শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

২০২৩: আর্থ-রাজনীতিতে অশনি সংকেত

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে কলম ধরতে গেলেই দুটি বিষয় অবধারিতভাবে এসে পড়ে। একটি হলো গেল বছরের সালতামামি। এর মধ্যে থাকে গেল বছরে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বিদেশনীতিতে কী কী ইতিবাচক বা নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। আর নতুন বছর সম্পর্কে লিখতে গেলে ভবিষ্যতের কথাই বলতে হবে। অর্থাৎ নতুন বছরে ঐ তিনটি ফ্রন্টে কী কী ঘটতে পারে সে সম্পর্কে পূর্বাভাস বা ভবিষ্যদ্বানী করা। আমরা নতুন বছর সম্পর্কে দ্বিতীয় পর্বে বলবো। প্রথমে গেল বছর। গেল বছরে রাজনৈতিক ফ্রন্টে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং বহুল আলোচিত বিষয় হলো রাজনীতির অঙ্গনে বিএনপির প্রবল উত্থান। এ সম্পর্কে পরে কথা বলবো। তার আগে অর্থনীতি।

রাজনীতিকে টপকে অর্থনীতি আগে আসছে কেন? কারণ, অর্থনীতি এমন অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে যে এ বিষয়ে স্বয়ং হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলেছেন যে, অর্থনীতিতে বিশাল বিশাল দুর্নীতি হচ্ছে। দুদককে ভর্ৎসনা করে বিচারপতি বলেছেন, আপনারা কিছুই করছেন না। তাহলে আমরা কি শুধুই চেয়ে চেয়ে দেখবো? অর্থনীতির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অনেক বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ এবং প্রতিষ্ঠান আমাদের অর্থনীতিকে ‘লুটেরা অর্থনীতি’ বলছেন। আমাদের অর্থনীতিকে এত বড় অপবাদ দিলেন তারা, সেটি কি নেহায়েত পলিটিক্যাল রেটরিক হিসেবে দিলেন? তাদের এত বড় পর্যবেক্ষণের পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। কী সেই সমস্ত কারণ? আসুন, আমরা এগুলো একটু খুঁজে দেখি। এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তারপর থেকে ১৪ বছর একটানা ক্ষমতায় আছে। এই ১৪ বছরে যে লুটপাট হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান নিম্নরূপ:

(১) ২০১০ সালে শেয়ার বাজার কেলেংকারি ২২ হাজার কোটি টাকা। (২) ২০১১ সালে সোনালী ব্যাংক কেলেংকারি ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। (৩) ২০১২ সালে বেসিক ব্যাংক লুটপাট ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। (৪) ২০১৩ সালে জনতা ব্যাংক কেলেংকারি ৩ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। (৫) ২০১৫ সালে পুনরায় জনতা ব্যাংক কেলেংকারি ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। (৬) ২০১৬ সালে ফার্মার্স ব্যাংক কেলেংকারি ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। (৭) ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ চুরি ৮৪৬ কোটি টাকা। (৮) ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনা কেলেংকারি ৩৩০ কেজি। (৯) ২০১৯ সালে পিকে হালদার জালিয়াতি ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। (১০) ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংক ঋণ কেলেংকারি ৩০ হাজার কোটি টাকা। মোট কেলেংকারি হয়েছে ৭৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এর সাথে যুক্ত ৩৩০ কেজি সোনা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ভরি সোনার দাম ৮৬ হাজার টাকা ধরলে ৩৩০ কেজি সোনার দাম প্রায় ২৪৪ কোটি টাকা।

আলোচ্য সময়ে অন্তত ৭টি ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে। এসব লুটপাটের প্রধান নায়ক হলেন সেই বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপ। ৭টি ব্যাংকে যারা লুটপাট করেছেন তাদের ৬ জনের নাম ও পরিচয় পত্রপত্রিকাসহ সামাজিক মাধ্যমেও এসেছে। স্থান সংকুলান হবে না বলে আমরা তাদের নামধাম এবং পরিচয় দিচ্ছি না। তবে যেসব ব্যাংকে এসব অনিয়ম এবং দুর্নীতি হয়েছে সেগুলি হলো (১) ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, (২) ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড, (৩) কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, (৪) আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, (৫) গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, (৬) স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং (৭) ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিডেট।

॥দুই॥
এগুলো তো গেল ব্যাংকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কথা। এছাড়া এই ১৪ বছরে অন্তত ৮ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এ সম্পর্কেও পত্র পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। কয়েক জন পাচারকারীর নাম এখানে উল্লেখ করা হলো। পিকে হালদার পাচারে করেছে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। শুধাংশু শেখর ভদ্র পাচার করেছে ৫০০ কোটি টাকা। এস কে সুর পাচার করেছে ১ হাজার কোটি টাকা। ওসি প্রদীপ কুমার পাচার করেছে ৩০০ কোটি টাকা।

ইকোনোমিক সেক্টরের অনিয়ম ও কেলেংকারির বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। শুধু আমরা উল্লেখযোগ্য পয়েন্টগুলো উল্লেখ করছি। সরকারি হিসাব থেকেই জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এটি মানুষের কল্পনার বাইরে। প্রিয় পাঠক, আপনার সম্প্রতি গণমাধ্যমে পড়েছেন যে, মাত্র ২৫ হাজার টাকা ঋণ খেলাপী হওয়ায় গরিব কৃষককে জেল খাটতে হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রশ্ন করেছে যে ২৫ হাজার টাকা ঋণ খেলাপী হওয়ার জন্য যদি একজন কৃষককে জেলে যেতে হয় তাহলে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপী হয়েছে তাদের একজনকেও জেলে যেতে হচ্ছে না কেন? এটি শুধু আমাদের প্রশ্ন নয়, স্বয়ং মহামান্য হাইকোর্টও সেই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি দুদকের আইনজীবীকে সওয়াল জওয়াব কালে বলেছেন, অপনাদের যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে পারলে ঋণ খেলাপী অন্তত একজন রাঘব বোয়ালকেও জেলে পাঠান।

অর্থনীতিতে লুণ্ঠন সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলবো না। সিপিডি, অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরসহ অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, দেশে আজ জিনিসপত্রের দাম যে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে সেটির প্রধান কারণ অর্থনৈতিক নয়। প্রধান কারণ সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এবং কল্পনাতীত লুণ্ঠন।

অর্থনীতি নিয়ে আর কত লিখবো। ৩০ ডিসেম্বর শুক্রবার এক শ্রেণীর পত্রপত্রিকায় এই মর্মে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, এখন প্রতি ডলারের বিনিয়ম হার ১০৫ টাকা। ব্যাংকগুলো অবশ্য দিচ্ছে ১০০ টাকা। ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাংকে ডলার জমা না দিয়ে বাইরের মার্কেটে বিক্রি করছেন। আর বিদেশ থেকেও ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশি মুদ্রা আসছে কম। সেগুলোর অনেকাংশ হুন্ডিতে আসছে। অর্থনীতির বেহাল দশা সম্পর্কে গত শুক্রবার ৩০ ডিসেম্বর ইংরেজি ডেইলি স্টার শিরোনাম দিয়েছে ঙঁঃ ড়ভ ঃযব ভৎুরহম ঢ়ধহ রহঃড় ঃযব ভরৎব. অর্থাৎ উত্তপ্ত কড়াই থেকে অর্থনীতিকে জ¦লন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে। মাত্র ৮ মাস আগে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। বৃহস্পতিবার ২৯ ডিসেম্বর সেই রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ রিজার্ভ কমেছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। ১৫ বিলিয়ন ডলার সোজা কথা নয়। ১৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ হলো ১৫০০ কোটি ডলার। এখানে একটি ছোট্ট প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই। বিএনপি এবং বিরোধী দলকে দমন করার জন্য সমগ্র রাষ্ট্রশক্তি এবং সমগ্র আওয়ামী শক্তি যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেই সম্মিলিত শক্তির একটি অংশও যদি এসব লুণ্ঠন, পাচার এবং ঋণ খেলাপী দমন তথা এসব অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুরুদণ্ড প্রদানে ব্যয় করা হতো, তাহলে মেট্রোরেল ও পদ্মাসেতু নির্মাণে টাকার কোনো অভাব পড়তো না।

এসব সেতু বা মেট্রোরেল নির্মাণের কথা কি বলবো? প্রতিটি বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে প্রথমে যে ব্যয় ধরা হয়, তারপর তার সমাপ্তির নির্ধারিত সময় বছরের পর বছর বাড়ানো হয়। ফলে ব্যয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। যেমন পদ্মা সেতু। প্রথামকি ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। শেষ হলো ৩২ হাজার কোটি টাকায়। শুক্রবারের পত্রিকায় দেখলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, টাকা পয়সা কামাই করার জন্য বড় বড় প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ করার সময় ইচ্ছা করে বাড়ানো হয়।

॥ তিন ॥
লেখাটি বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই বাকি কথাগুলো খুব সংক্ষেপ করবো। আসছি বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের ওপর মার্কিন স্যাংশন আসে। তার কয়েক দিন আগে আমেরিকা প্রায় ১০০টি দেশ নিয়ে গণতন্ত্র সম্মেলন করে। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। কারণ, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এসব নিয়ে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, কানাডা, অস্ট্রোলিয়া অর্থাৎ মার্কিনপন্থী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বিশাল দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই দূরত্বের কারণেই হোক বা যেকোনো কারণেই হোক, সরকার চীন এবং রাশিয়ার দিকে হেলে পড়েছে। প্রথম থেকেই এই সরকারকে অন্যেরা বলতো প্রো-ইন্ডিয়ান অর্থাৎ ভারতপন্থী। তবে চীন ও রাশিয়ার সাথে নৈকট্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের আধিপত্য কিঞ্চিৎ হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি পশ্চিমা দেশের স্থান কি পূরণ করতে পারবে চীন-রাশিয়া? যে মেট্রোরেল নিয়ে আজ সরকারের এত হৈচৈ তার অর্থ জোগান দিয়েছে তো জাইকা, অর্থাৎ একটি জাপানি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বৃহত্তম আয় আসে গার্মেন্ট থেকে। আর এই গার্মেন্টের সবচেয়ে বড় খরিদ্দার হলো আমেরিকা। আমেরিকাকে চটিয়ে বাংলাদেশ কতদূর লাভবান হবে সেটি বলবে সময়।

॥ চার ॥
এবার আসছি রাজনীতি নিয়ে। যখন এই লেখাটি লিখছি তখন ৩০ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুর। বিএনপির গণ মিছিল শুরু হবে তাদের নয়াপল্টন অফিস থেকে বিকাল ৩.০০ টায়। এই গণমিছিল হবে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি টার্নিং পয়েন্ট। কারণ, ৩০ ডিসেম্বর থেকেই শুরু হচ্ছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি পালন। এর আগে সারা দেশে ১০টি বিভাগীয় মহাসমাবেশের প্রতিটিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। তারা টিকে আছে পুলিশ-র‌্যাবসহ রাষ্ট্রশক্তি এবং আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনীর ওপর। অন্যদিকে ওইসব মহাসমাবেশের মাধ্যমে বিএনপির ঘটেছে প্রবল উত্থান। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গোলাপবাগের মহাসমাবেশ থেকে বিএনপি ঘোষণা করেছে, এই গণমিছিল থেকে শুরু হবে তাদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলনের সূচনা। আর এই দ্বিতীয় দফা আন্দোলন হবে এক দফার আন্দোলন। সেটি হলো সরকারের পদত্যাগ বা সরকারের পতন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও রেখে ঢেকে কথা বলেনি। তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে, তারা রাজপথেই বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলকে মোকাবেলা করবে। এখন আওয়ামী লীগ যদি ডান্ডার জোরে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলকে ঠান্ডা করতে পারে তাহলে রাজনীতি বর্তমান সালে বিশেষ এক ধরনের রূপ নেবে। আর যদি জনগণ তাদের মোকাবেলা করে তাহলে আন্দোলন ভিন্ন রূপ নেবে। বিএনপির সর্ব শ্রেণীর নেতা বলছেন, তারা গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে চান। সেই গণঅভ্যুত্থান কতদূর নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ থাকবে সেটি দেখা যাবে আগামী দিনগুলিতে। আওয়ামী লীগ বিএনপির পদত্যাগের দাবি সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে বিএনপি তথা বিরোধী দলসমূহ কীভাবে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন