শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

ইউরোপে বড়দিন ও নববর্ষ উদযাপন

মা হ মু দ শা হ কো রে শী | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পাশ্চাত্য সভ্যতার দেশগুলোতে কিংবা খ্রিষ্টীয়-সংস্কৃতি অনুসারী জাতিসমূহ যে উল্লাস ও আনন্দমুখর উদ্দীপনায় বড়দিন ও নববর্ষ উদযাপন করে থাকে তার তুলনা পৃথিবীর অন্যত্র পর্যাপ্তভাবে পাওয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে প্যারিস, লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক নগরীতে এই উৎসব দু’টির বড় আয়োজন হয়ে থাকে। ষাটের দশকের শুরু থেকে আমি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেখে আসছি- কখনো সরাসরি অংশগ্রহণে, কখনো দূরে ঘরে বসে টেলিভিশনের কাঁচের পর্দায় কিংবা পত্রিকা পাঠে উপভোগ করে চলেছি।
ষাটের দশকের শুরুর ক’ বছর আমি প্যারিসে বড়দিন ও নববর্ষ কাটিয়েছি। প্রথম বছরেই অর্থনীতিবিদ মুজাফফর আহমদ, আমার রুমমেট, তার এক ফরাসি সহপাঠীর বাড়িতে দাওয়াত পেলেন। তার কাছে ফরাসি পরিবারে খাওয়া-দাওয়া, মধ্যরাতে গির্জায় গিয়ে যাজকের বক্তৃতা শোনা, উপাসনা ও অর্গানে সঙ্গীত শ্রবণ ইত্যাদির বর্ণনা পেলাম। পরবর্তীতে ফরাসি পরিবারে দাওয়াত পাওয়া সূত্রে আমারও প্রায় একই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ ঘটল। আমার কাছে ধর্মযাজকের অতি মার্জিত ভাষায় সুকণ্ঠে সুললিত বক্তৃতা খুবই চিত্রাকর্ষক মনে হতো। পরে যন্ত্রসঙ্গীত এবং কোরাসও খুবই উদ্দীপনার সৃষ্টি করত।
খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে বিশেষ ধরনের সুপ, মাংসের রান্না, সর্বোপরি কেক ও পেস্ট্রি উল্লেখযোগ্য। আর যত্রতত্র ছড়ানো থাকত লজেন্স ও চকলেট। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এবং বন্ধু-বান্ধবদের নতুন জামা-কাপড়, বিভিন্ন উপহার সামগ্রী প্রদান একটি অবশ্য কর্তব্য আচার-আচরণ বলে বিবেচিত হতো।
নানা বয়সের মানুষের নানা রকমের প্রবৃত্তি ও প্রয়োজনে উৎসবের আয়োজনের ক্ষেত্রে তারতম্য দেখা দেয় এবং সেটাই স্বাভাবিক। এখানে উল্লেখ্য যে, এককালে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ব্রাহ্ম সমাজে বড়দিন বেশ উজ্জ্বলভাবে উদযাপিত হতো। রবীন্দ্রনাথ নিজে বড়দিন উদযাপনের জন্য বিশেষ আয়োজন করতেন বলে জানা যায়। তার কাছে এই খ্রিষ্টোৎসব বিশ্বশান্তির জন্য উৎসর্গীকৃত বড়দিনই বটে। বলা বাহুল্য শুধু ২৫শে ডিসেম্বর নয়, পুরো ডিসেম্বর মাসটাই খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এই উপলক্ষে নিজেদের সমস্ত তৎপরতাকে নিয়োজিত রাখেন।
অতঃপর তারা বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর রজনী বিশেষভাবে উপভোগ্য মনে করেন। কারণ রাত বারোটার পর যে নতুন বছরের আগমন ঘটবে তাকে বরণ করে নেয়ার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা সেই নববর্ষ তাদের জন্য নতুন সৌভাগ্যের দ্বার উন্মোচন করতে পারে। সাধারণভাবে এ ধরনের একটা বিশ্বাস অনেকের মনে সক্রিয় থাকে। তবে আসলে সে রাতে একটা বিশেষ ভোজসভা ও নৃত্যগীতের উৎসবের আমন্ত্রণ উপভোগ থাকে অনেকের লক্ষ্যের মধ্যে। আমার ইউরোপ অবস্থানকালে অবশ্য দেখেছি ক্রমশ আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন সূত্রে অনেকে এ সময়টায় ভ্রমণ পছন্দ করে থাকেন। বিদেশে বিশেষ করে শীতকালীন বরফ অধ্যুষিত এলাকায় ‘স্কি’ ক্রীড়ায় যুবক-যুবতী বা মধ্যবয়সীরা অংশগ্রহণে সক্রিয় থাকেন। বুদ্ধিবিবেচনা করে হাত-পা ভাঙার সম্ভাবনাযুক্ত এসব ক্রীড়া পরিহারে আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। আমি প্রায়ই প্যারিস ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে আমার ছোটভাই আহমেদ শাহ ও অন্য বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে নববর্ষের উৎসব উদযাপন করতাম। সাধারণত আমরা একটা ভালো রেস্তোরাঁয় গিয়ে নৈশভোজ সম্পন্ন করতাম। তারপর নৃত্যগীত সংবলিত কোনো বিশেষ বারে টিকিট কিনে ঢুকে পরতাম। সে সময়ে তাদের নৃত্যগীত আমাদের মন ও মগজে অনেকটা গ্রহণযোগ্যতা পেত। রাত গভীর হলে আমরা গৃহে প্রত্যাবর্তন করে নিদ্রামগ্ন হতাম। উল্লেখ্য যে, বছরের শেষ রাত কিংবা নববর্ষের দিনটিও খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়ের কাছে একটা উপাসনার রাত বা দিবস। অথচ আমাদের দেশে তা সেভাবে গ্রহণীয় নয় এবং এখানে ১ জানুয়ারি ছুটির দিনরূপে গ্রাহ্য নয়।
বিদেশে অবস্থানকালে আমাদের কাছে এই দু’টি উৎসবের ধর্মীয় দিকটি কোনো তাৎপর্য বহন করত না। আমরা তার আনন্দের পরিসরটি কেবল লক্ষ করতাম। এখানে জনজীবনে আনন্দ সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসানের একটি বিশেষ বক্তব্য উপস্থাপন করে এই ক্ষুদ্র প্রতিবেদনের উপসংহার ঘটাব :
আনন্দ কাকে বলে? আনন্দের কি কোনো আকৃতি আছে, কোনো রঙ আছে অথবা শব্দের আড়ম্বর আছে? আনন্দ কি শুধু দেখা অথবা অনুভব করবার? আমাদের দৃষ্টির অধিকার যত প্রচন্ডই থাকুক তার একটি সীমাবদ্ধতাও আছে। আমাদের চতুর্দিকে যে পরিসর তার মধ্যেও নির্দিষ্ট সীমানায় আমাদের গতিবিধি। এ গতিবিধির ঊর্ধ্বে-অর্ধ আছে, এ গতিবিধির সমান্তরালতা আছে যেদিকে তাকাই এক সময় দৃষ্টি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের চিত্তের অনুভবের যে সৌজন্য এবং বিস্তার তা কখনও শেষ হয় না। মানুষ তার অনুভূতির রাজ্যে সমস্ত বিশ্বভ্রহ্মÐ যেন ধারণ করতে চায়। এ অনুভূতির রাজ্যের সীমা-পরিসীমা নেই। এ অনুভূতির আরম্ভ কখন এবং কোথায়, তা আমরা জানি না এবং শেষই বা কখন তাও আমরা জানি না। শুধু এটুকু জানি যে, সময়ের দায়ভাগে আমাদের স্নায়ু যখন শিথিল হবে তখন আমরা অনুভূতিকে হারাতে থাকব এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু যখন আসবে তখন সবকিছু পুরোপুরি হারিয়ে ফেলব। তাই মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে একং সজীব থাকে তত দিনই আনন্দের অধিকার থাকে এবং নীরানন্দের ব্যতিক্রম থাকে প্রতিদিনই আমরা এই আনন্দ-নিরানন্দের মধ্যে বাস করি কখনো উন্মুখরতায়, কখনো বিন¤্রতায় এবং কখনো শান্ত ঔদার্র্যে। মরহুম সৈয়দ আলী আহসান, ‘ঈদের আনন্দ একটি বিবেচনা’, অঙ্গীকার ঈদ সংখ্যায় ১৯৯৫ পৃ. ৫।
লৈখক : সাবেক মহাপরিচালক বাংলা একাডেমি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
rahim ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৮:১৬ এএম says : 0
Hello sir দৈনিক ইনকিল্যাব এর সংবাদের শিরোনাম গুলো gmail এ কিভাবে পেতে পারি । প্লিজ জানাবেন। এই gmail rahimhosenarif@gmail.com এ
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন