ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক
স্বাধীনতা পাওয়া ও রক্ষা করা দুটোই কঠিন কাজ। স্বাধীনতা রক্ষা আরও বেশি কঠিন। স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে পারে দূরের বা কাছের বিপক্ষ। যখন বাংলা বিহার উড়িষ্যা নবাবী আমলে স্বাধীন রাষ্টের রূপ নিচ্ছিল, তখন তা নস্যাৎ করল সাত সমুদ্রের নদী পাড়ি দিয়ে ইংরেজরা।
১৯৪৭ পূর্ব সময়ে স্বাধীনযুক্ত বাংলা হওয়ার আর এক সম্ভাবনা ছিল। এর আগে ১৯০০ সালে যখন বাংলা ভাগ হলো, তখন তা একত্র করতে সন্ত্রাস পর্যন্ত হয়েছিল। ফলে ১৯১১ সালে আবার বাংলাযুক্ত হলো, অবশ্য ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার প্রদেশ হিসেবে। তাই ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ চলে যাচ্ছিল, আবার আশার সৃষ্টি হলো এই ভেবে যে, এবার স্বাধীন যুক্ত বাংলা হবে না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, শরৎ বোস প্রমুখ প্রচেষ্টা চালালেন। কিন্তু এবার ১৯০৫-১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধীর স্ব-বিরোধী নীতিতে বঙ্গভঙ্গ করেই ছাড়লেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তারই এক সম্প্রদায় গ্রহণ করলেন, তারা মহাভারতেই থাকতে চাইলেন। ১৯০৫-১৯১১ সালে বাংলা জাতীয়তাবাদের পক্ষে কথা বলা হলেও ১৯৪৭ সালে বাংলা (বঙ্গ) ভঙ্গই আবার লক্ষ্য হলো। বাংলা ভাষাভাষীর এক সম্প্রদায়ের এই দ্বিমুখী আচরণ বাঙালি জাতির খুবই ক্ষতি করল। পরবর্তীতে কবি জীবনানন্দ দাশ উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ প্রথিতযশা লেখক, পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি, বাংলা ভাষা, বাংলার অর্থনীতি নিয়ে খুব হাহুতাশ করেছেন। (দ্রষ্টব্য : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আকি কি বাঙালি’ পত্র-ভারতী, কলকাতা, পৃষ্ঠা : ২৭-২৮)
আবার ১৯৪৭ সালে যখন ব্যালটের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ ও সিলেটের অংশবিশেষ এক ধরনের স্বাধীনতা পেল, তাও নস্যাৎ হয়ে গেল পাকিস্তানি একশ্রেণীর সামরিক-বেসামরিক চক্রের কারণে। পূর্ব বাংলার অধিবাসীরা সাময়িক সময়ের জন্য আবার স্বাধীনতা হারাল। অবশ্য আবার এটা পুনরুদ্ধারও হলো। তবে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র চলছেই।
সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত কারণে পার্শ¦বর্তী দেশ দখল সম্ভবপর। এই হালেও এভাবে রাশিয়া ইউক্রেনের বিশাল এলাকা দখল করল। এখন নাকি তার নজর কাজাখিস্তানের দিকে। চীন একই কারণে অরুণাচলের ওপর চোখ দিয়েছে।
এপার বাংলা ওপার বাংলা এসব বক্তব্য মতলবি। ১৯৪৭ সালে তারা তাদের ভাই শরৎ বোসের কথা শোনেনি কেন? তারা তাদের দূরবর্তী প্রতিবেশী প্যাটেলের কথায় কান দিয়েছিল। তারকাঁটা দিয়ে ভালোই হয়েছে, যদিও ফেলানীর করুণ মৃত্যু আমরা তারকাঁটাতে প্রত্যক্ষ করেছি। তারকাঁটাতে ফেলানীর পাখির মতো ডানা মেলার ছবি যুগ যুগ পর্যন্ত ইন্টারনেটে থাকবে। বলা হচ্ছে কিসের পাসপোর্ট, কিসের ভিন্ন মুদ্রা ইত্যাদি। তারকাঁটাই প্রমাণ দিচ্ছে যে, আমরা পৃথকÑ শুধু পাকিস্তানিদের থেকে নয়, অন্যদের থেকেও।
সীমান্তে গুলি বন্ধই করা যাচ্ছে না। অবাঙালি বিএসএফ হোক বা বাঙালি গুলি হচ্ছেই। এটা একটা মাইন্ড-সেট। ধর্ম যে কত বড় উপাদান এটাই প্রমাণ। হাঙ্গেরি বলছে, তারা মুসলমান চায় না। অথচ ইউরোপ নাকি প্রগতিশীল। সেক্যুলার রাষ্ট্র। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্রামেনর আবির্ভাব ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
শুধু যে নিকটের প্রতিবেশীই বিপদের কারণ হয় তা নয়, দূরের প্রতিবেশীও বিপদের কারণ হয়। দূরের প্রতিবেশীরা অতীতে বেশি ঝামেলা বাধায়। এখনো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের প্রভাব বলয় সৃষ্টিতে পরোক্ষভাবে নাক গলাচ্ছে সর্বত্র, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এই নাক গলানোটা ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করেছে। এই নাক গলানোর কারণগুলো হলো ইহুদি রাষ্ট্রটিকে আরো শক্তিশালী করা, খনিজ সম্পদ লুটপাট, সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক ধর্মীয় বাহাদুরি জাহির।
ইন্ডিয়া ছাড়াও বাংলাদেশের রয়েছে আর এক প্রতিবেশী মায়ানমার। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় কারণে কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন হচ্ছে না। শুধু ইন্ডিয়া থেকে মুসলমান উৎখাত নয়, মায়ানমার থেকেও মুসলমান উৎখাত বাংলাদেশকে সমূহ বিপদে ফেলবে। আসল তথা পূর্ব ইন্ডিয়ার বাংলা ভাষী মুসলমানরা উৎখাতের দ্বারপ্রান্তে। একে পানির জন্য হাহাকার, অন্যদিকে পানি আটকে মানুষ প্রেরণ হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বিজেপি নেতৃবৃন্দের উসকানিমূলক কথাবার্তা আর এক ট্রাম্প আপদের মতো।
রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবেই অগ্রসর হচ্ছিলেন। তিনি বিদেশি সেনা হটালেন। গোপন সাত দফা চুক্তিকে নাকচ করলেন। পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজাতে মন্ত্রিসভায় রদবদল করেন।
এ ব্যাপারে তিনি কারও চাপের নিকট নতিস্বীকার করেননি। তিনি তো ঢাকাতে নেমেই ঘোষণা দিলেন যে, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। আর ওআইসিতে প্রবেশ করতে দেরি করলেন না। ইসলামী ফাউন্ডেশনকে তিনি শক্তিশালী করলেন। শাসনতন্ত্রে জাতীয়তাবাদ ঢুকালেন, যা প্রতিবেশীর মনঃপূত ছিল না। তবে তিনি তাদের আশ্বস্ত করতে এ বিষয়ে জোর দিলেন যে, বাংলাদেশ সমগ্র বাঙালি জাতির রাষ্ট্র নয়, এটা সাবেক পূর্ববাংলা আর কি। উল্লেখ্য যে, প্রতিবেশীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল, কারণ এটা না সেখানে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেয়। শেখ সাহেব চীন, আমেরিকা, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে দ্রুত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলেন। আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করলেও তাদের হুমকিতেই ইয়াহিয়াহ শেখের জীবননাশে সাহস পায়নি। ভূট্টোর শঠতায় রক্তবন্যা প্রবাহিত হলেও বঙ্গবন্ধু তাকে ঢাকাতে আনলেন। ফলে ভূট্টো জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল ছড়াল, যা বাংলাদেশের একটা জয়। এসবই করা হলো এই উদ্দেশ্যে যে, শেখ সব আন্ডা এক ঝুড়িতে রাখতে চাননি। তিনি জাতি গঠনে নতুন আদর্শ সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন। তিনিই আসলে নেলসন ম্যান্ডেলারও পথপ্রদর্শক।
শেখ সাহেব বাকশাল না করেও সন্ত্রাস ও উগ্রতা দমন করতে সম্মত হতেন, কারণ তার হাতে সব ক্ষমতা ছিল, পার্লামেন্ট তার পেছনে ছিল। সামরিক বাহিনীর মূল কমান্ড তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। বহির্বিশ্বেও তার ইমেজ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তার উপদেষ্টারা তাকে বাকশাল করার ভুল পরামর্শ দিয়ে তাকে নিঃশেষ করে দেয়। একইভাবে জিয়াকে তার উপদেষ্টারা তার শত্রুর ঘরে টেনে দেয়। অথচ তার চট্টগ্রামে রাত কাটানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। চট্টগ্রামে রাত না কাটিয়েও চট্টগ্রামের বানোয়াট রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যেত। গণতন্ত্রে সহনশীলতা প্রয়োজন, অথচ দেশে তা দেখা যাচ্ছে না। কখনো কখনো আমরা পাকিস্তানিদের চেয়ে খারাপ নজির সৃষ্টি করছি। ‘নির্মূল’, ‘খতম’, ‘উৎখাত’ এসব শব্দ যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা তো গণতন্ত্রের ভাষা নয়। এর ফলেই তো দেশে গণতন্ত্র নেই বললে চলে। ‘রাজবন্দী’ বলে একটা শব্দ ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলেও ছিল। এখন নেই। ১৯৪৭, ১৯৫৪, ১৯৭১ সালে নির্বাচনে কারচুপির কথা শুনিনি। এখন ভোট দিতে যাওয়া লাগে না। আগেই বাক্সভর্তি। এ মন্তব্য মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজও করেছেন।
আজ ইন্ডিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, উগ্র হিন্দুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে তারা। উপনিষদের সমাজ, রামরাজ্য, গোহত্যা বন্ধ, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, মুসলিম নির্বাসনের হুমকি, সেখানকার মিডিয়াতে দেব-দেবীর কীর্তি কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নেই। অথচ ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের পেট চিড়ে যে বাংলাদেশের জন্ম তার স্বকীয়তা রক্ষার কোনো প্রচেষ্টা নেই। বলা হচ্ছে এক সংস্কৃতি, এক ইতিহাসের কথা। একই যদি হতো, তাহলে তো ১৯৪৭ সালেই এর ফয়সালা হয়ে যেত অখ- ভারতে। আমাদের মহান নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আবুল হাশেম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আমরা অখ- ভারতের ফাঁদে পা দেইনি বলে আজ আমরা স্বাধীন। শেখ আবদুল্লাহ যে ভুল করেছেন, শেখ মুজিব সে ভুল করেননি। কাশ্মীর স্বাধীন হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। আমাদের নেতৃবৃন্দ লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে তা সম্ভবপর করেছে। তবে আমাদের সব ভাই যদি ১৯৪৭ সালে স্বাধীন যুক্ত বাংলার পক্ষে থাকতেন তাহলে বহু দুঃখকষ্টের অবসান হতে পারত। এর জন্য বাংলাদেশের মানুষ কোনো ত্রুটি করেনি। কলকাতা ও মহারাষ্ট্র দায়ী।
আধুনিক ইন্ডিয়ার মিডিয়া বিজেপির আদর্শে উজ্জীবিত। অথচ বাংলাদেশের মিডিয়া নিরুদ্দেশের পথে। এখানকার মিডিয়া কোন পথে যাবে তা নিশ্চিত করেনি। আমরা চলছি মরীচিকার পানে। দেশ ও রাষ্ট্র শূন্যে টিকতে পারে না। যে জাতির দৃঢ় লক্ষ্য নেই, কীভাবে সে সামনের পথে এগোবে?
ইন্ডিয়ার মতলবি মিডিয়ার সয়লাবে আমরা প্লাবিত। আমাদের মিডিয়া ‘নকড আউট’-অথচ তারা বলছে এক সংস্কৃতি, এক ইতিহাস! তাহলে আমরা কেন নেই সেখানে। এটা একটা চালাকি যা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত বুঝে ফেলেছেন। (‘আমি কি বাঙালি’, পৃষ্ঠা ২২৪-২২৫)। এই চালাকি শুধু মিডিয়াওয়ালাদের কারসাজি নয়, ইন্ডিয়ার সওদাগরদেরও। তারাই শুধু তাদের পণ্যের প্রচার চালাবে একশ ভাগ। বাংলাদেশের পণ্যের কথা যেন কেউ না জানতে পারে। এ আর এক কাঁটাতারা, ডিজিটাল কাঁটাতার।
করিডর, ট্রানজিট নৌবন্দর ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় যেমন দ্রুতভাবে এগোচ্ছে তা দেশের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে, তার মূল্যায়ন হচ্ছে না। নবাবী আমলে লাগামহীন বহির্বাণিজ্য বিদেশিদের জন্য অবারিত দ্বার কি ট্র্যাজেডি ডেকে এনেছিল, সে ইতিহাস থেকে কি আমাদের শিক্ষা হয়নি? যে রাষ্ট্রটি হতে পারত সুপার-পাওয়ার, সে হয়ে গেল ‘মিছকিন’ রাষ্ট্র! ট্রানজিট ইত্যাদি ইস্যু বৃহত্তর সার্ক বা জাতিসংঘের আওতায় করা যেতে পারে সময় এলে, কিন্তু তাড়াহুড়ো করে দ্বিপক্ষীয় বা নামকাওয়াস্তে উপ-আঞ্চলিক জোটের মাধ্যমে করলে বড় মোড়লেরই দাপট বাড়বে। এখন বঙ্গবন্ধু নেই যে সাত দফার মতো অনৈতিক চুক্তি ছুঁড়ে ফেলা যাবে। নেপাল, ভুটান, সিকিম কি একটা লিখেছিল, ফলে তাদের অনেক কিছুই আজ আর নেই। আরবদেরও একই অবস্থা। সবার ইতিহাস থেকে আমাদের শিখতে হবে। নইলে ভবিষ্যৎ বংশধররা আমাদের ধিক্কারই দেবে।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন