এ বছরের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং সংসদের বিরোধী দল ও সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। গত ৩০ জানুয়ারি সিলেটে মাজার জেয়ারত ও জনসভার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং গত ১ ফেব্রæয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। সরকারী সুযোগ-সুবিধা নিয়েই এই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি চলমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবী করার পাশাপাশি দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ মামলার রায় ও আদালতে হাজিরার বিষয় নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। বলা যায়, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে এক ধরনের বৈপরিত্য ও ভারসাম্যহীন পরিবেশ বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, বিএনপি একটি বড় দল, তাদের ছাড়া সব দলের অংশগ্রহণ হয় কী করে? বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। অন্যদিকে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য চলছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গত শুক্রবার বলেছেন, বিএনপির কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তারা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার টালবাহানা করছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন চাই, যা হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ। অবশ্যই তা হতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাইরে রেখে। এটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা অন্য নামেও ডাকা যেতে পারে।
বহুদিন ধরেই সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাকিদ রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সচেতন ও সুশীল সমাজসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে দেয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতার বিতর্কিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে এ মতামত ব্যক্ত হচ্ছে। অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বরাবরই এ দাবী করে আসছে। তাদের এ দাবীর যৌক্তিকতা সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থক শ্রেণী ছাড়া অন্য সবাই একমত পোষণ করেছে। বিএনপির দাবী নিরপেক্ষ সরকারের অধীন ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো ধরনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। এ ধরনের নজির আমাদের দেশে স্থাপিত হয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ দাবী প্রত্যাখ্যান করে নিজের অধীনেই নির্বাচন করার পক্ষে অনড় অবস্থান নিয়েছে। এই অনড় অবস্থানে থেকেই ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে। দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না, তা ঐ নির্বাচনে ভোটারবিহীন অবস্থায় ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্ব›দ্বীতায় নির্বাচিত হওয়া থেকেই প্রমাণিত হয়েছে এবং এ নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এর ফলে বিএনপি ও তার জোটের দাবীর বিষয়টি যৌক্তিকতা পায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বড় দুটি দলের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার কারণেই সর্বসম্মতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তা বাতিল করে। আদালত আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে অভিমত দিয়েছিল। সরকার এ বিষয়টি আমলে নেয়নি। সেই থেকে মূলত রাজনীতিতে এক ধরনের অচলায়তনের সৃষ্টি এবং বড় দুইটি দলের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রের ভিত্তি এতটা মজবুত হয়ে উঠেনি যে দলীয় সরকারের অধীনে রাজনৈতিক দলগুলো সানন্দে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যদি পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন না হয়, তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি এক প্রকার অসম্ভব। এই দুই দলের কোনো একটি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তবে সে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলে ধরে নেয়া যায় না। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচন যেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, তেমনি ২০১৪ সালে বিএনপি বিহীন নির্বাচনও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এটা ঐতিহাসিক সত্য। এর কারণ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। উভয় দলের ভোটার সংখ্যা প্রায় ফিফটি-ফিফটি। এ বাস্তবতায়, যে কোনো একটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিষয়টি উপলব্ধি করেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে আশাপ্রদ হলেও, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব রয়েছে। নির্বাচনের এখনো প্রায় দশ মাস বাকী। এই দশ মাসে অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেশের মানুষ পর্যবেক্ষণ করবে। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ভূমিকা পালনে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারের দৃঢ়তা ও দক্ষতার উপরই সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। সরকারের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি নিজের উপর অর্পিত ক্ষমতা যদি যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা অসম্ভব কিছু নয়। অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে। ক্ষমতাসীন দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলও প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাব বিবেচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তা দৃঢ়তার সাথে নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না, এ কথা ক্ষমতাসীন দলকে জানাতে ও বোঝাতে হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা কেবল মুখে বললে হবে না, বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এ জন্য তার কনভিন্স করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচনের সময় সব দলের অংশগ্রহণের জন্য কীভাবে সমতল ভূমি প্রস্তুত করা যায়, তার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সক্ষমতা সরকারকে দেখাতে হবে। তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে দেশের স্বার্থে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা অপরিহার্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন