ইনকিলাব ডেস্ক : রাখাইন অঞ্চলের গু দার পিন গ্রামে যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান চালায়, তখন নূর কাদির এবং তার আরো ১৪ বন্ধু একটি ফুটবল টিমের জন্য খেলোয়াড় বাছাই করছিলেন। টিনের চালে বৃষ্টি হলে যে ধরনের শব্দ হয়, ঠিক ঐ রকম গুলির আওয়াজ শুরু হওয়ার পর সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। নূর কাদির এবং দুই বন্ধু সেখান থেকে কোন রকমে বেঁচে যান। এর কয়েকদিন পরে নূর কাদির দু’টি কবরে তার ছয়জন বন্ধুর লাশষ আবিষ্কার করেন।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বা এপি বলছে, নূর কাদিরের মতো এ ধরনের বর্ণনা আরও অনেক রোহিঙ্গার কাছ থেকে তারা শুনেছে। এপি জানিয়েছে, মিয়ানমারে নতুন করে কিছু গণকবরের প্রমাণ তাদের হাতে এসেছে। বার্তা সংস্থাটি বলছে, তারা যেসব তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে তাতে মনে হচ্ছে গত আগস্ট মাসে সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন রাজ্যের গু দার পিন গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। এপির ভাষ্য অনুযায়ী, স্যাটেলাইটে পাওয়া চিত্রের সাথে এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বর্ণনা মিলে যাচ্ছে। স্যাটেলাইটের চিত্র এবং রোহিঙ্গাদের ভাষ্য অনুযায়ী অন্তত পাঁচটি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। এসব গণকবরে ৪০০’র মতো মানুষকে চাপা দেয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন রোহিঙ্গা যুবক নূর কাদির। তিনি গণকবরে তার বন্ধুকে চিহ্নিত করেছেন। তবে নূর কাদিরের বন্ধুর চেহারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তার মুখের একটি অংশ অ্যাসিডে দগ্ধ এবং বুলেটবিদ্ধ। বন্ধুর কাপড় দেখে তাকে চিনতে পারেন নূর কাদির। তিনি বলেন, ‘কবরের ভেতরে লাশগুলোকে স্তূপ করে রাখা হয়েছিল’।
যে গ্রামটির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেয় না মিয়ানমার সরকার। সুতরাং ঐ গ্রামে আসলে ঠিক কতজন মারা গেছে, তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বলছে, তারা ঐ গ্রামের স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া কিছু ছবি সংগ্রহ করেছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবার কিছু ভিডিও-ও তাদের হাতে এসেছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গারা ৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য একত্রিত করেছে।
গ্রামবাসীরা বলছে, মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪০০’র মতো হবে। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং সরাসরি লাশ দেখার ওপর ভিত্তি করে তারা এসব কথা বলছেন।
বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বলেছে, বাংলাদেশে অবস্থানরত যেসব রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই বলেছেন যে, গু দার পিন গ্রামের উত্তরদিকে যে প্রবেশপথ রয়েছে, সেখানে তারা তিনটি বড় গণকবর দেখেছেন। ঐ জায়গায় অধিকাংশ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা। অল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন যে, পাহাড়ের কাছে একটি কবরস্থানে তারা দুটি কবর দেখেছেন।
জায়গাটি গ্রামের একটি স্কুলের কাছাকাছি। গ্রামে হত্যাকান্ড চালানোর পর ১০০’র বেশি সৈন্য ঐ স্কুলে তাদের ঘাঁটি গেড়েছিল। ঐ গ্রাম থেকে যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে জীবন বাঁচিয়েছেন, তাদের ধারণা, আগস্ট মাসের ২৭ তারিখের হত্যাকান্ড ছিল বেশ পরিকল্পিত। হত্যাকান্ড চালানোর জন্য সৈন্যরা শুধুই রাইফেল, ছুরি, গ্রেনেড এবং রকেট লঞ্চার আনেনি - সাথে অ্যাসিডও নিয়ে এসেছিল তারা। অ্যাসিড দিয়ে নিহতদের মুখমন্ডল এবং শরীরের অংশ ঝলসে দেয়া হয়, যাতে তাদের চিহ্নিত করা না যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০০ সৈন্য ঐ হত্যায় অংশ নিয়েছিল।
হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে গেছেন ২৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ রইস। তিনি বলেন, ‘মানুষজন তখন চিৎকার করছিল, সৈন্যদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছিল’।
এদিকে জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা গণহত্যার চিহ্ন। তিনি বলেন, গণহত্যার খবর অবশ্যই গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা উচিত। সূত্র : বিবিসি।
রোহিঙ্গাদের বাড়িতে ফের আগুন দিলো মিয়ানমার সেনাবাহিনী
মোঃ সাদাত উল্লাহ, বান্দরবান থেকে জানান, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে নতুন করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এছাড়া তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইন বরাবর দুই দিন থেকে থেমে থেমে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করছে সে দেশের সেনাবাহিনী ও বিজিপির সদস্যরা।
এতে তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে বসবাসকারী ৬ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা আবারও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত বুধবার বিকেলে তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের ঢেকুবনিয়া এলাকায় নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। রাতেও আগুন দেয়া হয় ঘরবাড়িতে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওই এলাকায় জ্বালানো ঘরবাড়িগুলো থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। সীমান্তের ওপার থেকে আতঙ্কে জিরো লাইনে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে চলে এসেছে বেশ কিছু রোহিঙ্গা।
ঘুনধুম ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, বুধবার বিকেলে তুমব্রু সীমান্তের ওপারে কিছু ঘরবাড়িতে প্রথম আগুন দেয়া হয়। পরে রাতেও সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ওই এলাকার ইউপি সদস্য আবদুর রহিম জানান, মিয়ানমারে এখনো রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। তবে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকলেও আবারও সীমান্তের ওপারে ঘরবাড়িতে নতুন করে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আবু ইউসুফ জানিয়েছেন, জিরো লাইনে বসবাসকারীদের চলে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও বিজিপি বারবার হুমকি দিচ্ছে। প্রায় সময় ক্যাম্পগুলো থেকে আচমকা গুলিবর্ষণ করা হয়। বুধবার রাতেও বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করা হয়েছে সীমান্তের ওপার থেকে। তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা এখন চরম আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
তুমব্রু বাজারের বাসিন্দা মো. সফি জানান, গত কয়েক দিন আগে লাকড়ি কুড়ানোর জন্য শিবির থেকে কিছু রোহিঙ্গা তারকাঁটা বেড়া অতিক্রম করে ওপারে গেলে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো তাদের ছেড়ে দেয়নি বিজিপির সদস্যরা। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তুমব্রু ও ঘুনধুম সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিজিপি সদস্যরা ক্যাম্পগুলো থেকে থেমে থেমে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। তুমব্রু সীমান্তের ওপারে প্রচুর সংখ্যাক মায়ানমারের সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে সহিংসতার পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ১৫ হাজারেও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান নেন। এদের মধ্যে সাপমারা ঝিড়ি, বড় ছনখোলা এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে সরিয়ে নেয়া হলেও তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে এখনো ছয় হাজারেও বেশি রোহিঙ্গা রয়ে গেছেন। এদের কবে নাগাদ সরিয়ে নেয়া হবে তা এখনো জানাতে পারেনি প্রশাসন।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলিপ কুমার বণিক জানান, ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশন ইতোমধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে সরিয়ে নিয়েছে। খুব শিগগির অন্য রোহিঙ্গাদেরও সরিয়ে নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিজিবির কক্সবাজার সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবদুল খালেক জানান, ওপার থেকে প্রায় সময়ই গুলির শব্দ শোনা যায়। নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে খবর নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিজিবি সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানান সেক্টর কমান্ডার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন