‘ক্যা কোরত’ দুটো শব্দ। শব্দ দুটো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পানের। সারাদেশে নৌযান বলতে নৌকাকে বোঝায়। কিন্তু চট্টগ্রামে নৌকা বলতে সাম্পানই নৌকা। চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নৌকার যত সংস্করণ থাকুক সাম্পানের গঠনাকৃতি ও চলনপ্রকৃতি কিন্তু স্বতন্ত্র। সাম্পানটি যখন চালানো হয় এ থেকে ওই দুটো শব্দ ‘ক্যা কোরত’ উচ্চারিত হয়। বহু দূর থেকে শোনা যায়। বিশেষ করে সুনসান রাতের বেলায় ‘ক্যা কোরত’ শব্দ শুনে অতিসহজে মানুষ বুঝে নিতো কোথাও সাম্পান চলছে। রাতে সাম্পানের এ শব্দ শুনেই ঘাটে অপেক্ষারত যাত্রীরা বুঝে নিতো সাম্পান আসছে। ‘ক্যা কোরত’ শব্দ সাম্পানের হালিশ চালানোর সময় কঁকিয়ে উঠে।
সাম্পানের পেছনের দিকে দুই দিকে দুইটি খুঁটি সাম্পানে পোতা থাকে। সেই খুঁটির সাথে উন্নত জাতের বেত দিয়ে আংটার মতো বন্ধনী তৈরি করা হয়। সেই বন্ধনী দিয়ে খুঁটির সাথে হালিশকে আটকিয়ে দেয়া হয়। মাঝি দাঁড়িয়ে দুই হাতে হালিশে চাপ দিলে বেত আর কাঠের সংঘর্ষে ‘ক্যা কোরত’ শব্দের সৃষ্টি হয়। উজান-ভাটিতে ‘ক্যা কোরত, ক্যা কোরত’ শব্দে তরতর করে সাম্পান এগিয়ে যায় ঘাট থেকে ঘাটে। এ সাম্পানকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘সাম্মান’। সাম্পান শব্দটা এসেছে চীনা শব্দ ‘সাং পাং’ থেকে। যতদূর জানা যায়, সাং পাং শব্দ দুটোর অর্থ হচ্ছে তিন মাথা। সাধারণত নৌকা বা অন্যান্য নৌযানের দুটো মাথা বা গলুই থাকে। কিন্তু সাম্পানের বেলায় গলুই রয়েছে তিনটি। সামনে একটা আর পেছনে দুটো। পেছনের গলুই দুটো মেষের শিংয়ের মতো দু’ভাগে ভাগ করা। এ কারণেই এ নৌযানের এমন নাম। বর্মী ভাষায় সাম্পানকে বলে ‘থাম্মান’। জাপানিতে বলে ‘জুমপেন’ আর মালয়ীতে বলে ‘সামপেন’।
ছোট থেকে হাজার মণের পর্যন্ত সব সাম্পানেই একটা মাস্তুল বা মসকুর থাকে। ওই মাস্তুলেই পাল খাটানো হয়। কখনো কখনো আরও একটা ছোট তিনকোণা পাল বা ‘জীপ সর’ ছোট খুঁটিতে খাটানো হয়। সাম্পান কেবল মানুষ নয় মালপত্র আনা নেয়াও করে থাকে। একসময় কর্ণফুলী নদীতে দেশ-বিদেশের জাহাজের পাশে এ সাম্পানের প্রতাপ ছিল গৌরবের। এখন অনেকটা খর্ব হয়ে গেছে। শঙ্খ, হালদা, চানখালি, মাতামুহুরি, ইছামতিসহ চট্টগ্রামের ছোট-বড় সব নদী-খালে রং-বেরংয়ের সাম্পান উজান-ভাটিতে চলাচল করে। বর্তমানে সেই দৃশ্যে ভাটার টান। চট্টগ্রামের কোলাগাঁয়ে, হালিশহরে, চানখালির উজানে, বরকলে, শঙ্খ নদীর উজানের বহু জায়গায়, হালদা নদীর উজানের কয়েকটি জায়গায় সাম্পান তৈরির আড্ডা ছিল।
স›দ্বীপ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি ও কক্সবাজার জেলার চৌফলদÐি, ভারুয়াখালি, রামু, গুমাতলী, বালুখালি, গুনধুম, হ্নীলা, টেকনাফ, চিরিঙ্গা এবং আরও বহু জায়গায় সাম্পানের বড় বড় কারখানা ছিল। ছোট সাম্পানগুলো তৈরি হতো বইলাম, চাপালিশ, গামারি, গর্জন ইত্যাদি কাঠ দিয়ে। আরাকান ও টেকনাফের সাম্পানগুলোর বেশিরভাগই সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি হতো। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তখন এ ঐতিহ্যবাহী সাম্পানের মিস্ত্রিরা থাকত। চট্টগ্রাম নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে সাম্পান, শুঁটকি, দরগা- এ নিয়ে চাটগাঁ। এ সাম্পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক একাডেমী, চাটগাঁ ভাষা পরিষদের মনোগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চট্টগ্রামের ঐক্য ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
চট্টগ্রামবাসীর জীবন-জীবিকার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এ সাম্পানের ‘ক্যা কোরত’ মিষ্টি শব্দটি আজকাল আর শোনা যায় না। এ শব্দটি দখল করে বসেছে স্যালো ইঞ্জিনের বিরক্তিকর ‘গুপ গুপ’ শব্দ। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে সাম্পান নির্ভর গানও। মাঝারি আকারের সাম্পানগুলো এখনও কোন রকমে টিকে আছে। বেশিরভাগ মাঝারি সাম্পানে গত দু’দশক ধরে ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে। ফলে ছোট সাম্পান বা হাত সাম্পানগুলো প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। পটিয়ার ভেল্লাপাড়া, লাখেরা, উখিয়া, নোয়াখালী, ভোলার মানুষ সাম্পান তৈরি করে থাকেন। চট্টগ্রাম নগরীর চাক্তাই, ফিশারিঘাট, ১৫ নং ঘাট, নোয়াখালী, বাঁশখালী, উখিয়া, ভোলায় সাম্পান তৈরি করা হয়।
চাক্তাই এলাকার সাম্পান কারিগর মাহমুদ জয়নাল বলেন, আমি ৪০ বছর ধরে সাম্পান বানানোর কাজ করছি। তিনি জানান, ছোট সাম্পানে ১২ থেকে ১৫ জন বসতে পারে। একটি ছোট সাম্পান তৈরি করতে খরচ পড়ে ৫০ হাজার টাকা। বড় সাম্পানে ৪০ থেকে ৪৫ জন বসতে পারে। এটি তৈরিতে এক লাখ টাকা খরচ পড়ে। বইলাম, গর্জন, চাপালিশ দিয়ে সাম্পান তৈরি করা হয়। এদিকে নগরীর ফিশারিঘাট সংলগ্ন কর্ণফুলীর তীরে সরেজমিনে দেখা যায়, সাম্পান কারিগররা এখন ফিশিং বোট তৈরিতে ব্যস্ত। সারি সারিভাবে সাজিয়ে তারা ফিশিং বোট তৈরি করছে।
বিভিন্ন ব্যবসায়ীর অধীনে কারিগররা ফিশিং বোট তৈরির কাজ করছেন বলে জানিয়ে অপর কারিগর রহমত উল্লাহ জানান, নৌকা বা সাম্পান দিয়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে এগুলো অনেক সময় সাগরে তলিয়ে যায়। এখন বড় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা ফিশিং বোট তৈরি করছেন।
তিনি জানান, একটি ফিশিং বোট তৈরিতে ৫০ লাখ টাকা খরচ পড়ে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ৮-১০ লাখ টাকা কন্ট্রাকে ফিশিং বোট তৈরির কাজ নেয়। বাসালো, আজবীসহ আরও বিভিন্ন বিদেশী কাঠ দিয়ে ফিশিং বোট তৈরি করা হয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলার কারিগররা ফিশিং বোট তৈরির কাজে নিয়োজিত থাকে।
দিন দিন সাম্পান কমে যাওয়া প্রসঙ্গে রহমত উল্লাহ বলেন, ইঞ্জিন নৌকা আসার পর সাম্পান দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন