অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশস্ত রাজপথ নির্মাণে ইসলামের প্রভাব যে প্রকটভাবে কাজ করেছে তা সবারই জানা। ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজা শশাংক সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েই এ দেশের অধিবাসী বৌদ্ধদের ওপর যে কঠোর অত্যাচার চালান, বহু বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের নিমর্মভাবে হত্যা করে নিজের ভ্রাহ্মণ্যবাদী চরিত্রের মুখোশ যে খুলে দেন, তাও ইতিহাসে লেখা আছে। এমনকি এই নিষ্ঠুর রাজা শশাংক নিজের গাত্রদাহ মিটানোর জন্য অহিংসবাদী বৌদ্ধদের পূত বৃক্ষ বুদ্ধ গয়ার বোধিদ্রুম শেকড়শুদ্ধ উৎপাটন করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। হিন্দু রাজার এই অকথ্য অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেক বৌদ্ধ পরিবার পাহাড়-জঙ্গলে এমনকি দেশান্তরে পালিয়ে যান। জানা যায়, মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মর্দে মুজাহিদের চেতনায় সমৃদ্ধ মাহাথির মুহম্মদের পূর্বপুরুষ এই বাংলাদেশের পাবর্ত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে মালয়েশিয়ায় চলে যান।
বাংলাদেশ এক সময় মাৎস্যন্যায় অবস্থায় দিন অতিবাহিত করেছে, তারপর এখানকার জনগণের মিলিত চেষ্টায় গোপাল নামে এক রাজা শাসন ক্ষমতায় এসেছেন। এখানে কিছুকাল বৌদ্ধ রাজত্ব প্রবহমান হলেও আবার তা কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজত্বে পরিণত হয় সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর এই সেন রাজবংশের অবসান ঘটে মুসলিম বীর সিপাহশালার ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর দ্বারা এখানে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হওয়ার মাধ্যমে। মুসলিম শাসন কায়েমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত হওয়ার দিশা খুঁজে পেল, সত্যিকার অর্থে পরাধীনতার নির্যাতনের নিগড় থেকে মুক্ত হলো, সে রাজাদের জারি করা বর্ণবাদ ও কৌলন্য প্রথার যাঁতাকল থেকে রেহাই পেল।
সেন রাজপুরোহিতদের দ্বারা ব্যাখ্যাত যে শ্রেণি বিভাজন তাতে বলা হয়েছিল : ব্রাহ্মার মস্তক হচ্ছে ব্রাহ্মণ, বাহু হচ্ছে ক্ষত্রিয়, ঊরু হচ্ছে বৈশ্য আর পা হচ্ছে শুদ্র। এ ছাড়া আরও অনুন্নত নি¤œশ্রেণির হিন্দু ছিল, যারা হচ্ছে হাঁড়ি, ডোম, চা-াল বা চাঁড়াল।
এসব নি¤œশ্রেণির হিন্দু সম্প্রদায়কে অতি ঘৃণার চোখে দেখা হতো, এমনকি তাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মানবতা অপমানে গুমরে মরছিল, মূল্যবোধ নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছিল, স্বাধীনতার চিন্তা করাটাও যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল, স্বাধীনতা বলতে কোথাও কিছু ছিল না।
ইসলাম এখানে এসে মানবতার বিজয় বারতা ঘোষণা করল। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের সূচনা হয় ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধির পর থেকেই, তবে আরব বণিকদের দ্বারা এ অঞ্চলে ইসলামের খবর ইতোপূর্বেই এসে যায়। সেসব বণিকের বাণিজ্যে নৌজাহাজ সুদূর চীন-সুমাত্রা অঞ্চল পর্যন্ত যাতায়াত করত বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ছুঁয়ে সেসব জাহাজে দূরপ্রাচ্যে ইসলাম প্রচার করতে যেসব সাহাবায়ে কেরাম যেতেন তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর এলাকায় সফর বিরতি দিয়ে এখানকার মানুষের সামনে ইসলামের বাণী এবং এর সৌন্দর্য তুলে ধরতেন। তারা বোধ করি বাংলাদেশের উপকূলীয় বন্দর ছাড়া ভেতরে প্রবেশের মওকা পাননি সময়ের অভাবে। কারণ তাদের গন্তব্যস্থল ছিল দূরপ্রাচ্য। তখন চীন দেশের শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল। সেসব সাহাবায়ে কেরামের মাযার শরিফ আজও চীনের ক্যান্টন নগরীর ম্যাসেঞ্জার মসজিদ প্রাঙ্গণে যতেœর সঙ্গে সংরক্ষিত আছে।
বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দীন আযম শাহের ইন্তেকালের পরে সুলতানের অমাত্য দিনাজপুরের ভাতুড়িয়ার জমিদার কংশনারায়ণ গণেশ বাংলার মসনদ দখল করলে পীরে কামিল হযরত নূর কুতবুল আলম রহমাতুল্লাহি আলায়হি এই অত্যাচারী রাজা গণেশকে উৎখাত করার জন্য জৌনপুরের শাসনকর্তা ইবরাহীন শরকীকে পত্র দেন। পত্রে তিনি লেখেন : প্রায় তিনশ বছর হয়েছে বাঙ্গালায় ইসলামের শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে, কিন্তু অতি সম্প্রতি এখানে ঈমানকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সত্য-সুন্দরের শত্রুদের কালো থাবা এ দেশটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, দেশজুড়ে আঁধার নেমে এসেছে, মুসলিমদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর ওপর মারাত্মক আঘাত এসেছে। ইসলামের আলোক-প্রদীপ এখানকার মানুষকে যে সত্য পথের দিশা দিয়ে আসছিল আজ তা হুমকির মুখে। এই মহাদুর্দিনে আপনি কেমন করে নির্বিঘেœ মসনদে আসীন থাকতে পারেন? আপনি আপনার ওই সুখের মসনদ থেকে উঠে আসুন। দীনকে সংরক্ষণের জন্য আপনি অতিসত্বর এগিয়ে আসুন। আপনার তরবারি কোষবদ্ধ না রেখে কুফরের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা নির্বাপণে আপনি জোর কদমে অগ্রসর হোন। আপনি তো জানেন, বাঙ্গালা হচ্ছে পৃথিবীতে বেহেশত। কিন্তু সেই বেহেশতে এখন দোজখের কালো ছায়া ছেয়ে ফেলছে। এখানে অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন আর হত্যাকা-ের যে কা-কারখানা চলছে, তা দমন করতে আপনি আসুন। আরামের মসনদে আর এক পলকও বসে থাকবেন না।
সেই দীর্ঘ ও জ্বালাময়ী পত্র পেয়ে ইবরাহীম শরকী কোনোরূপ কালক্ষেপণ না করে বিরাট বাহিনী নিয়ে বাঙ্গালার বিপন্ন স্বাধীনতাকে বিপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে এলেন। এ খবর পেয়ে সমূহ বিপদের আশঙ্কা করে জানে মরার ভয়ে কংশনারায়ণ গণেশ হযরত নূর কুতবুল আলম রহমাতুল্লাহি আলায়হির দরবারে এসে ক্ষমা চাইল এবং তার পুত্র যদুকে মুসলিম করে নেয়ার জন্য অনুরোধ করল। হযরত নূর কুতবুল আলম (রহ.) যদুকে ইসলামে রায়’আত করলেন এবং তার নাম রাখলেন জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ। এ খবর পেয়ে ইবরাহীম শরকী জৌনপুরে ফিরে গেলেন।
বাঙ্গালার ৫৫৬ বছরের মুসলিম সুশাসনের মাঝখানে মাত্র ৩-৪ বছর বর্ণহিন্দু শাসন একটি দুঃস্বপ্নের মতো কিংবা একটি ছন্দবদ্ধ সুন্দর দীর্ঘ কবিতায় একটি মাত্র পঙ্্ক্তিতে একটি মাত্রার হেরফের হওয়ার মতো সামান্য ছন্দ পতনের মতোন। ইতিহাসে রাজা গণেশ ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
স্বাধীন বাঙ্গালার দিকে নজর পড়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। তারা হিন্দু কয়েকজন প্রভাবশালী অমাত্য ও জগৎশেঠদের সাথে আঁতাত করে এবং মসনদের লোভ দেখিয়ে মীর জাফরকে দলে ভিড়িয়ে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে এক প্রহসনমূলক যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার কাছ থেকে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য হরণ করে নেয়। স্বাধীন বাঙ্গালা, শাহে বাঙ্গালা, সুলতানে বাঙ্গালা পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ হয়। নানা প্রকার দমননীতি প্রয়োগ করে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালানো হতে থাকে। কিন্তু মুসলিমদের তারা দমাতে পারেনি। ইসলামের শিক্ষায় উজ্জীবিত মীর কাসিম, সুফী দরবেশ কফীর মজনু শাহ্্, বিজ্ঞ আলিম হাজী শরীয়াতুল্লাহ মর্দে মুজাহিদ সৈয়দ সিনার আলী তিতুমীর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, জিহাদের ডাক দিয়েছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ নির্মাণ করতে করতে অগ্রসর হয়েছেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি জনতার মহাবিপ্লবের নেতৃত্বে সুফী দরবেশ, আলেম-ওলামার থাকার কথা সর্বজনবিদিত। পীর মুহসিন উদ্দীন দুদু মিয়া বন্দী হয়েছেন, তার পরের ইতিহাস নতুন কৌশলে সংগ্রামের ইতিহাস। হাজী শরীয়াতুল্লাহ এ দেশকে হারুল হরব ঘোষণা করে জিহাদের যে ডাক দিয়েছিলেন, তা এ দেশের মানুষকে যে মাত্রায় স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্পৃহা জাগিয়েছিল ঠিক একই মাত্রায় একটু কৌশলের ভিন্নতা এনে মওলানা কারামত আলী (রহ.) এ দেশকে হারুল আমান বা নিরাপদ ভূমি ঘোষণা করে মুসলিমদের স্বার্থ উদ্ধারের পথ নির্মাণ করে দিলেন। নবাব আবদুল লতিফ তাঁর দু’য়া গ্রহণ করে যে শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা করলেন, তারই পথ-পরিক্রমে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে মুসলিমদের প্রথম রাজনৈতিক দল গঠিত হলো। এই সম্মেলনের আহ্বায়ক ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ডায় ভঙ্গভঙ্গ বিষয়ক আলোচনা রাখার প্রস্তাব দিয়ে পত্র পাঠালেন; যাতে বললেন, মুসলিমদের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন না থাকায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে যে বঙ্গভঙ্গ হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ববাংলা প্রদেশ গঠিত হয়েছে, ঢাকা তার রাজধানী হয়েছে, তার বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস আন্দোলন করেছে, কিন্তু আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এজেন্ডায় এ বিষয়টি যুক্ত করার কথা লিখে পত্র দিলেন।
আমরা লক্ষ্য করি সব আন্দোলনেই ইসলামের প্রভাব সক্রিয় ছিল। মওলানা ভাসানীর ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে আস্সালামু আলায়কুম বলা, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবের ইনশাল্লাহ্্ বলা, ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে মওলানা ভাষানীর লাকুম দিনিকুম ওলিয়াদীন বলা, মেজর জিয়ার সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাস থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইশতেহার ও নির্দেশাবলিতে আল্লাহ আমাদের সহায়, নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুনকারীব’ প্রভৃতি লিপিবদ্ধকরণের মধ্যে ইসলামের বৈপ্লবিক চেতনার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়, বিশেষ করে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এক নির্দেশাবলিমূলক ইশতেহারের শীর্ষে লেখা ছিলÑ আল্লাহু আকবার এবং শেষ করা হয়েছিল এই বলেÑ আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী। এসব প্রেক্ষিতেই বলা যায়, প্রায় তিন লাখ মসজিদের এই দেশ, শত শত আল্লাহর ওলির স্মৃতিধনা এই দেশ তার স্বাধীন সত্তা মুখ্যত লাভ করেছে ইসলামের প্রভাবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেতারে বার বার গাওয়া হতো : ওলি আল্লাহর বাংলাদেশ। শহীদ গাজীর বাংলাদেশ/রহম করো, রহম করো, রহম করো আল্লাহ।
লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন