কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মাতামুহুরী-সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী দশ উপজেলায় প্রায় ৬০ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ শুরু হয়েছে। এসব জমিতে রবি শস্য ও ধান চাষের জন্য সরকার কর্তৃক ভুর্তকি দেয়া সার ব্যবহার হচ্ছে তামাক চাষে। এ দিকে তামাক শোধনের জন্য নির্মিত হয়েছে ৪০ হাজার চুল্লি। চট্রগ্রাম বন সার্কেলের লামা, বান্দরবান, পাল্পউড ডিভিশন, চট্রগ্রাম দক্ষিণ ও কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগের সংরক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বনাল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির কঁচি কঁচি বৃক্ষরাজি কেটে লাখ লাখ মণ জ্বালানি কাঠ মজুদ করা শুরু হয়েছে। এসব পরিবেশ বিধ্বংসি কাজে অনৈতিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগ, থানা ও ফাড়ি পুলিশের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জ¦ালানী কাঠ ভর্তি পি-কাপ, ট্রাক ও মিনি ট্রাক বন বিভাগের ডেকি কল বিনা বাধায় পেরিয়ে পুলিশের সামনে দিয়ে তামাক চুল্লিতে পাচার হলেও তা আটকানোর কেউ নেই। এ অভিযোগ স্ব স্ব এলাকার পরিবেশ সচেতন মহলের।
তামাক চাষে সার পাচারে জড়িত বিসিআইসির ইউনিয়ন ও সার ডিলাররা জড়িত থাকলেও কৃষি বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট উপজেলার দায়িত¦ প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা সার পাচারকারী ডিলারদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে রবি শষ্য ও ধান চাষে জড়িত কৃষকেরা অভিযোগ করেছে।
তামাক চাষের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলা। অপর দিকে পাশ^বর্তী পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানচি, নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা, রুয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর উপজেলাসহ দু জেলার উল্লেখিত দশ উপজেলায় প্রায় লক্ষাধিক তামাক চাষিকে দাদন দিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসি তামাক চাষে উৎসাহ যোগাচ্ছে বৃট্রিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো ও আবুল খায়ের ট্যোবাকোসহ আরোও বেশ কয়েকটি অখ্যাত তামাক কোম্পানী গুলো।
১৯৮৮ সাল থেকে প্রায় ৩০বছর যাবৎ তামাক চাষ হয়ে আসছে এই এলাকায় উল্লেখিত তামাক কোম্পানীগুলো। লামা উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়ন সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, সবকয়টি তামাক কোম্পানির সহায়তায় ৯ হাজার ৩ শত হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে আরো প্রায় ২ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। লামা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে লামা উপজেলায় আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৫শত হেক্টর। ২০১১ইং সালে উপজেলা চাষী স্বার্থরক্ষা কমিটির তামাক চাষ বন্ধ ও ন্যায্য দাম পাওয়ার বিষয়ে বান্দরবান জর্জ কোর্টে তামাক চাষের বৈধতা নিয়ে রিট করলে আদালত তামাক চাষ নিয়ন্ত্রনে রাখতে সর্বমোট ১ হাজার হেক্টর চাষের অনুমতি দেয়। কিন্তু বাস্তবতা এর বিপরীত। সমগ্র জেলা ঘুরে দেখা যায় এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমিসহ সরকারী রিজার্ভ, নদীর দু’পার তামাক চাষের দখলে।
এমনকি কৃষি অফিসসহ সরকারি নিজস্ব জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। সরকার তামাক চাষের বিরোধীতা করছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি অফিসের অব্যবস্থাপনা চাষীরা তামাক চাষের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। বেপরোয়া তামাক চাষের ফলে পরিবেশ ও সমাজের নানা ক্ষতি, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যহানি ও নেশাগ্রস্থতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আরো জানা যায়, বর্তমানে লামা উপজেলায় ৫ হাজার ৫ শত জন চাষী তামাক চাষে জড়িত।
লামা পৌরসভার কৃষক নুরুল আমিন, মংক্যহ্লা মার্মা, রশিচন্দ্র ত্রিপুরা, নীলকান্ত বড়–য়া, মংবাচিং মার্মা সহ একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, কৃষি পন্য চাষ করে তেমন কোন সহায়তা পাওয়া যায় না। তাই আমরা আগে ধান ও শস্য চাষ করলেও বর্তমানে তামাক চাষে করছি। তামাক কোম্পানীর ফিল্ড অফিসাররা চাষাবাদে হাতে কলমে আমাদের শিক্ষা দেয় এবং নানাবিধ সহায়তা করে। সে তুলনায় কৃষি বিভাগের সহায়তা অপ্রতুল।
উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজে অবহেলা, দায়িত্ব পালনে অনিহা, কৃষকের সাথে দূরত্ব, সরকারের কৃষি উন্নয়নে গৃহীত নানান প্রকল্প কৃষককে অবহিত না করা, সার ডিলারদের সাথে সখ্যতা তৈরি করে সার পাচার বাণিজ্য, কৃষি উপকরণ বিতরণে পক্ষপাতিত্ব, কৃষকদের সাথে নিয়মিত কৃষি সমাবেশ না করা, বীজ বিতরণে অনিয়ম, পণ্য বিপননে অসহযোগিতাসহ ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সিংহভাগ আবাদি জমি আজ তামাকের দখলে চলে গেছে বলে জানায় তারা। কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, আমরা ধান ও শস্য চাষে সার চাইলে পাইনা। কিন্তু তামাক চাষীদের প্রয়োজন মত সার দেয়া হয়। সরকারের ভূর্তীকির সার তামাকে ব্যবহার করছে। এই বিষয়ে অসাধু সার ব্যবসায়ী ও কৃষি অফিসের দায়িত্বরত কর্মচারীরা জড়িত।
তামাকের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়ে লামা হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার মো. শফিকুর রহমান মজুমদার বলেন, তামাক গ্রহণে মানুষের ক্যান্সার, হার্টের বিভিন্ন রোগ, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট ও পায়ে পচন এবং ধুয়াবিহীন তামাক জর্দা ও সাদাপাতা ব্যবহারের ফলে খাদ্যনালীতে ক্যান্সারসহ নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকের কারণে প্রায় এক লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া ৩ থেকে ৪ লক্ষ লোক তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে অসুখ ও অক্ষমতাজনিত কুফল ভোগ করে।
মরণ চাষ তামাক নিয়ে বান্দরবান কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলতাব হোসেন বলেন, যেভাবে তামাক চাষের আবাদ বাড়ছে তা যথারীতি অত্র জনপদের জন্য হুমকি স্বরুপ। ধান ও শস্য চাষে কৃষকদের ফিরিয়ে আনতে সরকার কর্তৃক স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য সহ নানান পদক্ষেপ সরকার ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন