সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অর্ধ শতাধিক মানুষের মৃত্যু আর মীরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাস আরোহী ১৩ জন শিক্ষার্থীর প্রাণহানীর ঘটনা গেল বছরে চট্টগ্রামের আলোচিত ট্রাজেডি। বছরজুড়েই ঘটেছে নানা অঘটন-দুর্ঘটনা, তাতে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। তবে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আলোচিত হয় সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর বিস্ফোরণ। ওই দুর্ঘটনায় ৪২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক সাথে ১৩ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। তারা আগুন নেভাতে গিয়ে নিজেদের জীবন দিয়েছেন। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান- এই বেসরকারি ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমদানি-রফতানিতে কিছুটা হলেও ইমেজ সঙ্কট হয়। ডিপোটি বন্ধ হয়ে গেলে চট্টগ্রামের অন্য ডিপোতে পণ্যবাহী কন্টেইনারের চাপ পড়ে।
গত ৪ জুন দিবাগত রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে দেশি-বিদেশি মালিকানাধীন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। এরপর সেখানে কয়েক দফা বিস্ফোরণ ঘটে। ডিপোতে থাকা রাসায়নিকের কারণে ছড়িয়ে পড়া ওই আগুন ৮৬ ঘণ্টা পর বিভিন্ন বাহিনীর চেষ্টায় নেভানো হয়। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে প্রথমে ৪১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া এবং ডিপো পরিষ্কারের সময় বেশ কিছু মানবদেহের খন্ডিত অংশ উদ্ধারের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫১ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। আহত হন প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। অনেকে পঙ্গু হয়ে যান, দৃষ্টি শক্তি হারান কেউ কেউ। আগুন আর সেই সাথে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অনেকের দেহ পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। কারো লাশ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পরে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের পরিচয় সনাক্ত করা হয়। নিহত ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কয়েক জনের লাশও পাওয়া যায়নি।
আগুন থেকে শুরু হওয়া বিস্ফোরণে শত কোটি টাকার মালামাল বিনষ্ট হয়। রীতিমত ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয় ডিপো এলাকা। এই দুর্ঘটনা তদন্তে আটটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি অগ্নিকাণ্ডের জন্য ডিপোতে অরক্ষিত অবস্থায় রাসায়নিক মজুদ ও ডিপো ব্যবস্থাপনায় গলদ ছিল বলে জানায়। ডিপো কর্তৃপক্ষ হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়। একই সাথে ডিপো স্বাভাবিক ও নিরাপদ করার উদ্যোগ নেয়। দুর্ঘটনার চার মাস পর গত সেপ্টেম্বর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বিএম কন্টেইনার ডিপোটিকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন আঙ্গিকে সংস্কার শুরু করে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অবকাঠামো সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। পুরোপুরি সংস্কারের পর জানুয়ারিতে নতুনভাবে পুরোপুরি ডিপো চালুর সিদ্ধান্ত হয়।
দুর্ঘটনার পর থেকে সব ধরনের কন্টেইনার ব্যবস্থাপনা বন্ধ ছিল ওই ডিপোতে। গত ২২ আগস্ট শুধুমাত্র খালি কন্টেইনার সংরক্ষণ ও হ্যান্ডলিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয় ডিপো কর্তৃপক্ষকে। তবে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি পণ্যবাহী কন্টেইনার ব্যবস্থাপনা বন্ধ ছিল। ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ৯টি শর্তে গত ২৬ অক্টোবর থেকে রফতানি পোশাকের কন্টেইনার ব্যবস্থাপনার অনুমতি দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পরে সব ধরনের আমদানি-রফতানি কন্টেইনার ব্যবস্থাপনার অনুমতি পায় তারা। স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ২৪ একর জায়গার উপর নির্মিত বিএম ডিপো সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রায় ৬০ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। আমদানি ও খালি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ২২ হাজার ও ৪০ হাজার টিইইউএস। বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার পর দেশে বেসরকারি ডিপো পরিচালনায় সুস্পষ্ট নীতিমালার বিষয়টি সামনে আসে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর নীতিমালা প্রনয়ণের উদ্যোগ নেয়। তবে এখনও তা বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। তবে ওই দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রামের আরও ১৮টি ডিপোতে অগ্নি নিরাপত্তার পাশাপাশি সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
১৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু : বিএম কন্টেইনার ডিপো ট্রাজেডির জের না কাটতেই ২৯ জুলাই মীরসরাই রেল ক্রসিং এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসে থাকা ১৩ জন শিক্ষার্থীর প্রাণ যায়। হাটহাজারীর জুগীরহাট আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের ছাত্র ও শিক্ষকেরা মাইক্রোবাসে বেড়াতে বের হন। তারা মীরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণা ভ্রমণ করে ফিরছিলেন। মীরসরাই রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের সঙ্গে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের ধাক্কা লাগে। ধাক্কা লাগার পর ট্রেনটি মাইক্রোবাসটিকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে টেনে নিয়ে যায়। মাইক্রোবাসটি ধুমড়েমুচড়ে যায়। নিমিষেই আন্দন বিষাদে পরিনত হয়। আনন্দ ভ্রমনে গিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়া শিক্ষার্থীরা ফিরেন লাশ হয়ে। ঘটনাস্থলে ১১ জনের মৃত্যু হয়। তাদের ১০ জনই হাটহাজারীর জুগিরহাট আর অ্যান্ড জে প্রাইভেট কেয়ার কোচিং সেন্টারের ছাত্র-শিক্ষক। বাড়ি হাটহাজারীর আমানবাজার খন্দকিয়া গ্রামে। পরে আহত আরো দুই জনের মৃত্যু হয়। হতাহতরা হলেন- সেন্টারের শিক্ষক মোস্তফা মাসুদ রাকিব (২৮), জিয়াউল হক সজীব (২৮), রিদোয়ান চৌধুরী (৩১) ও ওয়াহিদুল আলম জিসান (৩২), শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার্থী হিশাম (১৮), মো. আয়াত (১৮), মো. মারুফ (১৭), মো. তাসফির (১৮) ও মো. হাসান (১৯), মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা (৩৫), তাছমীর পাভেল (১৬), মো. মাহিম (১৮), মো. সৈকত (১৮), তানভীর হাসান হৃদয় (১৮), মো. ইমন (১৯) ও মাইক্রোবাসের চালকের সহকারী তৌকিদ ইবনে শাওন (২০)। এই দুর্ঘটনায় হাটহাজারীর খন্দকিয়া ও চিকনদন্ডীসহ আশপাশের গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া। নিহত শিক্ষার্থীদের স্বজনেরা এখন সেই শোক ভুলতে পারেননি। নীরবে অশ্রু ফেলছেন অনেকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন