জাতীয় অর্থনীতিতে ২০১৭ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর অতিক্রম করেছি। নানা ঘটনায় সালটি বেশ স্মরণীয় করে রেখেছে। অনেক আলোচিত ঘটনা সালটি বেশ স্মরণীয় করে রেখেছে। অনেক আলোচিত ঘটনা ২০১৭ সালে ঘটেছে। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে প্রায় ১০ লক্ষের মত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্টি বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া বড় ঘটনা। অন্য দিকে ব্যাংকিং পাড়ায় বড় ধরনের ঘটনা ২০১৭ সাল বেশ আলোচিত। আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত বছর সরকারি ও বেসরকারি অনেক ব্যাংক নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে অনৈতিকভাবে জনগণের অর্থের অপব্যাবহার করে। যার ফলাফল ২০১৮ সালে তীব্রভাবে দেখা দিতে পারে। যদি আমরা শক্তভাবে নিয়মনীতি পালন করে, সততার সঙ্গে আর্থিক খাতের সমস্যা মোকাবেলা করতে পারি তবেই অর্থনীতি গতি আসবে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আন্তর্জাতিক চক্রের মধ্যে লোপাট আরও একটি বড় ঘটনা। কিছু অর্থ ফেরত পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু বাকী অর্থ উদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি। বিচারও তেমন একটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। শিল্প বিকাশে ২০১৭ সাল বিদ্যুৎ খাত ব্যতীত অন্যান্য খাতে তেমন একটা অবদান রাখার মত আলোচনা আসতে পারেনি। জ্বালানি খাতের স্বল্পতা ও অবকাঠামোগত উনয়নের অভাবে আমরা শিল্পখাতে পিছিয়ে রয়েছি। তবুও ২০১৭ সালে আমাদের অর্থনীতি ব্যাপক অবদান উল্লেখ্য করার মত রয়েছে। কিছু বিষয় উল্লেখ করে চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে নিবন্ধে উল্লেখ করার চেষ্টা করব।
দৃশ্যমান পদ্মা সেতু : সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে চলেছে। বাংলাশের মত একটি দেশে পদ্মা সেতুর মত এত বড় বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন একটি অন্যন্য নজির। তবে এই ক্ষেত্রে সেতু তৈরিতে গুণগতমান রক্ষা করা সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ দিন, সুন্দরভাবে এই সেতু যেন আমরা ব্যবহার করতে পারি তা আমাদের প্রত্যাশা। যেভাবে দেশে অন্যায়, অবিচার ও অনিয়ম বিভিন্নখাতে বিরাজমান, সে অবস্থায় একটি গুণগতমান সম্পন্ন সেতু তৈরি সরকারের জন্য সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেতু তৈরি যেমন চ্যালেঞ্জ ছিল, তেমনি গুণগতমান সম্পন্ন, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সেতু তৈরি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সরকার এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেবেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ : ২০১৭ সালে বাংলাদেশ আইসিটি সেক্টরে ইন্টারনেট ব্যবহার বেশ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আজ ঘরে ঘরে ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহার আজ সকল স্তরে এগিয়ে এসেছে। আইসিটি রফতানি ক্ষেত্রে ২০১৭ সালে ২০১৬ সাল থেকে অনেক বেশী হয়েছে। সরকার বেশ কয়েকটি আইসিটি জোন গঠন করার উদ্যোগ করেছেন। ইতিমধ্যে একটি আইসিটি অঞ্চল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন।
দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৮ কোটিরও বেশি : চলতি বছরের নভেম্বর মাস শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আট কোটি পার হয়েছে। এর মধ্যে ৭ কোটি ৪৭ লাখ ৩৬ হাজা মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ওয়েবসাইটে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তথ্য হালানাগাদ করা হয়েছে। বিটিআরসি তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসের শেষে দেশে কার্যকর ইন্টারনেট সংযোগ ৮ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার হয়েছে। এর মধ্যে আইএসপিদের সংযোগ সংখ্যা ৫৩ লাখ ৪২ হাজার। ওয়েবইম্যাক্সের সংযোগ ৮৮ হাজার। তিন মাসের মধ্যে যদি কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁকে সক্রিয় ব্যবহারকারী হিসেবে গণ্য করা হয় বলে বিটিআরসির ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। গত অক্টোবর মাসের হিসাবে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হাজারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ৬ কোটি ৪৯ লাখ ৫৯ হাজার, রবি আজিয়াটার ৪ কোটি ১৩ লাখ ৯৭ হাজার, বাংলালিংকের ৩ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার, টেলিটকের ৪৪ লাখ ১৯ হাজার গ্রাহক দাঁড়িয়েছে।
৫ বছরে সর্বোচ্চ এডিপি বাস্তবায়ন : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে কিছুটা গতি এসেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এডিপির ২০ দশমিক ১১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এডিপি বাস্তবায়নে ৩২ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ তথ্যে এই চিত্র পাওয়া গেছে। চলতি অর্থবছরে স্কায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়সহ ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকার এডিপি নেয়া হয়েছে। আইএমইডি সূত্রে আরও জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৯ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ছিল ২৩ হাজর ৫৯৪ কোটি টাকা। গত বছরের চেয়ে এবার একই সময়ে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বেশী খরচ হয়েছে। এ ছাড়া জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৭ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ২০ শতাংশ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৯ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল। তবে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের ১০ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। গতবার এই সংখ্যা ছিল ১৩। অর্থবছরের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তিনটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের ১ শতাংশের টাকাও খরচ করতি পারেনি। এগুলো হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ১ শতাংশের বেশী কিন্তু বরাদ্দের ১০ শতাংশের কম টাকা খরচ করেছে এমন মন্ত্রণালয়গুলো হলো রেলপথ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় , সেতু বিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, শিল্প, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন, তথ্য, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইএমইডি ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়।
আইএমইডির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারের এডিপিতে ১ হাজার ৩৬৮ টি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে ২৬৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ওই ১৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। অন্যদিকে ভালো খবরও আছে। বেশ কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পারফরম্যান্স বেশ ভালো। বিদ্যুৎ বিভাগ বরাদ্দের ৪৭ শতাংশ খরচ করে ফেলেছে পাঁচ মাসে। এই বিভাগের ৯৭টি প্রকল্পের অনুকূলে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। এর মধ্যে জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১০ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগ ২৪ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২৮ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে।
জ্বালানি খাত : প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত অতীতের মূলত একক জ্বালানি নির্ভর (গ্যাস) সীমিত পরিসর ছাড়ীয় বহুবিধ জ্বালানি নির্ভর ব্যাপক আয় ধারন করতে যাচ্ছে। তরে প্রায় পুরোটা আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে। যার মধ্যে থাকবে কয়লা, এলএনজি, তেল, আন্তদেশীয় বিদ্যুৎ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ পদ্ধতি প্রভৃতি। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালে ২১ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালে ৩২ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪০ সালে ৫৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৯০ শতাংশ নির্ভর করতে হবে আমদানির উপর। উচ্চ মূল্যে আমদানি করে দেশে বিদ্যুতের মূল্য অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে। তাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। প্রতিযোগিতায় তখন আমাদের শিল্পখাত কি টিকে থাকতে পারবে। বাংলাদেশে উত্তর অঞ্জলে অন্তত ৪টি স্থানে বড় আকারের কয়লা মজুত রয়েছে। বড় পুকুরিয়া শুধু মাত্র সীমিত আকারে কয়লা উত্তোলন হচ্ছে। ১০ লাখ টন কয়লা এখন দিনাজপুরে বড় পুকুরিয়া খনি থেকে ব্যবহার হচ্ছে। সরকার ৯ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে। ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে তখন ৩ কোটি টন কয়লার দরকার হবে। আর এই কয়লা পুরোটা আমদানি করলে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে। তাই দেশের কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে। কয়লা উত্তোলনের জন্য বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।
চালের মূল্য বৃদ্ধির ও দ্রব্যমূল্য: বিগত বছরে চালসহ সকল নিত্য পণ্যের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিগত কয়েক মাসে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ গরিব হয়ে পড়েছে। কিন্তু দিন পূর্বে এই সকল মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে ছিল। এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গিয়েছে। বন্যা, উৎপাদন ব্যাঘাত ও ব্যবস্থাপনার ত্রæতির কারণে গত কয়েক মাসে হঠাৎ করে চালের দাম গড়ে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এতে বিপুল পরিমাণ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এর ফলে দশমিক ৩২ শতাংশ দারিদ্র্য বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যুরোর মতে (বিবিএস) এইমতে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতি : ২০১৭ সালের সব চেয়ে আলোচিত বিষয় প্রধান বিচারপতি সিনাহ বিদায়। ষোড়ষ সংশোধনী বাতিল করার ফলে সাবেক প্রাধান বিচারপতি প্রচÐ সমালোচনার সম্মুখীন হন। পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য ছুটি নিয়ে অষ্ট্রেলিয়া গমন করেন। সর্ব শেষ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য এসে পদত্যাগপত্র প্রেসিডেন্টের নিকট প্রেরণ করে বিচার বিভাগ থেকে বিদায় নেন। এই ঘটনার তিব্র নিন্দা ও বিরোধিতা করে প্রধান প্রধান বিরোধীদল। সব শেষে সরকারের জয় হয়। কিন্তু সত্যেকার জয় কার হয়েছে তা ইতিহাস বলে দেবে।
দেশে আইনের শাসন কায়েম অত্যন্ত জরুরি। ন্যায় বিচার পাওয়ার স্বার্থে সরকার বিচার বিভাগকে আলাদা করে স্বাধীনতা দেয়া হয়। কিন্তু অনেকের মতামত অনুযায়ী বিচার বিভাগ এখন ও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অতি জরুরি। ২০১৮ সাল তাই অতি চ্যালেঞ্জের বছর। এই বছর সরকারকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিচার বিভাগ নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও আইন কমিশনসহ সাংবিধানিক এই সকল প্রতিষ্ঠানকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সংহত করা জরুরি। এই সকল প্রতিষ্ঠান স্ব-স্ব আইনে সমৃদ্ধ হয়ে শক্তিশালী কার্যকরী ও স্বয়ংক্রিয় কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করা যাবে না। স্বাধীন, স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষও কার্যকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ সমৃদ্ধি লাভ ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণ ও নিরপেক্ষ স্বচ্ছ হওয়ার উপর নির্ভর করে ২০১৮ সালে সফলতা ও স্বার্থকতা।
গুম, খুন, নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ : বিগত বছরে সব চেয়ে বেশী আলোচিত বিষয় গুম, খুন। শত শত ব্যক্তি গুম হয়েছে। অনেকের লাশ পাওয়া গিয়েছে। অনেকে গুম থেকে ফিরেও এসেছে। গুম থেকে ফিরে এসে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। অনেকে একেবারে চুপ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে গুম থেকে ফিরে মামলার আসামি হয়ে জেলেও যাচ্ছে। কিন্তু কিছু লোক গুম হওয়ার পর প্রবাসী দেশ ভারত গিয়ে বন্দী জীবন ও কাটাচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী, সাংবাদিক শিক্ষক ছাত্র সকলেই আজ গুমের স্বীকার। তাই জীবনের নিরাপত্তার অভাবের কারণে অনেক ব্যবসায়ী দেশে বিনিয়োগ করার সাহস হারিয়ে ফেলেছেন। অনেক ব্যবসায়ী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, অনেক ব্যবসায়ী বিদেশে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করছে, তাই দেশে বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। ২০১৮ সালের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিরাপত্তা, বিনিয়োগকারিদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পেলে কর্মসংস্থানও বাড়বে না। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে না পাড়লে দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে না। ২০১৭ সালের অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান লাভ করে ২০১৮ সালকে কার্যকরী ও ফলপ্রসূ করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দেশ এগিয়ে নেয়ার জন্য গুম, খুনের মত অনিশ্চিত, ভীতিকর বিষয় থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হবে।
গভীর সমূদ্র বন্দর নির্মাণ অগ্রগতী : দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্রধান উপায় হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি বর্তমান সরকার হাতে নিয়েছেন। কিন্তু ২০১৭ সালে এই প্রকল্পে অগ্রগতী তেমন একটা চোখে পড়ার মত হয়নি। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, হাইওয়ে ফোর লাইন, রাস্তা নির্মাণ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার নির্মাণ যেমন চোখে পড়ার মত অগ্রগতী হয়েছে। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজ আমরা তেমন দেখতে পাইনি। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের আমদানি রফতানি পুরো চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অন্যদিকে সক্ষমতা ও আধুনিকিকরণ চট্টগ্রাম বন্দরের খুবই প্রয়োজন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে আমাদের আমদানি রফতানিও বৃদ্ধি পাবে। এখনও চট্টগ্রাম বন্দর তৈরি পোশাক শিল্পের চাহিদা পূরণ করতে হিম শিম খাচ্ছে। দ্রæত ও সঠিক সময়ে রফতানি কাজ সমাপ্ত করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন অপরিহার্য। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি আনা সম্ভব। সিংঙ্গাপুর ছোট একটি দেশ শুধু গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি রফতানির মাধ্যমে দেশটি আজ ইউরোপের যেন কোন উন্নত দেশের সমান মর্যাদায় আসিন। আমরাও আমাদের সোনার বাংলাকে সিংঙ্গাপুর বানাতে পারি। এজন্য প্রয়োজন দূরদর্শী, দক্ষ ও সৎ নেতৃত্বের। ২০১৮ সাল আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির বছর হোক এই কামনা করি।
শিক্ষা বাণিজ্য ও শিক্ষার মান উন্নয়ন : ২০১৭ সালে সরকার শিক্ষাকে সকলের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছে। ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। ২০২১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে আমাদের শিক্ষার মানসম্মত উন্নতি, মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। ৫ম শ্রেণী ও ৮ম শ্রেণীর পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাদ দিতে হবে। অন্য দিকে কোচিং বাণিজ্য বাদ দিতে হবে। সকল ক্ষেত্রে শিক্ষাকে বাণিজ্যিক রূপ থেকে সকলকে সরে আসতে হবে। ক্লাসে শিক্ষা এই শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যু : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রেহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযঞ্জ এখনও চলছে। প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের, অর্থনীতি, সামাজিক ও পরিবেশগত সংকট রোহিঙ্গা ইস্যু। ইতোমধ্যে সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে রোহিঙ্গা মুসলিম দেশে ফেরত যাওয়ার শুরু করার আশা নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রæপ কাজ করার আশা করছে। আমাদের পরম বন্ধু ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্পূর্ণরূপে তুরস্কের মত আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারেননি।
২০১৮ সালের চ্যালেঞ্জসমূহ : ২০১৮ সাল অর্থনীতিতে নতুন করে ৫টি বড় চ্যালেঞ্জ আসছে। এগুলো হলো ১. জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বেসরকারি বিনিয়োগ আরও শ্লথ গতি। ২. ক্রম বর্ধমান খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩. টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) ৪. রফতানি ও রেমিট্যাস বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ ৫. ব্যাংকিং খাত পরিচালনায় অনিয়মের প্রতিকার।
২০১৮ সালের শুরু থেকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। এখনি দুই রাজনৈতিক দল পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। ২১ ডিসেম্বর ’২০১৭ রংপুর মেয়র নির্বাচন হয়ে গেল। অনেকটা নিপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে। তবুও বিরোধীদলসমূহ খুশি হতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা অর্জন হয় নাই বলে বিএনপি মহাসচিব উল্লেখ করেন।
রাজনৈতিক এই ঢামা ঢোলে দেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে বিনিয়োগকারীগণ অপেক্ষ করা শুরু করেছেন। দেখি দেশের রাজনৈতিক কি অবস্থা হয়। এর ফলে বিনিয়োগে শ্লথ গতি হওয়া নিশ্চিত। বিনিয়োগ হ্রাস পেলে কর্ম সংস্থান ও হ্রাস পাবে। কর্মসংস্থার হ্রাস পেলে দেশে বেকার বৃদ্ধি পাবে। তাতে সামাজিক অস্থিরতা ও বৃদ্ধি পাবে। এই অবস্থার ব্যালেন্স রক্ষা করে দেশের শাসন ভার পরিচালনা করা বড় কঠিন। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৮ সাল হোক আমাদের নতুন যাত্রা পথের উদয়ের সূর্য।
লেখক : সাবেক সহ-সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন