নাফ নদীর বুক চিড়ে চলেছে পর্যটন স্টিমার। বামে মিয়ানমারের গ্রাম। ডান পাশে বাংলাদেশের মানচিত্রের শেষ তটরেখা। এক দেড়শো মাইল লম্বা এমন সুন্দর সৈকত পৃথিবীতে আর নেই। সাগর আর পাহাড়ের এই মেলবন্ধন, মাঝখানে সমতল সৈকতরেখা। এখন মেরিন ড্রাইভ সড়ক। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রলম্বিত। আমরা গিয়েছি প্রাচীন আরাকান রোড হয়ে। যার আরেক নাম শাহ শুজা সড়ক। কেবিনে আরামদায়ক আসন ফেলে রেখে আমি ডকে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কুদরতের কারিশমা দেখছি। কী সুন্দর তার সৃষ্টি। কত মনোরম তার প্রকৃতির বিন্যাস। সারাটা সময়জুড়ে সামুদ্রিক পাখিরা স্টিমারটির চারপাশে ঘুরছে। নীল আকাশে রোদের ঝলকানি স্বচ্ছ পানির বুকে শে^ত কপোতের মতো পাখিরা যেন জীবনের ছন্দ হয়ে উড়া-উড়ি করছে। যাত্রীদের অনেকেই বিস্কিট, পাউরুটি, চিপস ইত্যাদি ছুড়ে দিচ্ছেন আর উড়ন্ত গাঙ চিলেরা সেসব লুফে নিচ্ছে। এ যেন এক লোভনীয় দৃশ্য। একসময় আমরা খুব লক্ষ্য করে দেখলাম, নদীর মিষ্টি পানি ছেড়ে জাহাজ সমুদ্রের নোনা পানিতে পড়ছে। অভিজ্ঞ লোকেরা এর গতি ও স্রোতরেখা দেখে বুঝতে পারেন। জেলেরা এর স্বাদ চেখেও পার্থক্য নির্ণয় করেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ যেমন বলেছেন,
দুটি জলধারা আমি পাশাপাশি প্রবাহিত করেছি তাদের মাঝে রয়েছে অদৃশ্য বাধা, যা মিষ্টি ও নোনা পানির দুটি ধারার কোনোটিই লঙ্ঘন করে না। অন্যত্র বলেছেন,
একটি ধারা সুপেয় মিষ্টি পানি অপরটি পানের অযোগ্য চরম তিক্ত।
সাথে আমার যে তিনজন আলেম ছিলেন তারা আমার ছাত্র হলেও বর্তমানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও আমার খোলামেলা সম্পর্কের কল্যাণে বন্ধুস্থানীয়। যতই আমি তাদের সহজ হতে বলি তারা কেবল শিষ্য হয়েই থাকতে চায়। আমি বিরক্ত হলে কিছুক্ষণ সহজ হয় আবার ভুলে গেলে তারা ছাত্রের ভাব ধরে। যাক শেষ পর্যন্ত আমরা সেন্টমার্টিনে নোঙ্গর করি। আামাদের স্বাগত জানান বর্ষীয়ান এক আলেম। যিনি একজন ইমাম ও খতীব। আগে একবার ছেড়া দ্বীপে গিয়েছি বলে নতুন করে আর যাইনি। অন্যদিকে বেশ দূরে শাহপরীর দ্বীপ। বহু বছর আগে ঘুরে দেখা। এবার সেদিকেও যাইনি। নামটি খুব সুন্দর। স্থানীয়রা বলে, শাফরীর ডিয়া। দেরি না করে গোটা সেন্টমার্টিন একটা চক্কর দিয়ে আসা হলো। পর্যটনের কটেজে চেইঞ্জ করে গেলাম সৈকতে। চেয়ারম্যান সাহেব এসে দেখা করলেন। সাবেক এক চেয়ারম্যান আমাদের সাথেই ছিলেন। লেখক হুমায়ুন আহমেদের সমুদ্রবিলাস পেছনে ফেলে আমরা সমুদ্রে নামলাম। পৃথিবীর অনেক সৈকতেই যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের স্বচ্ছ নীল পানি ও প্রবালময় তলদেশের মতো দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়েনি। শাহপরীর দ্বীপও অনেকটা এমন। তবে সেন্টমার্টিন সম্পূর্ণ প্রবালদ্বীপ।
আমার পরিচিত ও ছাত্রভক্তের পাঁচ সাতটি স্থাপনা এখানে আছে। আমি কোথাও না উঠে ঘাটে চলে যেতে চাইলাম। ইমাম সাহেব প্রবীণ আলেম আমাকে খুব পছন্দ করেন। বললেন, দ্বীপের পনেরো বিশজন ইমাম ও আলেম এক জায়গায় জমা হয়েছেন। আমাকে তারা পেতে চান, একটু মেহমানদারিও করবেন। আমি বললাম, এখন তো খাওয়ার সময় নয়। তাছাড়া মেহমানদারির ঝামেলায় আপনাদেরকে ফেলতেও চাই না। তখন ইমাম সাহেব বললেন, তারা সৈকতে এসেই আমার সাথে দেখা করতেন। কিন্তু আমি ওখানে যাবো ভেবে তারা মসজিদে বসে আছেন। আমি সেখানে গেলাম, তাদের সঙ্গে দীনি বিষয়ে জরুরি কথাবার্তা বললাম এবং কিছু বিষয়ে তথ্যও নিলাম। বিদায় হয়ে যখন ফিরছি ইমাম সাহেব বললেন, এক রেস্তোরাঁর মালিক আমাদের খানা খাওয়াবে বলে আবদার করেছে। পাশাপাশি ইমাম সাহেবের আহলিয়া মাছের তরকারি রান্না করে রেখেছেন। আমি বললাম, এ দুটি দাওয়াতের সমন্বয় কীভাবে করা সম্ভব? তখন ইমাম সাহেব তার সরল সহজ ও আন্তরিকতা ভরা হাসি উপহার দিয়ে আমার হাতটি ধরে রেস্তোরাঁয় নিয়ে বসালেন। বললেন, বাড়ি থেকে মাছ রান্না করে রেস্তোরাঁয় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রেস্তোরাঁর মালিক তার নাতি সম্পর্কিত হওয়ায় তিনি তার দাওয়াত রাখতে বাধ্য হয়েছেন। আমি তখন বললাম, সমবেত আলেম উলামাগণকে আমি যদি দাওয়াত করি আর এ মেজবানিতে রেস্তোরাঁ মালিক ও আপনার আহলিয়া শরীক হন তাহলে বিষয়টি কি আরও সুন্দর হয় না। তিনি তখন খুব বেকায়দায় পড়ে গেলেন। আমি তখন রেস্তোরাঁ মালিককে ডেকে বললাম, আমি যা বলি তাই আপনাকে শুনতে হবে। আপনার নানি মাছের তরকারি পাঠিয়েছেন। আপনি আমাদের ভাতের ব্যবস্থা করেন। মাছ ভাজা, ভুনা, চচ্চড়িসহ বাকি অন্যান্য আইটেম যার যা ইচ্ছা সবাই গ্রহণ করেন। ওসব আমার তরফ থেকে। তারা অনিচ্ছা সত্তে¡ও আমার এ ফর্মুলায় রাজি হলেন। এরপর আলেম উলামারা সবাই মিলে চা, পান নিয়ে এ দাওয়াত পর্ব শেষ হলো। আমরা ফিরতি স্টিমারে উঠলাম।
উত্তাল সমুদ্র শীতে কতই শান্ত। মৌসুম ছাড়া এদিকে পর্যটকরা আসে না। স্টীমারও চলাচল করে না। প্রিয় মানুষদের আন্তরিক বিদায়ের পর যখন সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছি তখন সেন্টমার্টিনের কথাই ভাবনাজুড়ে ছিল। বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে প্রকৃতির সরাসরি দান মাটি, পানি, পাথর ও গাছপালা ছাড়া বাকি সবই বাইরে থেকে আনা। যদি সমুদ্র উত্তাল থাকে কোনো নৌযান চলাচল করতে না পারে তাহলে এখানে চাল-ডাল, ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিছুই পাওয়া যায় না। যে স্টক আছে তা ফুরিয়ে গেলে একটি ম্যাচ বক্স, মশার কয়েল, ক্রীম, টুথপেস্ট, তেল, নুন, থালা-বাটি, গøাস ইত্যাদি কিছুই পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না টেকনাফ থেকে আবার না আনা হয়। দ্বীপের নিজ সম্পদ বলতে দেখলাম বড় বড় ডাব, যা খুব আগ্রহভরে পর্যটকরা খায়। সব যোগাযোগ বন্ধ হলেও ডাব আর মাছ এখানে পাওয়া যাবে।
একবার কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে উপজেলা পরিষদের গাড়িতে চড়ে ছিলাম। সেখানে আর কোনো গাড়ি ছিল না। এ সফরে আব্বা ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব ছিলেন। ঢাকা থেকে বিমানে কক্সবাজার যাওয়ার পথে আবহাওয়া খারাপ থাকায় আব্বা খানিকটা অসুস্থ হয়ে যান। একদিন প্রোগ্রাম শেষে তিনি ফিরে আসেন। আমরা আরও দুদিন থেকে ঢাকায় ফিরি। গাড়িতে আমি আয়োজকদের প্রশ্ন করলাম, এই গাড়িটি মহেশখালী কীভাবে এলো? তারা বললেন, বড় ফেরিতে করে আনা হয়েছে। আমি বললাম, এটি তো তার জীবনে আর কখনো বাংলাদেশের মূল ভূখÐে ফিরতে পারবে না। শুনে সবাই হাসলেন। স্থানীয়রা বললেন, কক্সবাজার থেকে যা কিছু এখানে আনা হয় সেসব আর ফিরে যেতে পারবে না বুঝেই আসে। আপনাদেরও আর ছাড়ব না। আমি বললাম, দুনিয়াতে মানুষও এমনই। যেই একবার এ জগতে এসেছে সে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি। মাটির পৃথিবীতেই তার সৃজন এখানেই তার সমাধি। শুধু আত্মাটি বহিরাগত। আল্লাহর হুকুমে সেটি মানুষের দেহে স্থাপিত হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে সে আবার আল্লাহর দেয়া ঠিকানায় ফিরে যায়।
এরপর গোরকঘাটা বাজারে আমাদের এক সুহৃদয় আলেমের গদি ঘরে মজার আড্ডা হয়। সন্ধ্যায় আলোচনা সভা হয়। পরদিন দেখতে যাই আদি নাথের পাহাড়। ফেরার সময় আমি উদ্যোক্তাদের বলি, উপজেলার গাড়ি ব্যবহারের নিয়ম কী? তারা বলেন, এটি পরিষদের সৌজন্যে। বিশেষ কোনো মেহমান এলে এটি ব্যবহার করার নিয়ম রয়েছে। তবুও আমি তাদের এ গাড়ির একটি যৌক্তিক ভাড়া ও সম্পূর্ণ তেল খরচ কত হয় তা আমাকে জানাতে বললাম। উদ্যোক্তারা এভাবে হিসাব করে সব দিয়ে দেবেন বলে আমাকে নিশ্চিত করলেন। আমি বললাম, এসব বিষয়ে উলামায়ে কেরাম যেভাবে খেয়াল করেন সাধারণ মানুষ এমনকি দায়িত্বশীল নাগরিকরাও সেভাবে খেয়াল করেন না। তাই আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা অন্য যে কারো সম্পদ ভোগ বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতে হবে। যেন আমাদের ওপর কারো কোনো দায় থেকে না যায়। এ গাড়ির ব্যবহার যেহেতু এখানে একটি অপারগতা জনিত রেওয়াজ হয়ে গেছে সুতরাং আমরা সেটি মেনে নিলাম। কিন্তু এর ব্যয় ও অবচয় আমরা নিজেরাই বহন করে কিছুটা হলেও দায় কমাতে চাই। আমার এসব কথা উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তা খুব ইতিবাচকভাবে নিয়েছিলেন। তারা উদ্যোক্তাদের কাছে পরেও বারবার বলেছেন যে, এই মেহমান আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেলেন।
পরদিন কক্সবাজারে কাটাই। মাওলানা নূরুল হক আরমান আমাদের সৈকত ঘুরিয়ে দেখান। এখানে একটি হুড খোলা জীপের ব্যবস্থা ছিল। যাতে চড়ে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ও আমি স্থানীয় কয়েকজনসহ সমুদ্র পাড় ঘেঁষে বহু দূর ঘুরে আসি। ছিলাম ইউনাইটেড হোটেলে। টিনের দু’তলা রুম। এর পর বহুবার কক্সবাজার গিয়ে থেকেছি প্যানোয়া’য়। ইদানিং নতুন হোটেল মোটেল জোনে বড় বড় হোটেলে থাকা হয়। অনেক সময় পরিচিতদের রিসোর্ট বা ভিলায়ও থাকি। কক্সবাজারে যেসব আপন মানুষ রয়েছেন তারা সবাই বড় আলেম, দীনদার তরুণ, ইসলামী কর্মতৎপরতার নেতা-কর্মী ও সুফী-দরবেশ। একদিন সময় নিয়ে গেলেও কমপক্ষে দশ জায়গায় একটু হলেও ঢুঁ মারতে হয়। যারা একটু সময়ের জন্য হলেও নিজেদের ঠিকানায় নিতে চান তারা বলেন, একদিনের জন্য কেন আসেন? কমপক্ষে তিন চারটে দিন না থাকলে আমরা সবাই কী করে আপনাকে একটু পাই।
ইংরেজ প্রশাসকের নামে ব্রিটিশ আমলে কক্সবাজার নাম হয়। মূলত এ জায়গাটির নাম পালংক্যী। মিস্টার কক্স এর নামে কক্সেস বাজার। প্রচলিত বানানে কক্সবাজার। শত শত বছর আগে এ জায়গাটি আবিষ্কার ও আবাদ করেন ইসলামপ্রচারক হযরত শাহ বদর রহ.। এজন্য কক্সবাজারকে বদর মোকামও বলা হয়। কক্সবাজার থেকে মহেশখালী, সোনাদিয়া ও গভীর সমুদ্রে যাওয়ার বন্দরটি বর্তমানে বদর মোকাম নামে পরিচিত। এ পথেই আরব থেকে ইসলামপ্রচারের জন্য শাহ বদরুদ্দীন পালংক্যীতে এসেছিলেন। এখানেই মসজিদ ও আস্তানা বানিয়ে তিনি ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজ করেন। আমি প্রায়ই বলে থাকি, কক্সবাজার বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক ঘোষিত হওয়ার সময় এর নাম যেন রাখা হয়, হযরত শাহ বদর রহ. আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কক্সবাজার। কাক্সিক্ষত সে সময়টিতে বাংলাদেশে যে সরকারই থাকুক, প্রধানমন্ত্রী যিনিই থাকুন, আশা করি আমার এ ধারণাটি তারা মাথায় রাখবেন। কেননা, বাংলাদেশের ঐতিহ্য এটিই। ঢাকায় হযরত শাহজালাল রহ., চট্টগ্রামে হযরত শাহ আমানত রহ., খুলনায় হযরত খানজাহান আলী রহ., রাজশাহীতে হযরত শাহ মাখদুম রহ., সিলেটে উসমানী ইত্যাদি নামে বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছে। আমার অন্য লেখায় উল্লেখ করেছি, রংপুর আলাদা বিমানবন্দর হলে কিংবা সৈয়দপুরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নিত করলে যেন নামকরণ করা হয়, হযরত কারামত আলী জৈনপুরী রহ.-এর নামে। এ হিসাবে কক্সবাজারের নাম হযরত শাহ বদর রহ. আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে খুব ভালো লাগবে।
লেখক: সাংবাদিক, ধর্ম ও সমাজতত্ত¡বিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন