ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য কয়েকটি রপ্তানি পণ্য ও আমদানি পণ্যনির্ভর। পশ্চিম ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ ও উত্তর আমেরিকা আমাদের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য। আমদানি ক্ষেত্রেও এসব দেশের গুরুত্ব কম নয়।
ইদানিং পূর্বের এশীয় দেশ বিশেষ করে ভারত, চীন, জাপানের মতো দেশগুলো বহির্বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। ভারত আমাদের একটি প্রধান বাণিজ্য সহযোগী। এই দেশটির সাথে বাণিজ্য অনেকদিন ধরে একমুখী, অসমতাপূর্ণ। আমাদের আমদানি খুব বেশি এবং রপ্তানি সে তুলনায় খুবই কম এবং এই অসম বাণিজ্য ভারসাম্য নিকট ভবিষ্যতে হ্রাস পাবার সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল নয়।
এরকম প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে আমাদের বাণিজ্যের গন্তব্য এবং উৎস উভয় ক্ষেত্রে কী ধরনের বাঁক নিতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সকল মহলে আগ্রহ রয়েছে। পূর্বদিকের সম্ভাব্য বিস্তার নিয়ে মূলত চীন, ভারত, জাপান এবং দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশগুলোর সাথে আমাদের বর্তমান বাণিজ্যের গতি প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে হবে।
চীন সিল্করুট পুনরুজ্জীবিত করার কর্মসূচি নিয়ে এগুতে চাইছে। একসময় যেসব দেশ যুক্ত ছিল তাদের জন্য এটা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি প্রস্তাব। চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর মূলধনী সামগ্রী যোগান দেয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এসব দেশের অভ্যন্তরে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা এবং মূলধনী দ্রব্যাদির সরবরাহে তুলনামূলক সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রেও তার দক্ষতা প্রমাণিত। জাপানেরও আমাদের মতো দেশগুলোর মধ্যে সব ক্ষেত্রে বাজার খোঁজার তৎপরতা দৃশ্যমান। এ দুই দেশের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশে এখন অনেকগুলো প্রকল্প চালু আছে। উন্নয়নে সাহায্যকারী দেশ হিসেবে ভারতও বিভিন্ন প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে। সবমিলিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিরাট সরবরাহ উপস্থিত। অত্যন্ত সূ²ভাবে নিজ নিজ স্বার্থ সংরক্ষণ করে উন্নয়ন সহযোগী নির্বাচন করার সুযোগ বাংলাদেশসহ উন্নয়নের প্রায় সমান স্তরে অবস্থানকারী এ অঞ্চলের সবকটি দেশের আছে। অতীতের সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত কোনো নীতি প্রাধান্য পেলে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ, পরস্পরের সম্প্রীতি একান্ত অতীত নির্ভর হলে তা যে দাতা-গ্রহীতা উভয়ের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে বাধ্য, এর প্রমাণের অভাব নেই। এরকম এক বাস্তবতায় ‘পশ্চিমমুখী’, ‘পূর্বমুখী’ ধরনের দর্শন থেকে মুক্ত হয়ে নিজের উন্নয়নের স্বার্থ কোথায় নিহিত, সে বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমনির্ভর এক অবস্থানে থেকে এখন আমরা পূর্বে আমাদের জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে দেখছি। সেখানে নিকট অতীতে আমরা ভারতনির্ভর এক অবস্থান থেকে মুক্ত হয়ে এ অঞ্চলেরই অনেকগুলি বিকল্প অবস্থানের প্রস্তাব শুনতে পাই। এরকম একটি পরিস্থিতিই তো চলমান বিশ্বের বাস্তবতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চল অবস্থান কখনই উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে না। এখন যেসব বিকল্প আমাদের সামনে। উন্মুক্ত সেগুলোর নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন সময়ের প্রয়োজন।
অত্যন্ত নিকট অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ভারতনির্ভরতা আমাদের অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করেছে। ভোজ্যতেল, পেঁয়াজের উদাহরণ ইদানিংকার অভিজ্ঞতা। আমরা দেখেছি, আমাদের দেশে পেঁয়াজের অভাবের সময় ভারত রপ্তানি বন্ধ করেছে। ব্যাপারটি কাকতালীয়ও হতে পারে। কিন্তু, অসাধু ব্যবসায়ীদের যোগসাজশও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আরো অনেকগুলো পণ্যের ক্ষেত্রে এরকম একটা বাস্তবতাকে সমর্থন যোগায়। তাই উভয় দেশের সরকারকে বাস্তবতার নিরিখে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক যাচাই করে নিতে হবে। এখানে সাময়িকভাবে শক্তিশালী পক্ষ নিজের শক্তিমত্তা নিয়ে হাজির হলে আর অন্যপক্ষ অর্থনীতিবহির্ভূত অন্য কোনো বিবেচনায় মেনে নিলে তা স্থায়ী সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতের অনমনীয়তা বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হয়েছে। নিকট অতীতে ভারতীয় গরুর উপরে বাংলাদেশের নির্ভরতা এ দেশ ক্রমান্বয়ে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
বাণিজ্যের জন্য স্বাভাবিকভাবে আমরা যে অঞ্চলে বাস করি সে অঞ্চলমুখিই হবো। কিন্তু, সেখানে প্রত্যেকে নিজের স্বার্থ নিয়ে এগুব, পরস্পরের সম্পর্ক দাতা-গ্রহীতা নয়, দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে উভয়ের অগ্রগতি দ্বারা নির্ধারিত হবে।
লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যাঞ্চেলর। প্রফেসর মু. সিকান্দার খানের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে লেখাটি তৈরি। সাক্ষাৎকার গ্রহণে ইনকিলাবের উপ-সম্পাদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান শফিউল আলম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন