এক
আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের আবিভাব ৫৭০ খ্রীস্টাব্দের ১২ই রবিউল আওয়াল সোমবার সোব্হে সাদেকের সময়। এই ১২ই রবিউল আউয়াল (৮ই জুন ৬৩২) তারিখেই তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন।
রবিউল আউয়াল মাসে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে লিখবেন, বলবেন, আলোচনা করবেন যে প্রধানত ইসলাম বিষয়ক আলেমরা, ইস্লাম বিষয়ক জ্ঞানী ব্যক্তিরা অর্থাৎ ইস্লাম বিষয়ক অধিকারী ব্যক্তিরা, সেটাই তো স্বাভাবিক। আমি জানি, এ বিষয়ে লেখার সেরকম কোনো যোগ্যতা আমার নেই। তবে এটা-ও ঠিক যে, মুসলমান ঘরে আমার জন্ম। মুসলিম পরিবারের আমি সন্তান। খুব শৈশব থেকেই আদর্শ মুসলমান হিসাবে, আদর্শ মানুষ হিসাবে দেখতে শিখেছি তাঁকে।
কেবল দেখতে শেখা নয়, আমার জীবনরোধে, আমার ব্যবহারিক জীবনে আসলে যে কাজ করে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়ই ওয়া সাল্লামের আদর্শ সেটাও আমি উপলব্ধি করি। সব সময়েই উপলব্ধি করি!
শৈশবে, বাল্যে এবং কৈশোরে লক্ষ্য করতাম, আব্বা ঘরে পায়চারি ক’রতেন এবং মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ মহৎ মানুষদের আদর্শের কথা বলতেন। যথার্থ ত্যাগী মানুষদের, যথার্থ মহৎ ও আদর্শ মানুষদের আদর্শের কথা ব’লতেন। তাঁর কাছেই শুনতাম যে, আমাদের প্রিয় রাসূল হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়ই ওয়া সাল্লাম ছিলেন সম্পূর্ণরূপেই একজন আদর্শ মুসলমান, একজন আদর্শ মানুষ। অনন্য সাধারণ আদর্শের প্রতীক ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে প্রিয় রাসূল হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবনের অনেক ঘটনার কথাও উল্লেখ করতেন আমার আব্বা। সেই সব আদর্শকে গুরুত্ব দিয়েই কৈশোরে আমার মানসিক ভাবনাটা হ’য়ে গেছে।
খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আব্বার কাছে সে সব কথা। এভাবে সেই শৈশবে, বাল্যে এবং কৈশোরে আমার জীবনবোধ তৈরি হ’য়েছিল। সেই জীবনবোধ নিয়েই আজো এই ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশেও চলছি আমি। এই আদর্শ যদি মক্কা-মদিনার দেশের নামাজ পড়া মুসলমানদের সবার মধ্যে থাকতো তাহ’লে সেখানে আজ জামাল খাসোগীর মতো মানুষদের খুন করার মতো হৃদয়হীন কোনো লোক সে দেশে থাকতো না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চলাকালের (১৯১৪-১৯১৮) সেই আরবী ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যে কেবল তুর্কীভাষী খলিফার নেতৃত্বাধীন খেলাফতের পতন ঘটানো নয়, সেই মক্কা-মদিনার দেশের অন্তত কিছু লোককে যে ইতোমধ্যেই কেবল ধর্মনিরপেক্ষ নয়, নাস্তিক বানিয়ে দিয়েছে, সেটাও এরকম ঘটনা থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট।
ইস্লাম আদৌ কোনো অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়। ইস্লাম একটা আদর্শের নাম, একটা জীবন বিধানের নাম, একটা জীবন ব্যবস্থার নাম। সেই আদর্শ মানলে, সেই জীবন বিধান মানলে, সেই জীবন ব্যবস্থা মানালে একজন মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হ’য়ে উঠতে পারবেন। তখন তিনি অন্যের সঙ্গে ঠিক সেভাবেই কথা বলবেন যেরকম কথা তাঁর নিজেরও শুনতে ভালো লাগে, অন্যের সঙ্গে তিনি ঠিক সেভাবেই ব্যবহার ক’রবেন, যেরকম ব্যবহার তিনি নিজেও প্রত্যাশা করেন। কথাবার্তা এবং ব্যবহারের মানদÐ নিজের জন্য একরকম এবং অন্যের জন্য আর একরকম, এরকমটা তিনি রাখবেন না।
দুই
আমার শৈশবে, আমার বাল্যে এবং কৈশোরে আমার আব্বা শিখিয়েছেন, তুমি অন্য কাউকে সেরকম কোনো কথা বলো না যেরকম কথা তুমি নিজে শুনতে চাওনা, অন্য কারো সঙ্গে তুমি সেরকম কোনো ব্যবহার ক’রো না, যেরকম ব্যবহার তুমি নিজে পেতে চাও না। এটাই মানবিকতা, এটাই মানবাধিকার, এটাই সাম্য ও সহাবস্থান চিন্তা, এটাই ইসলাম। এটাই প্রকৃত ইস্লাম। কেবল নামাজ, রোজা, হজ ইবাদত নয়। এসবই ইবাদত। ব্যবহারিক জীবনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ইবাদত। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবনের জন্য অত্যন্ত দরকারী ইবাদত। অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থান চিন্তা অবশ্যই একাধারে মানবাধিকার চিন্তা এবং ইসলাম চিন্তা।
এই শিক্ষাটা আমি আমার শৈশবে, বাল্যে এবং কৈশোরে আমার আব্বার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তাই আমি আমাদের ইস্লামী ঐতিহ্যের মধ্যে শান্তি ও সুস্থিতি খুঁঝি। আমাদের ইস্লামী ঐতিহ্য আমার আশ্রয়, আমাদের ইস্লামের ইতিহাস আমার প্রেরণা পাওয়ার আসল জায়গা। আমাদের সমাজের ইতিহাস আমার কাছে অপরিহার্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা পাওয়ার জায়গা।
তিন
সেই শৈশবে, বাল্যে, কৈশোরে আব্বার কাছে বার বার শুনতাম, আব্বা ব’লতেন, এক অমুসলিম বৃদ্ধা মহিলা আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে তার জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিপক্ষ ও শত্রæ হিসাবে সনাক্ত ক’রে তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। একদিন পথে কাঁটা বিছানো না থাকায় সেই বৃদ্ধা মহিলার বিষয়ে চিন্তিত হ’য়ে প’ড়লেন এবং তাঁর কী হ’য়েছে সে বিষয়ে খোঁজ নিতে তার বাড়ীতে গেলেন। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন সেই বৃদ্ধা মহিলা অসুস্থ। এটা লক্ষ্য ক’রে তিনি তাঁর সেবাযতœ করা শুরু ক’রলেন। এমনই সহাবস্থানকামী, অপরিসীম সহনশীল, ক্ষমাসুন্দর, মহৎ, উদার, পরিনামদর্শী ও শিক্ষনীয় ছিল তাঁর চরিত্র মাধুর্য। কোনো তরবারির জোরে নয়, সাম্য ও সহাবস্থানকামী এই শিক্ষার গুণেই ইস্লামের একদিন প্রসার ঘটেছিল। অর্ধেক দুনিয়া ইস্লামের পতাকার তলে চ’লে এসেছিল।
তাঁর ওপর পৌত্তলিকদেরও অগাধ আস্থা ছিল। পৌত্তলিকরাও তাঁর কাছে পরম বিশ্বাসে আমানত রাখতেন। এই আমানতেরও কোনো খেয়ানত তিনি কোনো দিন হ’তে দেননি।
কেবল বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক, ও রাজনৈতিক সহাবস্থানকামী তিনি ছিলেন না, সামাজিক সাম্যকামী ও অর্থনৈতিক সাম্যকামী ও তিনি ছিলেন।
তাঁর শেষ দিরহামটিও তিনি দরিদ্র ও অনাহারী মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন।
এমনও হ’য়েছে যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে ঘরে একটি মাত্র শুকনো খেজুর ছিল। এই অবস্থায় ভিখারী এসে ফিরে গেছেন। পরে ঘরে ফিরে এই ঘটনার কথা শুনে মন:ক্ষুন্ন হ’য়েছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে, এই একটি মাত্র শুক্নো খেজুরও তো ভিখারীকে দেয়া যেত! সঞ্চয়ের শিক্ষা তো ইস্লামের শিক্ষা নয়। ইস্লামের শিক্ষা তো ত্যাগের শিক্ষা, সাম্যের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের শিক্ষা।
ইস্লামের এই সাম্য ও সহাবস্থানকামী চিন্তাধারাটা জাতীয়তাবাদ এবং এক জাতিতত্ত¡ প্রভাবিত ভারতীয় উপমহাদেশের এবং বিশ্বের জন্য খুবই প্রয়োজন। অপরিহার্যভাবেই প্রয়োজন। সাম্য ও সহাবস্থানকামী চিন্তা-ভাবনার অভাবে মায়ানমারে, এই ভারতীয় উপমহাদেশে এবং বিশ্বের আরো অনেক জায়গায় মানবতা বিরোধী নানান ঘটনা ঘটে চ’লেছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইস্লাম অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই ছিলেন এই সাম্য ও সহাবস্থানকামী কবি। এই পরিচয়টাই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, সবচেয়ে মহৎ পরিচয়, সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় পরিচয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইস্লাম সাম্য ও সহাবস্থানকামী হয়েছিলেন ইসলামের শিক্ষা থেকেই। এই সাম্য ও সহাবস্থানের চিন্তা ধারাটা তাঁর ব্যবহারিক জীবনে এবং সৃষ্টিতে অত্যন্ত গভীর আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরাটাই ছিল আমাদের প্রিয় জাতীয় কবির সবচেয়ে বড় দান। অনন্য সাধারণ দান।
চার
সেই শৈশবে, বাল্যে এবং কৈশোরে কবি কাজী নজরুল ইস্লামের কথাও শুনতাম আব্বার কাছে। তাঁর কাছে শুনে শুনে কবি কাজী নজরুল ইস্লামের অনেক গান, অনেক কবিতা সেই শৈশবে, বাল্যে এবং কৈশোরেই আমার মুখস্থ। হ’য়ে গিয়েছিল। আমার আব্বার পর আমাকে কবি কাজী নজরুল ইস্লাম সম্পর্কে শ্রদ্ধা পোষণ করতে শিখিয়েছেন ইস্লাম বিষয়ক অনেক প্রয়োজনীয় গ্রন্থের প্রনেতা, হুগলীর আকুনি-বাঁদপুর এলাকার মানুষ, চব্বিশ পরগনার হাড়োয়া পীর গোরচাঁদ হায়ার সেকেন্ডারী স্কুলের আমার প্রিয় আরবী শিক্ষক কাজী মোহাম্মদ মোস্তফা সাহেব। আল্লামা ইকবালের বিষয়ে, কবি কাজী নজরুল ইস্লামের বিষয়ে একজন ভক্ত হিসাবে পড়াশুনা করতেন তিনি। সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তান থেকেও অনেক বই-পত্র তাঁর আত্মীয়-পরিজনরা পাঠাতেন তাঁর কাছে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইস্লামের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। ইস্লামের শিক্ষা, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া আদর্শ মানবাধিকারের বিষয়ে, সাম্য ও সহাবস্থানের বিষয়ে, সততা ও ন্যায় পরায়ণতার বিষয়ে স্পর্শকাতর মনের কবি কাজী নজরুল ইস্লামের মনের সংবেদনশীলতাকে স্থায়ী ও দৃঢ় ক’রে দিয়েছিল। ইস্লামের ঐতিহ্যই হ’য়েছিল কবি কাজী নজরুল ইস্লামের মূল আশ্রয়। ইস্লামের ইতিহাসই হ’য়েছিল কবি কাজী নজরুল ইস্লামের কাছে সব চেয়ে প্রিয় বিষয়। ফলে তামাম বিশ্বের পুরো মুসলিম সভ্যতাটাই উঠে এসেছে কবি কাজী নজরুল ইস্লামের সৃষ্টিতে। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন