ডা. লায়লা পারভীন বানু, প্রিন্সিপাল, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ
ডা.লায়লা পারভীন বানু, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল। এর থেকে বড় পরিচয়, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের এই মেয়েটি দেশের প্রয়োজনের সময় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন চার শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মীদের।
২৬ মার্চ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও রাজশাহী শহর ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। পরদিন ১৪ এপ্রিল সকালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রাজশাহী অফিসের সামনে এসে থামে হানাদার বাহিনীর ট্রাক। ট্রাক থেকে নেমে আসে নরপিশাচরা। একে একে পাঁচজন অফিসারকে টেনেহিঁচড়ে অফিসের সামনেই লাইন করে দাঁড় করায়। ওই পাঁচজনের মধ্যে তাঁর বাবাও ছিলেন। নিমেষেই গর্জন করে উঠল মেশিনগানগুলো। লুটিয়ে পড়লেন সবাই। ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন তাঁর বাবা ও গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক।
এই করুণ কাহিনীর কথা স্মরণ করে ডা. বানু বলেন, লাশ দুটি ফেলে রাখা হলো দুই দিন। বাসার সামনে লাশ থাকলে, পাকবাহিনী ভিতরে আসবেনা ভেবে দাফনের উদ্যোগ নিল না কেউ। ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যার পর লাশভর্তি ট্রাক নিয়ে উপস্থিত হলো পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু লাশ দুটি ট্রাকে না উঠিয়ে রাস্তার পাশেই অল্প জায়গায় গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে মাটিচাপা দিল। তাঁদের দাফনও হলো না। আমার চোখ ফেটে পানি এল। ১৬ এপ্রিল কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিলে রাজশাহীর সাগরপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে চলে যান লায়লা পারভীন বানু।
২৪ মে পাকিস্তানি সেনারা সব গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপরই আরো এক হৃদয়বিদারক ঘটনার খবর আসে ডা. বানুর কাছে। খবর পান, তাঁর দাদাকে লুঙ্গি প্যাঁচানো অবস্থায় গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। বাবা ও দাদার এমন করুণ মৃত্যুই তাঁকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বেশি করে উৎসাহ জোগায়।
জুনের প্রথম দিকে গোবরা ক্যাম্পে হাজির হন ডা. বানু। সেখানে সেবামূলক, আত্মরক্ষামূলক ও প্রাথমিক চিকিৎসার এবং সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর কল্যাণে তিনি সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন ডা. লায়লা পারভীন বানু। তাঁর ভাষায়, প্রশিক্ষকরা ক্লাস নিয়ে চলে যাওয়ার পর মেয়েদের সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। এ ছাড়া সেবামূলক প্রশিক্ষণের জন্য মেয়েদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কোনো মেয়ে অসুস্থ হলে চিকিৎসা করা, প্রয়োজনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং ক্যাম্পের জন্য দরকারি ওষুধপত্র নিয়ে আসা ইত্যাদি কাজ করতে হতো আমাকে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, আদর্শগতভাবে ও মানসিকতায় মানুষ এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। টাকার দরকার আছে। কিন্তু সবাই তো টাকার পিছনে দৌড়ায় না। অনেকে কাজ করছে মানুষের সেবার জন্য। আসলে মানুষ পরিস্থিতির সাথে তার প্রতিক্রিয়া জানায়। তখন যুদ্ধ ছিল, সবাই এগিয়ে এসেছিল। তেমন পরিস্থিতি এখন হলেও সবাই এগিয়ে আসবে। কারণ বাঙ্গালীরা আবেগপ্রবণ। বস্তুত দেশের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ধনী-গরিব বৈষম্য দূর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তি এখনো তৈরি হয়নি। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি নিয়ে তিনি বলেন, দেশের জন্য দেওয়া রক্তের বিনিময় হয় না।
ষ মেহেদী তারেক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন