বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

একটি অপূর্ব না’ত

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

না ‘ত’ আরবী শব্দ। এর ফারসী অর্থ ‘দরুদ’ বাংলা প্রশংসা। আর সে প্রশংসা একমাত্র সর্বশেষ নবী ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিয়ে আবর্তিত। না’ত বা দরুদের উৎস কিন্তু আল্লাহর সর্বশেষ কালাম পবিত্র কোরআন হতেই উৎসারিত। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন; অগণিত ফেরেশতা নবীর প্রশংসায় মুখর। তাই মু’মীন মুসলমানরা এমনকি বহু অমুসলিমও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কেন্দ্র করে না’ত রচনা করেছেন। আর সে না’ত রচিত হয়েছে পৃথিবীর বহু ভাষায়। এসব না’তের মাধ্যমে নবী প্রেমিক কবিরা রসূলের প্রতি অনাবিল ভালবাসা ব্যক্ত করেছেন এবং রসূলের সর্বপ্রকার কল্যাণ কামনা করেছেন। তাঁরা আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করেছেন যে, তাঁর অনুগ্রহের ফল্গুধারা নবী ও তাঁর বংশধরদের প্রতি অনাদিকাল বর্ষিত হোক- সেই বষর্ণের অমিয় ধারায় ¯œাত হোক মু’মীন বিশ্বাসী অনুসারিগণ। এসব কামনা বাসনা থেকেই গত চৌদ্দশ বছর ধরে না’ত বা দরুদ বহু ভাষায় বহু কবি কর্তৃক রচিত হয়ে আসছে। সম্মানীত সাহাবী কবি হতে শুরু করে আজ পর্যন্ত আরবী ভাষায় অসংখ্য না’ত রচিত হয়েছে। এর মধ্যে কবি কা’ব বিন যোহাইর (রাঃ) এর ‘বানাত সুয়াদ’ আর ইমাম বুস্রীর “কাসিদায়ে বুরদা” না’ত হিসেবে অনন্য। ‘তুর্কী ভাষায়, ফারসী ভাষায়, উর্দু ও সাওহালী ভাষায়, এমনকি হিন্দী ও বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে অসংখ্য নবী প্রশস্তিমূলক কবিতা বা না’ত। আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও অপূর্ব যে নাত’টি বিশ্বময় চির-ভাস্বর তা হলো মহামরমী কবি শেখ সাদীর (১১৮৪-১২৯২ ঈঃ)। অমরকাব্য “বালাগাল উলা বে-কামালিহী”। শেখ সা’দী মূলতঃ ফারসী ভাষার কবি। তবে তাঁর অমর না’তটি রচিত হয়েছে আরবী ভাষায়। এখানেই রসূলের মাতৃভাষা আরবীতে রচিত ‘না’ত এর চির ভাস্বরতা বিরাজমান।
সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন, “ইনসানে কামিল” বা পরিপূর্ণ মহামানব। তাঁর পবিত্র সত্তার মাধ্যমেই মানব জাতি লাভ করেছে ইহ-পারলৌকিক মুক্তির ও কল্যাণের মহাসনদ। মানুষের জীবনে সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করে পারলৌকিক স্থায়ী শান্তি লাভের জন্য একমাত্র তাঁর পূত চরিত্র অনুসরণ ছাড়া কোন বিকল্প পথ নেই। পার্থিব জীবনে সুখ-শান্তি অর্জনের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাধ্যমে মানুষকে সঠিক সংবিধান বা জীবন-বিধান দান করেছেন। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে অর্থ্যাৎ তার পারিবারিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে তথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে, শান্তি ও শৃংখলা আনয়ন করবে একমাত্র শেষ নবীর প্রদর্শিত কল্যাণময়ী বিধান। তা তিনি নিজে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়ে দিয়েছেন। মানব জীবনের সর্বস্তরেই তাঁর প্রদর্শিত পথে রয়েছে পরিপূর্ণ শান্তি ও কল্যাণ। তাই তাঁর পবিত্র জীবন ছিল কামালিয়তে ভূষিত বা পরিপূর্ণ। আর সেজন্যই আল্লাহ তাঁকে “রাহমাতুল্লীল আলামীন” বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি হলেন সর্বোত্তম চরিত্র মাধুরীর অধিকারী। কবি শেখ সা’দী ছিলেন ধীরস্থির স্বভাবের কবি। তিনি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মাত্র চারটি চরণে পরিপূর্ণ রসূলের করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র যেভাবে ব্যক্ত করেছেন এমনটি আর কেউ পারেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও মানবকল্যাণে যাঁর জীবন ছিল উৎসগির্ত মানব জীবনের প্রতিটি স্তরে যাঁর জীবনের প্রভাব অত্যধিক প্রতিফলিত, তাঁর উদ্দেশ্য রচনা করবেন ‘না ‘ত’। অনেক ধ্যান-সাধনা করে তিনি আরবী ভাষায় লিখলেন মাত্র তিন লাইনঃ
বালাগাল উলা বি-কামালিহী
কাশাফাদ দোজা বে- জামালিহী
হাসুনাত জামিউ খিসালিহী।
প্রতিটি চরণ রচনা করে কবি ভাবতে লাগালেন, মিল সহকারে এবং একই মাত্রায় চতুর্থ লাইন কি লেখা যায়? এ নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করেও তিনি আর চতুর্থ লাইনটি লিখতে পারলেন না। এভাবে ভাবনা-চিন্তা করতে করতে কবির বারটি বছর কেটে গেল। নবী প্রেমিক কবি এক রাতে শুচিশুদ্ধ দেহমন নিয়ে নিদ্রায় মগ্ন হলেন। তখনই তিনি স্বপ্নে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখলেন। তিনি বলছেন,“এতোই যদি আমার প্রতি তোমার শ্রদ্ধা,তাহলে লিখ- ‘সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী। ঘুম থেকে উঠে কবি সঙ্গে সঙ্গেই রসূলের নির্দেশ মতো চতুর্থ লাইন যুক্ত করে শেষনবীর পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র চার লাইনে বাণীবদ্ধ করলেন অনাদিকালের জন্য। যেমন ঃ
বালাগাল উলা বে-কামালিহী
কাশাফাদ দোজা বে- জামালিহী
হাসুনাত জামিউ খিসালিহী।
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।

অপূর্ব এই অমর না’তের বদৌলতে পারস্যের মরমী কবি শেখ সাদী ও অমরত্ব লাভ করলেন। বিগত আটশ বছর ধরে এই না’ত বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে আসছে। নবীর সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি মাহফিল মজলিসে এটি ভক্ত হৃদয়ের স্বর্গীয় আবেগ নিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি মিলাদ মাহফিলেও এর চর্চা হচ্ছে। এ চর্চা চলবে বিশ্বের শেষ দিনটি পর্যন্ত। রসূলের জীবন চিত্রের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা এ চার লাইনে করেও ভক্ত হৃদয় তৃপ্তি পাচ্ছে না। তাই বলছে- ইয়া সাহিবাল জামালি, ইয়া সায়্যিদালবাশার মিন ওজহিকাল মুনিরে, ফাকাদ নাও- ওয়ারাল কামার।
লায়ুম কিনুস সানাউ কামা কানা হাককু’হু
বাদআজ খোদা বুজর্গ তুঈ কিচ্ছা মুখতাছার।
অর্থ্যাৎ হে মোর সুন্দর! হে নর রতন!
চাদেঁরে দিয়েছে জ্যোতি তোমার আনন।
অসম্ভব যথাযোগ্য প্রশংসা তোমার
সংক্ষেপে, খোদার নীচে তোমারই আসন।
কবি শেখ সা’দীর ‘গুলিস্তা’ কাব্যে উল্লেখিত রসূল প্রশস্তির চরম প্রকাশরূপে রচিত লাইন চারটি প্রতিটি মুসলিম কবি সাহিত্যিকের কন্ঠে ঝংকৃত হয়েছে বেশী। বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি- সাহিত্যিকও এ চরণ চারটির কাব্যানুবাদ, ভাবানুবাদ এমন কি গদ্যানুবাদ করেছেন। এরূপ কয়েক জনের অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করা হলো। জ্ঞান-তাপস বহুভাষাবিদ ছিলেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯ ঈঃ)। তিনি সীরাতের ওপর গবেষণামূলক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি শেখ সা’দীর অমর কাব্যের গদ্যানুবাদ ও পদ্যানুবাদ করেছেন। তাঁর গদ্যানুবাদ এরূপ-“তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পূর্ণতার সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছেন। তিনি তাঁহার সৌন্দর্যের আলোকে অমানিশার অন্ধকার বিদূরিত করিয়াছেন।
ডঃ শহীদুল্লাহ কাব্যনুবাদ করেছেন এভাবেঃ
“অতিশয় মহান গুণগান যাঁহার
রূপে যাঁর অমার নাশে ঘোর আঁধার
মনোরম যাঁহার সমুদয় আচার
পড় সব দরুদ হে উপর তাঁহার।”
শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসামান্য জীবন সাধনায় ও কল্যাণময়ী শিক্ষায় রয়েছে মানুষের সর্বোত্তম সমাধান। তাঁর পরম প্রোজ্জল জীবনাদর্শ চরিত্র মাধুর্য ও কর্ম মাহাত্ম্যে বিপুলভাবে বিমুগ্ধ হয়ে বাংলার বিদ্রোহী ও মরমী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-নির্বাক ১৯৪২ মৃঃ ১৯৭৬ ঈঃ) রচনা করেন অসংখ্য কবিতা, গান ও গজল। বস্তুতঃ নজরুল সাহিত্যের এর বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে নবী প্রশস্তিমূলক না’ত। তিনি কবি সা’দীর উপরোক্ত অপূর্ব সুন্দর প্রশান্তির ভাবানুসরণে রচনা করেন নিম্নোক্ত গজল বা নাতিয়া-
কুলমখলুক গাহে হযরত
বালাগাল উলা বেকামালিহী।
আঁধার ধরায় এলে আফতাব
কাফাফাদ দুজা বেজামালিহী।
রৌশনীতে আজো ধরা মশগুল
তাইতো ওফাতে করি না কবুল।
হাসানাতে আজো উজালা জাহান
সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি।
নাস্তিরে করি নিতি নাজেহাল
জাগে তৌহিদ দ্বীন-ই কামাল।
খুশবুতে খুশী দুনিয়ার বেহেশত
সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি।
প্রবীণ কবি ও ছান্দসিক আবদুল কাদির (১৯০৬-৮৫ ঈঃ)
উক্ত ‘নাত’ এর কাব্যানুবাদ করেন এভাবে-
(চলবে)

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন