ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় দু’ হাজার সেতু নির্মাণের সুপারিশ করেছেন সংসদ সদস্যগণ। এলজিইডিতে জমা হওয়া এসব সুপারিশের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই অপ্রয়োজনীয় বলে প্রাথমিক মূল্যায়নে ধরা পড়েছে। সাধারণত হাটবাজার, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তায় সেতু নির্মাণে আগ্রাধিকার দিয়ে থাকে এলজিইডি। সংসদ সদস্যদের সুপারিশ মূল্যায়ণে দেখা গেছে, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ বা হাসপাতাল নেই এমন স্থানেও সেতু নির্মাণের অনেক সুপারিশ করেছেন তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সুবিধায় সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিক অপয়োজনীয় সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। জনস্বার্থে সড়ক-সেতু ইত্যাদি নির্মাণ করার সুপারিশ সংসদ সদস্যগণ করতে পারেন বা করে থাকেন। তবে নিয়মবিধি লংঘন করে এ ধরনের সুপারিশ তারা করতে পারেন কিনা সেটা অবশ্যই একটা বড় প্রশ্ন। এলজিইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, অপ্রয়োজনীয় এসব সেতু নির্মাণ করা হলে সরকারী অর্থের অপচয় যেমন হবে তেমনি জনগণের ভোগান্তিও বাড়বে। এইসঙ্গে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর। এমন কি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ফলে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। যে সব সেতু অপ্রয়োজনীয়, যাতে মানুষের কোনো উপকার হবে না, উল্টো তাতে পরিবেশ-পরিবেশের ক্ষতি হবে, মানুষের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা বাড়বে যে সব সেতু নির্মিত হতে পারে না। এমন অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর সেতু নির্মাণের সুপারিশ সংসদ সদস্যগণ কীভাবে করতে পারেন সে প্রশ্ন আমরা তাদের কাছেই রাখতে চাই। সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব যে এক্ষেত্রে প্রকট, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হতে পারে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যই তারা এ ধরনের সুপারিশ করেছেন। প্রশ্ন হলো, এমন প্রতিশ্রুতি তারা দেবেন কেন যা বাস্তবায়নে সরকারী অর্থের অপচয় হবে, পরিবেশ-প্রতিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এবং তাতে মানুষেরও কোনো উপকার হবে না?
জানা গেছে, আগে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা ছাড়াই সেতু নির্মাণ হতো। সমীক্ষা না করে সেতু নির্মাণের ফলে সরকারী অর্থের অপচয়সহ পরিবেশক্ষতি ও জনভোগান্তি বাড়ার ভুরি ভুরি, নজির রয়েছে। এমনও দেখা গেছে, রাস্তা নেই অথচ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তাবিহীন সেতু ঠাই দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর। এমনও দেখা গেছে, সেতু নির্মিত হয়েছে অথচ সংযোগ সড়কের কোনো খবর নেই। এরকম অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় সেতুর বিষয়ে ছবিসহ পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সরকারী মাল দরিয়ায় ঢাল, এ প্রবাদের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সরকারী মাল শুধু দারিয়াতেই যায় না, অপ্রয়োজনীয় সড়কে, সেতুতে এবং অন্য অনেক ক্ষেত্রেও যে যায়, তা আমাদের অজানা নেই। সড়ক, সেতু কিংবা বাঁধ নির্মাণ মানেই টাকার খেলা। অভিযোগ রয়েছে, এসব কাজের ক্ষেত্রে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারা যোগসাজস করে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা বড় অংশই সরিয়ে নেয়। কাজে থাকে বিরাট ফাঁকি এবং কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন থাকে। রাস্তা-বাঁধ নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট গেছে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। সেতু নির্মাণের সময় তা ধসে পড়ার নজিরও বিরল নয়। নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্ধারিত বাজেটে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ বা উন্নয়ন কল্পনার অতীত। সময় ও বাজেট বাড়িয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশে ওপেন সিক্রেট। এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের শত শত অভিযোগ থাকলেও অতীতে কোনো প্রতিকার হয়নি; ভবিষ্যত হবে, এমন সম্ভাবনাও শূণ্য।
এ বছর নির্বাচনের বছর হওয়ায় সরকার সকল উন্নয়ন প্রকল্প নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন করার কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে সকল মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডিজি, বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের চিঠি দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, জুন-জুলাইয়ের মধ্যেই সকল প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চায় সরকার। অন্য এক খবরে জানা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় অংকের পরামর্শক ব্যয় নিধারণ করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু নির্বাচনের বছর এলেই তা শেষ করতে হবে কেন? পর্যবেক্ষকদের মতে, এক্ষেত্রে সরকারী অর্থের বড় ধরনের অপচয় ও লুটপাট হতে পারে। নির্বাচনের বছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, এই ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকারের হাতে আছে কিনা। থাকলেও অপচয় ও লুটপাটের ঝুঁকি নেয়া উচিৎ কিনা। অর্থনীতিবিদরা এর মধ্যেই অর্থনীতির বিষয়ে যেসব মতামত দিয়েছেন, তা উদ্বেগজনক। নানা শংকা ও সংকটের কথা তারা বলেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন সংরক্ষণবাদী নীতি অনুসরণ করার। আমরা মনে করি, এই প্রেক্ষাপটে সরকারকে অধিক সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে পরিমিতরোধের পরিচয় দিতে হবে। পরিশেষে আমরা বলবো, সংসদ সদস্যগণ যে শত শত অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণের সুপারিশ করেছেন তা যাতে বেদনাভাবেই হতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সমীক্ষা ছাড়া সেতু নির্মাণ করার বিধিব্যবস্থা যেহেতু এখন আর নেই সেক্ষেত্রে এলজিইডির অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণের সুপারিশ বিবেচনায় নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাকে এ ব্যাপারে দৃঢ় থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন