এবং নিজেরা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে চায়।
মহানবীর সমস্ত জীবনটাই ছিল একটি সংগ্রামী জীবন। তিনি তৎকালীন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে একক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সারা জীবন অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। সমগ্র আরবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর সারাটি জীবনই ছিল জিহাদী জিন্দেগী। ২৩ বছরের নবুওতী জিন্দেগীতে ১৩ বছর একাদিক্রমে তিনি আক্রমণ সহ্য করেছেন। প্রতি আক্রমণ দূরের কথা, আত্মরক্ষার মতো সম্বলও তাঁর ছিল না। দশ বছরের মাদানী জিন্দেগীতে তিনি দুই ডজনেরও বেশি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মহানবীর সংগ্রামী আদর্শ আরবের যুবসমাজকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।
পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদবিরোধী আদর্শ : কিষান ও মজরুম-সমাজের দু’টি মজলুম নিপীড়িত শ্রেণী। সামন্তবাদী এবং পুঁজিপতিদের শোষণের যাঁতাকলের শিকার হয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করে থাকে।
যুবমন, মজলুম, অশিক্ষিত কৃষক-শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি স্বভাবতই অগ্রণী, সহানুভূতিশীল। বিশ্বনবী যে আদর্শ প্রচার করেছিলেন তা ছিল কৃষক-মজুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জীবনদর্শন। আরবদেশে আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ কম। মরুদ্যানে বা অন্যত্র জায়গা-জমি বা কিছু ছিল তার প্রায় সবটাই ছিল মাত্র কিছুসংখ্যক লোকের হাতে। মহানবী (স:) প্রচার করলেন যে, জমিতে যারা সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করবে, জমি চাষ করার হক তাদেরই। কারণ জমি অন্য সব সম্পদের মতো নয়। যারা জমি অনাবাদি রেখে দেয়, তিন বছর পর তাদের সে জমিতে কোনো অধিকার থাকে না। মহানবীর এ ঘোষণার পর জমিতে শ্রম নিয়োগকারীরাই জমির অধিকারী হতে থাকে।
শ্রমিকদের অবস্থা দরিদ্র ক্ষেত-মজদুর এবং বর্গাচাষিদের থেকেও খারাপ ছিল। অধিকাংশই দাসসুলভ জীবনযাপন করত। নবী করীম (স:) ঘোষণা করলেন, মুনিব যে খাবার খাবে কর্মচারীকেও সে খাবার দিতে হবে। মুনিব যে কাপড় পরবে শ্রমিককেও তাই দিতে হবে। মুনিব যে ধরনের বিছানায় থাকবে, শ্রমিককেও তাই দিতে হবে। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যাপারে মুনিব-কর্মচারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। ইসলামের সাম্যবাদী এই আদর্শে প্রবীণরা যতই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, নবীনরা ততই অনুপ্রাণিত হয়। তাই মহানবীর কাফেলায় নবীনদের ভিড়ই বেশি ছিল।
শেষ : কোনো একটি আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য বহু শর্তের মধ্যে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হলো নির্ভুল ও সঠিক আদর্শ। দ্বিতীয়টি হলো আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিঃস্বার্থ আদর্শবাদী গতিশীল নেতৃত্ব এবং তৃতীয় শর্ত হলো, আদর্শে উজ্জীবিত কর্মীবাহিনী।
আল্লাহর দেয়া শাশ্বত জীবন-বিধানের সার্থক রূপায়ন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:)-এর পক্ষে সহজতর ছিল। তিনি মধ্য বয়সে দীনের কাজ শুরু করেন এবং তার বয়োকনিষ্ঠ যুবক ও তরুণ সাহাবীদেরকে এ আদর্শ বাস্তবায়নের মহান সৈনিক হিসাবে গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের সময় মহানবীর বয়স ছিল ৬১ বছর। মক্কা বিজয়ের পরও নবী করীম (স:) হুনাইন, তায়েফের যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করেন এবং আওতাজ গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। তাবুক অভিযানে ত্রিশ হাজার পদাতিক এবং দশ হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন। এটাই ছিল মহানবী (স:)-এর জীবনকালের সর্ববৃহৎ অভিযান। ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকালকালে তাঁর খুব অল্প কয়েকটির বেশি চুল দাঁড়িতে পাক ধরেনি। তার স্বাস্থ্য ছিল সুঠাম ও সুগঠিত। বিষের ক্রিয়ায় তিনি ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
লেখক : সাবেক সচিব, সাবেক মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন