বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

সিরাজ মুজিব জিয়া হতে পারেন আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক?

ম হ সি ন আ লী রা জু | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

১৭৫৭, ১৯৭৫, ১৯৮১ এই ৩টি সাল বা বছর ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ট্রাজিক অধ্যায় হিসেবেই চিত্রিত হয়ে আছে বা থাকবে অনন্তকাল।
১৭৫৭ সালে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল না। তখন এই অঞ্চলটি ‘সুবেহ বাংলা’ হিসেবে দিল্লীর মুঘল সম্রাটের অধিনে নামকাওয়াস্তে কার্যত স্বাধীনভাবে শাসন করতেন সুবেদার ‘নবাব মুর্শিদ কুলি খান’। প্রকৃতির নিয়মেই একদা মুর্শিদ কুলি খানের মৃত্যুর পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তরুণ বয়সী সিরাজ উদ দৌলা। মুঘল শাসন ব্যবস্থার অনেক ভালো দিক থাকলেও যথাযথ উত্তরাধিকারী আইন ও বিধি ছিল না, যেটা তাদের শাসন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক হিসেবেই পরিচিত হয়ে আছে। তাই যখনই কেউ নতুন সম্রাট, সুবেদার, মনসবদার, বা নবাব হিসেবে মনোনীত বা নিযুক্ত হয়েছেন, তখন তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র!
এক্ষেত্রে নির্মম ও কঠোরভাবে প্রতিদ্ব›দ্বীকে নির্মুল করতে পেরেছেন যিনি, তিনি টিকে থাকেন বটে তবে পরিণতিতে কোন বহিঃশক্তির আগ্রাসন ছাড়াই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা নির্বংশ হওয়ার উপক্রম হয় শাসক পরিবার।
তরুণ বয়সী নবাব সিরাজ দৌলাকেও ক্ষমতায় বসতে না বসতেই কাছের স্বজনদের বিরুদ্ধাচারণ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তরুণ সিরাজ দেশ প্রেমিক ও ব্রিটিশ বা বৈদেশিক আগ্রাসন মোকাবেলায় দূরদর্শি হলেও ষড়যন্ত্রী আত্মীয়দের বিরুদ্ধে কঠোরতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হন। সিরাজ উদ দৌলার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তার সেনাবাহিনীর পুর্বতন বয়স্ক সেনাপতি মীর জাফর আলী খানকে অপসারণ না করা। যার পরিণতিতে তাকে পলাশীর যুদ্ধে পরাস্ত ও পরে ধৃত হয়ে মীর জাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ এর হাতে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়। তবে সিরাজ নিহত হলেও তাঁর অবর্তমানে তাঁকে ঘিরে বঙ্গ ভূখÐে এক ধরনের জাতীয়তাবাদের আবহ সৃষ্টি হয়। পরবর্তিতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নবাব সিরাজ তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশে এক ধরনের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে জাগরুক থাকেন।
মূলত তারই ধারাবাহিকতায় এক ধরনের ‘মুসলিম বাঙালী জাতীয়তাবাদী’ ধারণা ও আন্দোলনের পরিণতিতে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, বাংলা ভেঙ্গে আসামকে সঙ্গে নিয়ে পৃথক বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গঠন ও পরে তা স্থগিত এবং ৪৭ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থায় বাঙালি নেতৃত্বের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। ‘আবু হোসেন’ ও আতাউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সমকালীন সরকার তারই উদা হরন। বাঙালি মোহাম্মদ আলী বগুড়াও কিছু সময় প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ অলংকৃত করেন ।
৫৮ থেকে ৬৯ পর্যন্ত আইয়ুবের এক দশকের নিপীড়নমূলক সামরিক শাসনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হন। মূলত: বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রিক আন্দোলনের জোয়ারেই ভেসে যায় আইয়ুবের স্বৈরশাসনের তখতে তাউস।
৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানের পরে ৭০ সালের নির্বাচনের জনরায়ে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন সমগ্র পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতির ও কেন্দ্রবিন্দু। পশ্চিমা সামরিক ও সিভিল ব্যুরোক্রাট ও জমিদার/ভুস্বামী রাজনীতিকদের কাছে যা ছিল অসহ্য!
যার পরিণতিতে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভাবে সৃষ্টি হল নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আর এই স্বাধীন দেশের জাতিরজনক রূপে আবির্ভাব বা অভিষেক হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের।
ইচ্ছায় অনিচ্ছায় বা পরিস্থিতিগত কারণে সিরাজের মতই শেখ মুজিব ও সঠিক সেনাপতি নির্বাচনে ভুল করেছিলেন কি না তা হতে পারে যুগ যুগের গবেষণার বিষয়। তবে এটা পরিস্কার ৭৫ সালে মুজিব পরিবারের উপর নির্মম প্রাণঘাতি আক্রমণের সময় মুজিবের নিযুক্ত সেনাপতি নিয়োগ দাতাকে রক্ষায় ন্যূনতম ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
৭৫ এ মুজিব নিহত হলেও বাংলাদেশী মানসে বা বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি চিরঞ্জীব হয়ে আছেন বা থাকবেন। দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতায় বাইরে থেকে তার দলের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এবং বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা তারই প্রমাণ।
মুজিবের বিস্ময়কর উত্থান ও দৃশ্যপট থেকে বিদায়ের পরে ধূমকেতুর মতই আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে উত্থান হয় জিয়াউর রহমানের। ১৯৬৫ সালে পাক ভারতযুদ্ধ, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৭৫ এর মুজিব পরবর্তী উন্মাতাল সময়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ত্রাণ কর্তার ভূমিকা নিয়ে অবির্ভূত হলেন জিয়াউর রহমান।
কিন্তু মাত্র পৌনে ৬ বছরেই ’৮১ সালের মে’ অভ্যুত্থানে নিহত হলেন তিনি। মে’ মাসের ট্রাজিক অভ্যূত্থানে জিয়ার নিযুক্ত সেনা প্রধানের ভূমিকা নিয়ে ও আছে বহু অমীমাংসিত প্রশ্ন?
অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন প্রেক্ষাপট নবাব সিরাজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমানের ট্রাজিক হত্যাকাÐের ঘটনাবলীর অনেক ঘটনার মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে বিস্ময়কর মিল রয়েছে । যেমন ১) তিনজনেরই শাসনকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। ২) তিনজনের মৃত্যু বা হত্যাকাÐের ঘটনার সময় তাদের নিয়োজিত সেনাপতিরা ছিলেন নিষ্ক্রিয়। ৩) তিনজনই ছিলেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার। ৪) তিনজনই দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বাধীন স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। তিনজনই আমাদের জাতীয় মানসে আছেন চীর ভাস্বর হয়ে থাকবেন চিরদিন।
তাই আমাদের বিভক্ত জাতীয় মানসে ওই তিন ট্রাজিক হিরো কি হতে পারেন না জাতীয় ঐক্যের প্রতীক? বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিৎ দলমত নির্বিশেষে আমাদের সবার।
বিশেষ সংবাদদাতা, বগুড়া ব্যুরো

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন