বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলা, দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল স্থলবন্দর, নওয়াপাড়া নদীবন্দর, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বহুদিক দিয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সম্ভাবনার দ্বারগুলো খুলছে না যুগ যুগ ধরে। উদয় হচ্ছে না অঞ্চলটিতে নতুন প্রভাতের। বৈষম্য, অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের চপেটাঘাতে দগ্ধ এই অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নয়ন হচ্ছে না। উপরন্তু সার্বিক অবস্থা হয়েছে শোচনীয় থেকে শোচনীয়তর। সরকার আসে সরকার যায়, ঘটে শুধু প্রতিশ্রæতির অপমৃত্যু। পরিলক্ষিত হয় কথায় ও কাজে চূড়ান্ত অমিল। তার সঙ্গে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, চোখের সামনে কিশোর যুবকদের অস্ত্রের মহড়া, ঠুনকো বিষয়ে রক্তপাত, মাদকের ভয়াবহতা, রাজনৈতিক মাতব্বরদের দাপট, বাগড়ম্বর, গোষ্ঠীদ্ব›দ্ব, উন্নয়নের অর্থ ভাগবাটোয়ারা ও নানা লুটপাটের কাহিনী। এসব দেখে শুনে রীতিমতো কাহিল হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সুন্দর একটা সমাজ গঠনে কোথায় যেন গলদ থেকেই যাচ্ছে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির যেমন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দরিদ্র্যদের ভাগ্যের পরিবর্তনের লক্ষণ না দেখে মনোকষ্টে ভোগেন আমজনতা। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই। চিকিৎসা সেবা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্য মোটা হলেও জনস্বাস্থ্য সেবার মান বাড়েনি। দলীয় একশ্রেণীর ডাক্তার দায়িত্ব পালন করছেন নামকাওয়াস্তে। সন্ত্রাসীদের লাগামহীন অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাকাÐের ঘটনা বেড়েছে। নির্বিঘেœ পথচলা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় চলে চাঁদাবাজির মহোৎসব। সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি। সবচেয়ে এই অঞ্চলের মানুষের মনোকষ্টটা হলো অঞ্চলটির কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির বিরাট সম্ভাবনাকে যথাযথ কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টি বরাবরই অনুপস্থিত থাকছে। একটু নজর দিলেই কিন্তু পাল্টে যেত গোটা অঞ্চলের চেহারা। সেই কাজটি অতীতে হয়নি, বর্তমানেও হচ্ছে না, ভবিষ্যতে হবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। নতুন বছরের নানা প্রত্যাশা, অতীতের প্রাপ্তি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্ভাবনাময় অঞ্চলটির বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের আলাপচারিতায় এসব বের হয়ে এসেছে। তবে তারা বলেছেন অঞ্চলটিতে অনেক কিছুর সূচনা হয়েছে, পদ্মা সেতুর কাজ এগুচ্ছে, নির্মাণ হয়েছে শেখ হাসিনা আইটি পার্কসহ বেশকিছু প্রজেক্ট-যা পুরোপুরি চালু হওয়ার পর অনেক পরিবর্তন হবে। কিন্তু গোটা অঞ্চলের চেহারা অনেক আগেই পাল্টানোর সুযোগ ছিল, যা রীতিমতো অবহেলা করা হয়েছে। প্রায়ই অনেকে বলাবলি করে থাকেন অঞ্চলটির সম্ভাবনাগুলো যথাযথ কাজে লাগানো হলে রচিত হতো বিরাট সমৃদ্ধির সোপান।
যশোর ও খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজসেবী ও বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মাানুষের কথা, সরকার সম্ভাবনাগুলো নির্ণয় করে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেবে, এটি তাদের প্রথম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সরকার গেছে, সরকার এসেছে, দীর্ঘদিনে কেউই সেই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আন্তরিক বা যত্মবান হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রতিবারই জনপ্রত্যাশা হয় অতীতে বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে উপেক্ষিত অঞ্চলটির ক্ষতচিহ্ন এবার মুছে যাবে। চাঙ্গা হবে গ্রামীণ অর্থনীতি। ঘটবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে গতি সৃষ্টি হবে। আমুল পরিবর্তন ঘটে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। সেসব আশা দুরাশায় পরিণত হয়। কৃষি বিশেষজ্ঞ, শিল্পোদ্যোক্তা ও নাগরিক নেতৃবৃন্দ এবং সচেতন ও পর্যবেক্ষক মহলের পরামর্শ ছিল জনপ্রত্যাশা পূরণে ‘ডু ইট নাও’। কিন্তু বাস্তবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ‘সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়’ কথাটি মাথায় রেখে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেননি। ক্ষমতার পালাবদলে শুধু প্রত্যাশা জাগে, কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসী প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির কি পেলাম আর কি পেলাম না হিসাব কষে যোগবিয়োগের ফলাফল পান শূন্য। সব সরকার জেলাভিত্তিক গতানুগতিক উন্নয়ন ও কয়েকটি এলাকায় টুকিটাকি কাজ ছাড়া বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে দৃষ্টান্তস্থাপনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই করেনি বলা যায়। নিত্যনতুন কৌশলে কোথাও টেন্ডারবাজি আবার কোথাও ‘নেগোশিয়েশনের’ নামে নামকাওয়াস্তে কাজ দেখিয়ে সরকারী অর্থের ভাগবাটোয়ারা হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। নদ-নদী সংস্কার, পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ, দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলা ও নৌবন্দর নওয়াপাড়ার উন্নয়ন, বন্ধ শিল্প কল-কারখানাগুলো পুরোদমে চালু ও কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠা হয়নি। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, কাজকর্মের অনুকূল পরিবেশ, সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্টসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন চায় মূলত। কিন্তু এসব হচ্ছে না। বরং লাখ কিংবা কোটি টাকার রাস্তা নির্মাণের ৬ মাস বা একবছরের মাথায় একটা বর্ষা মৌসুম পার হয় না, ভেঙ্গেচুরে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে যাতায়াতের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিষয় রয়েছে যা করা হয় একরকম জোড়াতালি দিয়ে। বহুদিনের একটা সমস্যার সমাধান করতে পারেনি কেউ। এটি হচ্ছে যশোর ও খুলনার দুঃখ ভবদহ ও কপোতাক্ষ নদ সমস্যা। যা সরকারী অর্থ লোপাটের কারখানা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ভবদহের লিংক নদী এবং কপোতাক্ষ নদ খনন, ড্রেজিং, টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) এবং ভেড়িবাঁধ নির্মাণসহ পানি নিষ্কাশনের নামে বছরের পর বছর জনদাবির মুখে নেয়া হয় নানামুখী সরকারী প্রকল্প। এলাকার জনপ্রতিনিধি, ভুক্তভোগী মহলসহ ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ নামকাওয়াস্তে কাজ দেখিয়ে চলে শুধু লুটপাট। এ অভিযোগ বিস্তর।
বিভিন্ন দিক দিয়ে অঞ্চলটিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। অঞ্চল থেকে নির্মূল হয়নি সন্ত্রাস। বরং বহুলাংশে বেড়েছে। অস্ত্রবাজ চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের দাপট আর এখন নেই কিন্তু উঠতি বয়সের সন্ত্রাসী, প্রতিটি গ্রাম পাড়া মহল্লায় রয়েছে তাদের বিচরণ, অন্যান্য অপরাধীদের পাশাপাশি পলিটিক্যাল ক্যাডার ও মাস্তানদের দাপট বেড়েছে অতিমাত্রায়। মাদক ও অস্ত্রের উৎসমুখ বন্ধ করা যায়নি।। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নামটি উচ্চারিত হলেই অতীতের মতোই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সন্ত্রাস ছাড়াও অনিয়ম, অব্যবস্থা ও সম্ভাবনার অপমৃত্যুর দৃশ্য। সরল অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে অঞ্চলটি সবদিক দিয়ে অত্যন্ত লাভজনক। উন্নয়নের জন্য প্রতিটি আসন এলাকার এমপিরা বেশী ভূমিকা রাখার কথা। ব্যর্থতার দায়ভার শুধু সরকারের ওপর চাপালে চলবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার পর এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের ঠেলাঠেলি, গুতোগুতি, দ্ব›দ্ব, ফ্যাসাদ ও নানা বিষয়ে টানাহেঁচড়া উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সরকারী দলের নেতাদের অধিকাংশই যে যার মতো একলাচলো নীতি আঁকড়ে ধরে আখের গোছানোর তালে ব্যতিব্যস্ত। একথা তো ঠিক যে, দলমত নির্বিশেষে এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে মনোনিবেশ না করলে সত্যিকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তার মন্ত্রী ও এমপিদের মুখে বড় বড় কথা শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে এলাকার উন্নয়নে তার প্রতিফলন ঘটে না ততটা। যদিও কোন কোন মন্ত্রী এমপি এর ব্যতিক্রম। তবে অধিকাংশই ক্ষমতা পেয়ে দায়িত্ব পালনের কথা ভুলে যান। জনকল্যাণে ভূমিকা রাখেন না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহলের মতে, একটু পেছনে দেখলে এই অঞ্চলের নির্বাচনী ভাবনা থেকে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা প্রাধান্য দেয় অবহেলিত জনপদের সার্বিক উন্নয়ন। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ অঞ্চলটির বিরাট সম্ভাবনাকে সত্যিকারার্থে কাজে লাগানোর প্রত্যাশা নিয়েই অতীতে যেসব সংসদ সদস্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেননি, তাদের ভোটবাক্সে প্রতিবাদের চিহ্ন একে দেন। নতুন জনপ্রতিনিধি ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তার প্রতিদান পাননি মোটেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসী। এ অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের কথা, সাদা সোনা চিংড়ি, রেণু পোনা, রজনীগন্ধা, শাক-সবজি, ধান, গম, আলু, কলা, পান, আখ, তেল ও ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদনে রয়েছে অঞ্চলটির রেকর্ড। এ অঞ্চলে কৃষি পণ্যকে ঘিরে কৃষি শিল্প নগরী গড়ে তোলার দাবি বহুদিনের। সেই দাবি পূরণে আশ্বাস দেয়া হলেও কখনোই উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সোনালী আঁশকে ঘিরে স্বর্ণযুগ ফেরার প্রত্যাশা এখন ক্ষীণ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদের পাড়ে যশোর-খুলনায় তিলে তিলে গড়ে ওঠে বহু শিল্প কলকরাখানা। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, খুলনা টেক্সটাইল মিল, দৌলতপুর জুট মিল, কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ সুগার মিল, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ (জেজেআই), বেঙ্গল টেক্সটাইল মিল, সাতক্ষীরার সুন্দরবন টেক্সটাইল মিল, খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিল, প্লাটিনাম জুট মিল ও স্টার জুট মিল, খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী ও কটন মিলসহ অনেক শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠে। সম্ভাবনাময় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো একপর্যায়ে অস্তিত্ব সংকটে, আবার অনেক বন্ধ হয়ে গেছে। কাঁচামাল হিসেবে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সোনালী আঁশ পাটকে ঘিরেই একসময় গড়ে উঠেছিল অসংখ্য সরকারী ও বেসরকারী পাটকল। যার সিংহভাগেই ধস নেমে আসে। অথচ পাটকলগুলো প্রতিষ্ঠার সময়কালে অঞ্চলটির ছিল ‘স্বর্ণযুগ’। উৎপাদিত পাট স্থানীয় পাটকলের চাহিদা মিটানোর পরও রফতানী হতো বিপুল পরিমাণ পাট। তাতে আসতো বৈদেশিক মুদ্রা। শুধু তাই নয়, গোটা অঞ্চলের টেক্সটাইল, জুট, ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল, খাদ্যজাত, কাঠচেরাই, ঢালাই, ফ্লাওয়ার, অটো ফিড, ফার্টিলাইজার, সিমেন্ট, রড, গার্মেন্টস, বলপেন তৈরী, বিস্কুট কারখানা, তারকাটা, চিরুনী ও সাবান কারখানাসহ বহুমুখী শিল্প কলকারখানা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এসব বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগী হলেও একপর্যায়ে তা থেমে যায়। কেন থেমে গেছে, স্বর্ণযুগ পুনরুদ্ধারে অনিশ্চয়তা, সোনালী আঁশ নিয়ে বিশৃঙ্খলা, কৃষকরা মূল্য না পাওয়া, আর কেনই বা অঞ্চলটির উন্নয়নে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে না তার জবাব মিলছে না।
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনকে ঘিরে সেখানকার খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের আশা ছিল। জীবন-জীবিকার সুরক্ষা হবে, ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে-এমন আনন্দে আত্মহারা ছিলেন বহু মানুষ। কিন্তু সেটি হয়নি। পদে পদে নানা সমস্যা আর জলদস্যু ও বনদস্যুদের দাপটে জীবিকার সন্ধানের মানুষের জীবন ওষ্টাগত। পাশাপাশি অভিন্ন নদীর পানিবন্ধকতায় বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন হুমকির মুখে। যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়নি। সুন্দরবনে ট্যুরিস্টদের যাতায়াত আরো বাড়নো যায়নি। সুন্দরবন দেশী ও বিদেশী সবার কাছে ‘বিউটিফুল এরিয়া’ হিসেবে পরিচিত হলেও তাদের আকৃষ্ট করার কোন জোরদার পদক্ষেপ নেই। অর্থনৈতিক বিশারদরা বলেছেন, সরকারীভাবে যথাযথ দৃষ্টি ও সকল সেক্টরের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়া হলে খুব সহজেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ গোটা অঞ্চলে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতির চেহারা ঈর্শণীয় পর্যায়ে পৌঁছে যেত। কিন্তু বাস্তবে বরাবরের মতোই অনুপস্থিত রয়েছে। সুত্রমতে, শুধু একটি শিল্প নয়, গোটা অঞ্চলে কোথায় কি আছে, কোন শিল্পের কি অবস্থা-তার সরেজমিন খোঁজ নেয়া হয়নি।
সচেতন ও পর্যবেক্ষক মহল থেকে বলা হয়েছে, সম্ভ^াবনাময় অঞ্চল হলেও গ্রামীণ অর্থনীতি মোটেও চাঙ্গা হয়নি। বরং দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত দিন এনে দিন আনা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মতোই কৃষকরাও কষ্টের ফসলের ন্যায্য ও উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় ক্রমাগত তাদের অভাব আষ্টেপৃষ্টে জেঁকে বসছে। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের মতে, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল ও মাগুরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দশ জেলায় অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি মূলত কৃষকদের হাতে। বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনে রয়েছে রেকর্ড। সে কারণে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার দিকে সরকারকে জোর দিতে হবে-এমন পরামর্শ দেয়া হয়েছে বহুবার। এ অঞ্চলের বিশিষ্ট নাগরিকদের কথা, অঞ্চলটি সব দিক থেকেই সম্ভাবনাময়। কিন্তু সরকার কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী করতে পারছে না। মৃত শিল্পনগরীতে জীবিত করা এবং অন্ধকারকে আলোকিত করার মহাপরিকল্পনায় শুধু যশোর-খুলনার শিল্প অঞ্চলে নয়, গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও প্রত্যাশা পুরণ হয়নি।
গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণশক্তি কৃষি। কৃষির গুনগত পরিবর্তন, আধুনিকায়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারী ভুমিকা কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কাঠামো মজবুত ও পরিশ্রমী কৃষকরা ক্রমাগত স্বচ্ছলতার সোপানে দ্রæত পাল্টে যেত নিঃসন্দেহে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায় ভূমিহীন, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাধ্যম ও বড় চাষীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১৪ লাখ ১২ হাজার ৬৫ হেক্টর। এ অঞ্চলে ৭হাজার ৮৩০টি গ্রাম রয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই গড়ে প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষনা করে পরিকল্পিতভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে আরো সমৃদ্ধ হত। সরকারের খাস জমি ভুমিহীনদের মাঝে নয়, প্রভাবশালী নেতা ও তাদের চালাচামুন্ডাদের মাঝে বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রভাবশালী নেতারা কৌশলে দখল করছে ও দীর্ঘমেয়াদী লীজ নিচ্ছে সরকারী জমি। গ্রামের সিংহভাগ মহিলা সংসারের অভিভাবকের বিভিন্ন আয়ের পাশাপাশি হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী হবার পথ সুগম করার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণ পাচ্ছেন না। কাঁথা সেলাইসহ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পেও গতি সৃষ্টি হচ্ছে না নানা কারণে। যশোরসহ এ অঞ্চলের খেজুরের গুড় ও পাটালি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই শিল্পটিও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নদী বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ফারাক্কা আর মিনি ফারাক্কার ধাক্কায় মরণদশা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর। একসময়ের স্রোতস্বিনী ও প্রমত্তা নদ-নদী প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলের প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নির্ভরশীল গড়াই, মাথাভাঙ্গা, আপার ভৈরব, কুমার, বেতাই, চিত্রা, ইছামতি, মধুমতি, ফটকি, কপোতাক্ষ ও নবগঙ্গাসহ পদ্মার শাখা প্রশাখা এবং অভিন্ন নদ-নদীর উপর। কার্যত প্রায় সব নদ-নদী মারা যাচ্ছে। পানির ন্যায্যপ্রাপ্তির ব্যাপারে দেনদরবার নেই। দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট) মৃতপ্রায়। দীর্ঘদিন ধরেই শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদীর দুইপাড় হয়ে গেছে দখল। দখলমুক্ত করা হয়নি। ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-গর্ভস্থ পানি সংকট গোটা অঞ্চলের কৃষি, শিল্প, বনজ, মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। সেজন্য নদ-নদী খনন ও সংস্কার অত্যন্ত জরুরী ছিল। সেটিও করা হয়নি। এছাড়া অনেক সমস্যার আবর্তে বেহালদশা সৃষ্টি হওয়ায় নিত্যসঙ্গী হয় কান্না। আর সেই বুকফাটা কান্না থামানোর উদ্যোগ অনুপস্থিত রয়েই গেছে। সেজন্য নতুন বছরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিত করে পরিকল্পনামাফিক উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে একরকম তাগিদ দেওয়া হয়েছে সরকারকে।
লেখক : বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক ইনকিলাব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন