মূলত নজরুল বিদ্রোহী কবি। তার বিদ্রোহ ছিল সমাজের ও রাষ্ট্রের সব অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আর সেই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই তার স্বাধীনচেতা হৃদয়ের আগুন প্রজ্বলিত হয়েছিল আপন পরাধীন দেশের স্বাধীনতা কামনায়। এমন সরাসরি স্বাধীনতার প্রবক্তা হওয়া তার আমলের আর কোনো কবির পক্ষে সেকালে সম্ভব হয়নি। জমিদার-নন্দন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সাহস করেননি প্রভু ইংরেজরা অসন্তুষ্ট হবেন এমন কোনো কথা উচ্চারণ করার। অথচ বিশের দশকে যখন নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা বের করেছেন তখন সংবাদপত্রে ‘স্বাধীনতা’র কথা বলা রীতিমতো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে কংগ্রেসের জাঁদরেল নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে অটোনমি বা স্বায়ত্তশাসন আর সেলফ গভর্নমেন্টের কথা বললেন, অরবিন্দও তাই বলেছিলেন, আর স্বয়ং এম, কে, গান্ধীও বলেছিলেন, ডোমিনিয়ন স্টেটাস পেলেই তিনি বৃটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক উড়াবেন (১৯২২), অথচ ১৯২১ সালের শেষ সপ্তাহে আহমেদাবাদে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে প্রখ্যাত ঊর্দু কবি ফজলুল হাসান হসরৎ মোহানী তার বক্তব্যে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেছিলেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রুজু করা হয়। একটি ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২৪-এ ধারা রাজোদ্রোহের আর অন্যটি ১২১ ধারা মতে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর। প্রথমটার শাস্তির মেয়াদ যাবজ্জীবন কারাদন্ড আর পরেরটার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। এ মামলার রায় বেরিয়েছিল ১৯২২ সালের ১১ জুলাই। এসব জেনেশুনেও নজরুল ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর তার সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকার ১ম বর্ষ ১৩শ সংখ্যায় ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে লিখলেন, ‘সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করেছেন তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে বোঁচকা পুটুলি বেঁধে সাগর পাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবেন না। তাদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষে করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।’
তৎকালের সংবাদপত্রে এমন দুঃসাহসিক স্বাধীনতা ঘোষণার উচ্চারণ, ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তবে নজরুলের সাহিত্যে দুনিয়ার সকল বঞ্চিত ব্যথিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আপসহীন সংগ্রামে ছিল অবতীর্ণ। স্বাধীনতা বা মুক্তি প্রতিটি মানুষের অধিকার সমন্বিত। নজরুল লড়াই করেন সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায়। আর তা বড়ই সহজ সরল ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দ্বীপান্বিত। ধনবাদী শাসন শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তার মসি ছিল অসির চেয়েও ধারালো। ইসলামে ভোগের চেয়েও ত্যাগ হচ্ছে মোক্ষম কিন্তু এখনকার ভোগবিলাসী মানুষেরা মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে, সত্য পরিহার করে ক্ষুদ্র স্বার্থে এতই প্রমত্ত যে সে মানবিক ভালোবাসার কথাও ভুলে যায়। অমানবিক ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থে এমন কোনো অপরাধ নেই যে সে স্বার্থান্ধের মতো করে না। যার জন্যে এত যুদ্ধ দ্ব›দ্ব সংঘাতে জর্জরিত বিশ্ববাসী। নজরুল নিঃস্বার্থ সাম্যবাদের আলো জ্বালিয়ে জগতে আনতে চেয়েছিলেন আলোকিত জ্ঞানবান সাম্যবাদী মানুষ যার লড়াই হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যেখানে মানুষের জ্ঞানালোকিত স্বাধীনতা থাকবে অবাধ ও পক্ষপাত বিবর্জিত। যেখানে অন্যায়ের কণাটুকুও ঠাঁই পাবে না মনুষ্যত্বের আধারে। নজরুলের সাম্যে ধর্ম-বর্ণ শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থায় সব মানুষ সমান, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য নেই, যেখানে ধর্মের ব্যবধান নেই, কোনো বিভেদ নেই বর্ণের।
গাহি সাম্যের গান-
বুকে বুকে হেথা তাজা সুখ ফোটে, মুখে মুখে তাজা প্রাণ।
বন্ধু এখানে রাজা-প্রজা নাই, নাই দরিদ্র ধনী,
হেথা পায় নাক’ কেহ খুদ ঘাঁটা, কেহ দুধ-সর-ননী।
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গীর্জা-ঘর,
নাইকো পাইক-বরকন্দাজ, নাই পুলিশের ডর।
এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেস্ত, এখানে বিভেদ নাই,
যত হাতাহাতি হাতে হাতে রেখে মিলিয়াছি ভাই ভাই।
নাইকো এখানে ধর্মের ভেদ, শাস্ত্রের কোলাহল,
পাদ্রী-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপটে তিনি সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে ভারতের দুই বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় তথা হিন্দু ও মুসলমান যদি একতাবদ্ধ হয়ে একদেহে একই স্বার্থে স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় তাহলে বৈরী অমানবিক শক্তি নস্যাৎ হতে বাধ্য। তাই তিনি গান বাঁধলেন, ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীতে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী শান্ত্রীরা সাবধান।
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।
(সর্বহারা-অংশবিশেষ)
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অবধি যে মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল বাংলাদেশে তাতে নজরুলের এইরূপ যাবতীয় দেশাত্মবোধক গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের জুগিয়েছিল মহাপ্রেরণা। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের এই মহাঅবদান জাতি মহাশ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অবদানের কথা যখন বলছি, তখন তার মানবতাবাদের কথাও বলতে হয়।
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি;
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
লেখক : প্রবন্ধকার, কবি, অনুবাদক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন