আবাল-বৃদ্ধ বণিতা সকলের জন্যই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ সেরা। শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবার জন্যই তার জীবনে অনুকরনীয় আদর্শ রয়েছে। ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কর্মকর্তা, সেনাপতি, সৈনিক, বিচারপতি, রাষ্ট্রপতি সহ সকল পেশার, সকল পর্যায়ের মানুষের জন্যই তিনি মডেল এবং এক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ও একক। আজকের তরুনেরা যে সংকট অতিক্রম করছে এমনি এক সংকটকালে হযরত মুহাম্মদ (দ:) অসভ্য বর্বর, বিবাদমান উশৃঙ্খল আরব জাতির একটি নেতৃত্বাধীন পরিবারের দরিদ্র পিতার ঘরে ইয়াতিম হিসেবে আগমন করেন। তাদের মাঝেই তিনি লালিত পালিত হন। তাদেরই একজন হয়ে বেড়ে উঠেন। জন্মে পিতৃহীন, শৈশবে মাতৃহীন এবং কৈশোরে পিতাহারা এই তরুণের তারুণ্য কাটে পিতৃব্য আবু তালেবের ব্যবসায়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে। তবে তিনি শৈশবে আল্লাহর সরাসরি হেফাজত লাভ করায় ঐ ঘৃণ্য সমাজের কালিমা তাঁকে ছুঁতে পারেনি। তাদের একজন হয়েও তিনি তাদের মত হননি। দেশ-জাতি ও মানব গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ যুবকেরা। যৌবনদীপ্ত তরুণ-তরুণীরা ভাঙ্গা ও গড়ার সবচেয়ে শক্তিশালী কারিগর। বাংলাদেশের যে বিপুল জনশক্তি তার একটি বড় অংশ যুবশক্তি। আর এদের নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়ে আছেন অনেকেই, অভিভাবক মহল এবং তারা নিজেরাও। অধিকাংশ তরুণের মুখে চিন্তার বলিরেখা, হতাশার কালো মেঘ। তাদের অধিকাংশের ব্যস্ততা, হতাশাজনিত নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার নিমজ্জিত। এদের অলস, উৎপাদনহীন সময় কাটে এমন কাজে যা সমাজ সভ্যতার জন্য কোন কল্যাণ আনতে পারে না। তরুণের এই যে দুরবস্থা, তারুণ্যের এই যে অবমূল্যায়ন এর জন্য কে দায়ী? এ অবস্থায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। এবং তা খুব সহজেই। আর এই সম্ভাব্য কাজটি করার জন্য প্রয়োজন সরকার, জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ ও তাতে অংশগ্রহণ।
প্রত্যেক মানুষের জন্য চাই আদর্শ: বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের জন্য থাকা চাই একটি আদর্শ যার নিরিখে তার ব্যক্তিক, সামষ্টিক ও জাতীয় জীবন পরিচালিত হবে। যারা কোনো না কোনো আদর্শকে নিজের জন্য মডেল করে নিতে পেরেছেন তারা জীবনে বহুদূর এগিয়ে যেতে পেরেছেন বা পারেন। আর যারা আদর্শ শূণ্যতার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের জীবনে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হয় না। আজ যদি তরুণদের জিজ্ঞাসা করা হয় আপনার জীবনের আদর্শ কে বা কি? অধিকাংশ তরুণই কোনো সচেতন মতামত দিতে পারে না। কেউ কেউ আবেগ বশে কোনো আদর্শের নাম উচ্চারণ করলেও পর মুহূর্তে সে আদর্শ সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নেরই জওয়াব দিতে পারে না। আদর্শ সর্ম্পকে অসচেতনতা কিংবা অজ্ঞতা এর মূল কারণ। তার চেয়েও বড় কারণ আদর্শের প্রতি কমিটমেন্টের অভাব। অনেকেই আদর্শের কথা মুখে বললেও বাস্তব জীবনে আদর্শ চর্চার বিপুল ঘাটতি রয়েছে। তারপরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। ধর্ম ও ধর্মীয় জীবন সর্ম্পকে প্রচলিত প্রথাগত ধারণা আমাদের তরুণ সমাজকে করেছে আরো বিভ্রান্ত। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ধর্মের মতো ইসলামকেও শুধুমাত্র, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, খানকার বিষয়ে পরিণত করে রাখার একটি মানসিকতা আমাদের রয়েছে। যার জন্য জীবন হয়ে পড়েছে দ্বিখন্ডিত। একটি ধর্মীয় জীবন আর একটি দুনিয়াবী জীবন। ফলে মসজিদে আল্লাহর সামনে একাগ্র ও বিনীতচিত্তে ইবাদতরত তরুণকে দেখা যায় ব্যবসায়ে ভেজাল দিচ্ছে, অবৈধ পণ্যের ব্যবসা করছে, রাজনীতিতে খোদাহীন ও সেক্যুলার রাজনীতির অনুসারী এবং সমাজের অনেক অসাধু কাজেই দোসর হিসাবে কাজ করছে। এসবই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কুফল।
রাসূলের আদর্শই সেরা আদর্শঃ পৃথিবীর সেরা সর্বশেষ এবং শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (দ:) তিনি উম্মী হয়েও সারা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা শিক্ষক। কেননা তিনি স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সকল কালে, সকল দেশে, সকল মানুষের জন্য সমান কার্যকর ও কল্যাণময়। তাঁর জীবনাচার যে কোনো মানুষের জন্যই আনতে পারে অভাবনীয় পরিবর্তন। যৌবনেই তিনি জনগণের মাঝে পরিচিতি লাভ করেন “আল-আমীন” বা অতি বিশ্বাসী ও আস-সাদিক বা সত্যবাদী হিসেবে। নবুয়াত প্রাপ্তির আগেই তিনি দরিদ্রের বন্ধু, মযলুমের সাহায্যকারী, অসহায়ের সহায়, জ্ঞানের উত্তম সাথী আর মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা লাভ করেন। এক আল্লাহর আদিষ্ট পথেই তিনি নিজে চলতে লাগলেন এবং পথ নির্দেশ দিতে থাকলেন। সেই পথ নির্দেশই এনে দিল যুলুমের অবসান, মযলুমের মুক্তি ও সাম্যের সুন্দর সমাজ। ফলে, বার্নাডশ, মরিস বুকাইলি, উইলিয়াম পিকথল লিওটলস্টয়, পন্ডিত নেহেরু সহ অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত মনীষী তার আদর্শে শ্রেষ্ঠত্ব ও মানবতার মুক্তির জন্য এ আদর্শের উপযোগিতা সর্ম্পকে দ্ব্যর্থহীন মন্তব্য করে নিজেরা ধন্য হয়েছেন।
মুহাম্মদ (দ:) যুবকদের জন্য এক অনুপম আদর্শঃ আজকের যুবকরা যদি হযরত মুহাম্মদ (দ:)- এর অনুসরণীয় সুন্দর জীবন সর্ম্পকে জানতো তাহলে প্রত্যেকটি যুবকই তার মতোই হতে চাইতো প্রতিটি যুবকই আত্মশক্তির এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাতো যা তাকে নিয়ে যেত সুন্দরতম জীবনের দিকে।
যৌবনই শ্রেষ্ঠ : আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (দ:) বলেছেন, পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত মানব সন্তানকে কেয়ামতের দিন এক কদম সামনে যেতে দেওয়া হবে না।
১. তোমাকে যে জীবন দিয়েছিলাম তা কোন কাজে ব্যয় করেছ?
২. যে যৌবন কাল তোমাকে দিয়েছিলাম তা কোন কাজে অতিবাহিত করেছো?
৩. কোন পথে আয় করেছো?
৪. কোন পথে তা ব্যয় করেছো?
৫. যতটুকু জ্ঞান তোমাকে দেয়া হয়েছিল তা কোন কাজে লাগিয়েছো?
জীবনের ব্যাপারে প্রশ্ন করার পর আবার যৌবন সম্পকে প্রশ্ন করা মানেই যৌবনের বিশেষত্ব রয়েছে। যৌবনের ব্যাপারে আল্লাহর আলাদাভাবে জিঞ্জাসাবাদ করবেন কারণ এটাই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। হাদীসে রয়েছে “যৌবনে যখন একবার আল্লাহকে ডাকা হয় তিনি চল্লিশবার তার জবাব দেন, আর আল্লাহর রাসূল (দ:) বলেছেন, যৌবনের কুরবানী সর্বশ্রেষ্ঠ কুরবানী, আল্লাহ যৌবনের কুরবানীই বেশি পছন্দ করেন।
আজকের তরুণ সমাজের মর্যাদার উৎস নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে নিহিত রয়েছে:
১. প্রতিটি যুবককে আল্লাহর দাসত্ব কবুল করতে হবে।
২. প্রত্যেক যুবক আল্লাহকে ভয় করে চলবে।
৩. যুবক হৃদয় মসজিদে নামায আদায়ের ব্যাপারে সচেতন থাকবে।
৪. আল্লাহর ভয়ে পৃথিবীর যে কোনো মোহ থেকে মুক্ত থাকবে।
৫. আল্লাহর পথে জীবন কুরবানীর ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।
যৌবনের প্রতিটি মুর্হূতে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী ব্যয় করবে। এর ফলে দেখা যাবে জীবনের এক আশ্চার্য পরিবর্তন এসে গেছে। এ বিষয়গুলোতে যে অভ্যস্থ হয়ে যাবে সে হবে অকুতোভয়। দুনিয়ার সবচেয়ে স্মার্ট লোক হবে অথচ তার কোনো অহংকার থাকবে না। সে হয়ে যাবে নাজ্জাশীর দরবারের জাফর বিন আবু তালিব। নির্বাসিত জীবনেও সেখানে মাথা উঁচু থাকে, সম্রাটের দরবারেও নির্ভয়ে বলে যায় হক ও বাতিলের কথা, সম্রাটের দরবারকে অভিভূত করে ফিরে আসে বিজয়ীর বেশে। এর-ই ফলে জন্ম নেয় নির্ভীক দিগি¦জয়ী অথচ অনুগত পরায়ণ বীর। জন্ম নেয় খালিদ বিন অলিদ, জয় করে দেশের পর দেশ। জানে না পরাজয় কাকে বলে। জনকন্ঠে শ্রুতি উঠে খালিদ সাইফুল্লাহ, তার কোনো পরাজয় নেই। আর তিনি তখন অহংকারের আশংকায় সেজদাবনত হন, এমনি সময়ে টগবগে যুবক সেনাপতির কাছে চিঠি আসে খলিফার। নির্দেশ দেয়া হয় সেনাপতি ত্যাগ করে নতুন সেনাপতির (তারই অধীনে সৈনিক) আনুগত্য করতে, সহাস্য বদনে সেনাপতি চলে যায় সৈনিকের কাতারে, সৈনিক তুলে সিপাহসালারের পতাকা।
এ আদর্শ মেনে নিলে কমপক্ষে পাঁচবার সর্ম্পক হবে মসজিদের সাথে পাঁচবার মসজিদে যাওয়া মানেই আমাদের আরো কিছু ভালো লোকদের সঙ্গে দিনে কয়েকবার দেখা হওয়া। এ ভাবেই ব্যক্তি হয়ে উঠে সামাজিক। সমাজ সম্পৃত্ততা তাকে দেয় ভালো ও সামষ্টিক কাজের প্রেরণা। প্রতিটি কাজের যখন সে আল্লাহর কথা স্মরণ করে তখন স্বাভাবিকভাবেই কোনো অন্যায় ও অসুন্দর কাজে জড়িত হতে পারে না। (চলবে)
লেখক : সাংবাদিক, কবি ও কলামিষ্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন