আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। জলবায়ুর রাজ্যে সঙ্কট বিরাজ করছে। এর ফলে বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। ভয়াবহ আকারে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। চরম-ভাবাপন্ন, এলোমেলো, রুক্ষ-রুদ্র, খেয়ালি ও বৈরী হয়ে উঠেছে আবহাওয়া-জলবায়ু এবং পরিবেশ-প্রকৃতি। জলবায়ু ও প্রকৃতি চিরচেনা রূপ বৈশিষ্ট্য এখন হারিয়ে ফেলছে। এতে করে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে ক্রমেই বিপর্যস্ত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিপন্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের ধারায় বিদায়ী ২০১৭ সাল ছিল গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্যোগবহুল। বছরজুড়ে বেড়ে চলে বৃষ্টিপাত। বৃষ্টিপাতে ব্যাপক অসঙ্গতিও পরিলক্ষিত হয়। ঘোর বর্ষায় যেমন বর্ষণ ছিল তেমনি বর্ষার আগে ও পরে (প্রাক-বর্ষা ও বর্ষাত্তোর) সময়েও টানা ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। অথচ দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে বৃষ্টিপাত হয় স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে।
গেল বছরটিতে অতিবৃষ্টির প্রবণতা ছিল বাংলাদেশ এবং পাশ্ববর্তী ভারত, নেপাল, তিব্বত চীনসহ হিমালয় অঞ্চলজুড়ে। তাছাড়া হঠাৎ করে সীমিত এলাকায় ভারী বর্ষণ লক্ষ করা গেছে। ২০১৭ সালে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার আরও লক্ষণীয় দিকগুলো ছিলÑ বছরের প্রায় গোড়া থেকেই ভ্যাপসা গরম ও গুমোট অবস্থা, অনাবৃষ্টি ও খরা, আবার অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল, পাহাড়-টিলার ভয়াবহ ধস, হাওড় অঞ্চলে ভারতের উজানের ঢলে হঠাৎ বন্যা, চীন-নেপাল-ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢল-বানের তোড়ে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, সামুদ্রিক জোয়ার, ঘন ঘন লঘুচাপ-নি¤œচাপ সৃষ্টি, টর্নেডো, কালবৈশাখী, বজ্রপাতের মাত্রা ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি ইত্যাদি।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমাগত দুর্যোগপূর্ণ ও স্বাভাবিকের বিপরীতমুখী আবহাওয়ার প্রভাবে সমগ্র দেশের কৃষি-খামার, ফল-ফসল, জনস্বাস্থ্য, জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। মানবসম্পদের গড় উৎপাদনশীলতা কমছে। উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ফসল ফলাতে গিয়ে দুর্যোগের ধাক্কা আর বাড়তি খরচের চাপে কৃষক পুষিয়ে উঠতে পারছে না। ভারতে মারণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। সেই সঙ্গে জলবায়ুর বৈরী আচরণে অনাবৃষ্টি ও খরার প্রভাব যোগ হয়েছে। এর ফলে শুকিয়ে মরুময়তার দিকেই ধাবিত হচ্ছে বরেন্দ্র জনপদসহ সমৃদ্ধ উত্তরাঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে বাংলাদেশের প্রাক-প্রস্তুতি ও সতর্কতায় রয়েছে ঘাটতি, সমন্বয়হীনতা। জলবায়ু ও পরিবেশ সুরক্ষা, উন্নয়ন খাতে বিশ্বফোরামে অবস্থান এখনও দুর্বলই রয়ে গেছে।
বাড়ছে দুর্যোগ-জনদুর্ভোগ
বিদায়ী ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দফায় দফায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। দুর্যোগের প্রধান দিক ছিল বন্যা। এপ্রিল মাসে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশেষত মেঘালয় প্রদেশের উজান থেকে নেমে আসা হঠাৎ ঢলের তোড়ে বন্যাকবলিত হয় উত্তর ও উত্তর-পূর্বের বিস্তীর্ণ হাওড় জনপদ। শত কোটি টাকার ফসলহানি ঘটে। ক্ষেত-খামার, গৃহপালিত পশু-পাখি এবং গ্রামীণ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। হাওড়ে বন্যা না কাটতেই টানা অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মে, জুন ও জুলাই মাসে চট্টগ্রাম, পার্বত্য রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে ভয়াবহ পাহাড়-টিলা ধস এবং আকস্মিক বন্যা সংঘটিত হয়। পাহাড় ধসে অন্তত ২৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে। যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়।
এ সময় পাহাড়ি ঢলে কর্ণফুলী, মাতামুহুরী ও হালদা নদী ঘন ঘন বিপদসীমা অতিক্রম করে এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম বন্যাকবলিত হয়। সেই সাথে বিগত ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ এবং এর পরবর্তী শক্তিশালী নি¤œচাপ ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার উপকূলে ও বান্দরবানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত জুন মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত দফায় দফায় অতিবৃষ্টি হয় দেশের অধিকাংশ স্থানে। এ সময় বৃষ্টি ও জোয়ারে চট্টগ্রাম মহানগরীর ‘নাভি’ আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা তলিয়ে যায়। আগ্রাবাদের সড়কের ওপর দিয়ে নৌকায় মানুষ যাতায়াত করে। তাছাড়া সওদাগরীপাড়া চাক্তাই খাতুনগঞ্জসহ বন্দরনগরীর ব্যাপক এলাকা ঘন ঘন প্লাবিত হয়। এতে আর্থিক ক্ষতি ৫শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। অতিবৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকায় নদীর রূপ ধারণ করে। প্লাবিত হয় সিলেট, খুলনা, বরিশাল নগরীও।
বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলজুড়ে গেল বছর বর্ষারোহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুমালার আগমন ঘটে বেশ আগেভাগে। আবার বিদায় নেয় অনেক বিলম্বে। এ অবস্থায় অতিবৃষ্টিতে গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত একে একে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ব্যাপক বন্যাকবলিত হয়। এ সময় বৃহত্তর চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকায় কর্ণফুলী, মাতামুহুরী, ফেনী ও হালদা নদী, মেঘনা অববাহিকায় বৃহত্তর সিলেটে সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই নদী, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায় উত্তর জনপদের উভয় নদীসহ তিস্তা, ধরলা, মধ্যাঞ্চলে ধলেশ্বরী নদী, উত্তরাঞ্চলের পদ্মা নদীসহ অন্তত ২০টি নদ-নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। উজানে ভারত, চীন তিব্বত, নেপালে অতি বর্ষণজনিত ঢল ভাটিতে বাংলাদেশের দিকে হু হু করে নেমে আসার কারণে বন্যা বিস্তৃত হয়। তাছাড়া উজানে ভারত বন্যামুক্ত থাকার জন্য তিস্তাসহ বিভিন্ন নদীর বাঁধগুলো খুলে দেয়। এর ফলে উত্তর জনপদ, ঢাকার আশপাশসহ মধ্যাঞ্চল, নেত্রকোনা, বৃহত্তর সিলেট, নি¤œ-মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও যশোরের একাংশ এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামের মোট ৩২টি জেলা বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী এ বন্যায় অন্তত সোয়া ২ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলহানিসহ আর্থিক ক্ষতি হাজার কোটি টাকার। বন্যায় বিশাল জনপদ, বাঁধ ভেঙে গেছে অনেক জায়গায়। দশ বছরের ব্যবধানে এবার সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ব্যাপক অঞ্চল। হাওড়সহ দেশের অনেক এলাকায় সর্বনাশা বন্যার ক্ষত এখনও শুকায়নি। বন্যার্তরা এখনও অভাব-অনটনে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। অনেকেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এবারের বন্যা লাখ লাখ মানুষের মেরুদÐ ভেঙে দিয়েছে। তারা পাচ্ছে না ঘুরে দাঁড়ানোর অবলম্বন।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত ও সতর্কতা
বিশিষ্ট জলবায়ু-পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত গত ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে এক সেমিনারে মূল বক্তব্য প্রদানকালে সতর্ক করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ চরম খাদ্য ঘাটতি ও উদ্বাস্তু সমস্যার মুখোমুখি হবে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার। এ বিপর্যয়ে দায়ী দেশগুলোর কাছ থেকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্সের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, যেসব কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং পরিবেশে বিপর্যয় নেমে আসছে এর জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও এখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। এর প্রভাবে অকাল বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা এবং অকাল বজ্রপাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে অতিবর্ষণ হচ্ছে। এসব কারণে দেশে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যেই খাদ্য ঘাটতি ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। খাদ্য ঘাটতি পূরণে সরকারকে মিয়ানমারের মতো দেশ থেকেও চাল কিনতে হচ্ছে। জলবায়ুর এ বিচিত্র আচরণ অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে দেশে ধান ও গমের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসবে এবং আলু উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর বাংলাদেশ এখন খাদ্য ঘাটতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এতে উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। লবণাক্ততার আগ্রাসনের কারণে সেখানে গরুর দুধের দাম আর সুপেয় পানির দাম সমান হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশকে আগামী দিনগুলোতে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য উৎপাদন আরও কমে যাবে। সেই সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে উপকূলীয় এলাকার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে খুলনা অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬ মিলিমিটার এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১০ মিলিমিটার বেড়েছে বলে জানান তিনি। এ কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীতেও জোয়ারের পানি উঠছে।
ড. আইনুন নিশাত জানান, ব্যাপক শিল্পায়নসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেনসহ ক্ষতিকর ৪টি গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী ১শ’ বছরে গড় তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি বেড়ে যাবে। তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি বাড়লেই তা গোটা পৃথিবীর জন্য মহা সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এসব সঙ্কট মোকাবেলায় বিশ্ব এখন সোচ্চার। গড় তাপমাত্রার হার ২ ডিগ্রিতে রাখার পক্ষে গোটা বিশ্ব একমত। একে অন্তত দেড় ডিগ্রির মধ্যে কিভাবে সীমিত রাখা যায় তা নিয়েও আলোচনা চলছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এ কারণে জলবায়ু সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেকোনো আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ এখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড. নিশাত জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ১শ’ মিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্মত না হলেও ইতোমধ্যে আমেরিকার বেশ কয়েকটি রাজ্য ও সেদেশের অনেক বড় কোম্পানি এতে অর্থায়নে সম্মত আছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো: রিয়াজ আখতার মল্লিক নিবিড় গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বৃদ্ধির পরিমাণ যা বার্ষিক গড়ে অন্তত ২৫০ মিলিমিটার। সীমিত এলাকায় হঠাৎ কিংবা স্বল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত বর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বেড়ে চলেছে জনদুর্ভোগও। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহর-নগরে পানিবদ্ধতা ও দুর্ভোগের এটি প্রধান কারণ ও দিক।
বাংলাদেশের আবহাওয়া-জলবায়ুর আবহমান চিরচেনা রূপ ও বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটছে। এলোমেলো হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। ক্রমাগত অস্বাভাবিক আচরণ করছে আবহাওয়া। বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং মানুষের জীবনধারণ। নিত্যনতুন দুর্যোগ, দুর্ভোগ ও সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। ষড়ঋতুর আদি চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। পঞ্জিকার ছকে বর্ষায় বৃষ্টি ঝরে কম। অথচ প্রাক-বর্ষা ও বর্ষাত্তোর ‘অকালে’ অঝোর বর্ষণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। অসহনীয় গরমকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কিন্তু শীতের দাপট কমে আসছে। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত আলাদাভাবে জনজীবনে তেমন আমেজ কিংবা অনুভূতি জাগায় না।
প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে বাংলাদেশের আবহাওয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) একদল গবেষক সম্প্রতি বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলের আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। গবেষকরা বলছেন, ক্রমেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আবহাওয়া-জলবায়ু। তারা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান গতিতে চলতে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানেও একই পরিস্থিতি হবে। এমআইটির বিজ্ঞানী অধ্যাপক এলফাতিহ এলতাহিরের নেতৃত্বে উক্ত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
অধ্যাপক এলফাতিহ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন বিমূর্ত কোনো ধারণা নয়। এটা ঝুঁকিতে থাকা বহুসংখ্যক মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর নেতিবাচক ধারা যেভাবে চলছে তা অব্যাহত থাকলে মারাত্মক তাপদাহ সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি হতে থাকবে’। গবেষণায় আরো বলা হয়, ভবিষ্যতে সবচেয়ে ঝুঁকির দিকটি হলো- তাপদাহ ঘনীভূত হচ্ছে গঙ্গা-পদ্মা ও সিন্ধু নদী অববাহিকায় ঘনবসতিপূর্ণ কৃষি এলাকাগুলোতে। এর ফলে এ অঞ্চলের ১৫০ কোটি মানুষ সঙ্কটে পড়বেন। নিজেদের অঞ্চলে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। আরেকটি গবেষণায় জানানো হয়, বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের প্রায় ১৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে এই ঝুঁকির মাত্রা বেশি।
প্রবল ভূমিকম্পের শঙ্কা
আমেরিকান ও জাপানি ভূতত্ত¡ বিজ্ঞানীদের সাথে দেশের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, বাংলাদেশসহ আশপাশ অঞ্চলে শিগগিরই শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। প্রবল ও ব্যাপক আকারে এ ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে যে কোনো সময়েই। এর পেছনে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা অন্তত দুইটি কারণ বা ফ্যাক্টর তুলে ধরছেন। এক. সুপ্ত হলেও পৃথিবীর ভূকম্পনপ্রবণ অঞ্চল বা জোনে বাংলাদেশ এবং এর সন্নিহিত উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারের অবস্থান। এখানকার ভূ-পাটাতনসমূহের (টেকটোনিক প্লেট) নড়চড় করছে। ভূগর্ভে সঞ্চিত শক্তি বেরিয়ে আসার অপেক্ষামাত্র। বেশ কয়েকটি ভূ-ফাটল লাইন বা ফল্ট লাইন এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে চলে গেছে। দুই. সাধারণত কোনো ভূমিকম্পপ্রবণ বলয়ে প্রতি ৫০, ১০০, ১৫০ কিংবা ২শ’ বছর অন্তর শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। বিগত একশ’ দেড়শ’ বছরে বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের রেকর্ড আছে। এর ফলে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে এমনটি সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি ও সতর্কতা-সচেতনতার ক্ষেত্রে সাফল্য আন্তর্জাতিক প্রশংসা লাভ করেছে। কিন্তু ভূমিকম্পের মতো ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে দক্ষতা-সক্ষমতা, প্রাক-প্রস্তুতি ও সতর্কতা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ অনেকদূর পিছিয়ে আছে। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সিলেট নগরী, কুমিল্লা নগরী, পর্যটন নগরী কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন শহর-নগর যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। যা ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপর্যয়ের ঝুঁকি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন