‘কোনো অ্যাপই আপনার কোলের বিকল্প নয়, আপনার শিশুর কাছে পড়ুন’- এ চমৎকার উক্তিটি আমার খুব প্রিয়। হ্যাঁ, শিশুদেরকে বিনোদনের জন্য স্মার্ট ডিভাইস দেয়া বা কার্টুন দেখতে দেয়ার বেলায় আমি খুব পুরনো দিনের মানুষ। আমি চাই যে বাবা-মা’রা ছেলেমেয়েদের সময় দেয়ার জন্য নিজেদের আরাম ত্যাগ করে তাদের সাথে সময় কাটান, তারা যেন তাদের স্মার্ট ডিভাইসগুলোর কাছে ছেড়ে না দেন। আমি মনে করি এই ডিজিটাল যুগেও শিশুদের বই পড়ে শোনানো বাবা-মা’র প্রতিদিনের দায়িত্ব হওয়া উচিত।
বাবা-মা যখন কাজে থাকেন তখন শিশুদের স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করতে দেয়ার পক্ষে লোকজনের বহু যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে। এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। স্মার্ট ডিভাইস একেবারে সম্পূর্ণ নতুন জিনিস, তার আগে বাবা-মা’রা কিভাবে শিশুদের সমাল দিতেন? সে সময় কি ছেলেমেয়েদের প্রয়োজন ও চাহিদা ভিন্ন ছিল? হ্যাঁ, তাই।
বাংলাদেশের পরিবেশ বিদেশের মত নয়। এ দেশে মায়েদের এমন পরিবেশে বাস বিরল যেখানে তাকে বাইরে কাজ করার পরও একা শিশুর যত্ন নিতে, রান্না করতে, কাপড় কাচতে,লন্ড্রি করতে ও বাড়িঘর পরিষ্কার করতে হয়। একজন আমেরিকান বা ইউরোপীয় বাবাকে দৈনন্দিন যে সব দায়িত্ব পালন করতে হয় সে রকম একজন বাংলাদেশী বাবাকে বাড়ির কাজ করতে হয় না। তাই আমি এ যুক্তি মানতে স্রেফ নারাজ যে ব্যস্ত জীবনে ছেলেমেয়েদের জন্য একটু সময় খুঁজে বের করা অসম্ভব।
স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের বিষয়ে গবেষণার কোনো অভাব নেই। একই সাথে এটা প্রমাণ করে গবেষণারও অভাব নেই যে শিশুরা বই পড়লে তা বিভিন্ন ভাবে তাদের উন্নয়নে সাহায্য করতে পারে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে শৈশবের উন্নয়নে বই পড়া যে সব সর্বোত্তম পন্থায় সাহায্য করে তা হচ্ছে-
বই পড়ার মাধ্যমে বন্ধন সৃষ্টি
ভ্রূণ শিশুও শব্দ শুনতে পায়। যে মা তার গর্ভাবস্থার তৃতীয় পর্যায়ে আছেন তার শান্তভাবে জোরে পড়া ভালো। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু তাতে শিশু মায়ের কণ্ঠ শুনতে অভ্যস্ত হয়। সে যখন আকস্মিক ভাবে মায়ের আরামদায়ক গর্ভ থেকে এই উজ্জ্বল, বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে আসে তখন মায়ের সেই কন্ঠস্বর হয় তার শান্তির উৎস। আমি স্মরণ করি যে আমার কন্যা শিশু যখন সি-সেকশনের পর আমার গর্ভ থেকে জন্ম নিলো সে তখন প্রচণ্ড চিৎকার করছিল। আমি খুব বিপর্যস্ত থাকলেও একটি শব্দ বলতে পেরেছিলাম- মাম্মাম এবং সাথে সাথে সাথেই তার কান্না থেমে গিয়েছিল। আমার কয়েক মিনিট বয়সের শিশু আমার গলা সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। আমার কাছে তা আল্লাহর কুদরতের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না।
শব্দভাণ্ডার গঠন
আপনি একটি শিশুর কাছে তার যত কম বয়স থেকে পড়বেন সে তত বেশি শব্দ শিখবে। আপনি যদি তিন মাসের সময় একটি শিশুর কাছে একটি ছবির বই পড়েন, সে ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিক্রিয়া সম্ভবত হবে না। কিন্তু শিশু শিখছে। ছবির দিকে নির্দেশ করতে থাকুন। কথাগুলো বারবার পড়–ন। শিশু খুব শিগগিরই শব্দের ধ্বনি এবং ছবির সাথে শব্দের সম্পর্ক চিনতে শিখবে। আর এভাবে তার শব্দভাণ্ডার গড়ে উঠবে।
কথা বলা শেখা
প্রায়ই এমন ঘটে যে যেসব শিশুর কাছে বেশি পড়া হয় ও কম বয়স থেকে পড়া হয় , তারা তাড়াতাড়ি কথা বলা শেখে। তবে প্রত্যেক শিশুই আলাদা এবং তাদের বিকাশও আলাদা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পড়া শিশুর ভাষাগত দক্ষতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দ্রুত পড়তে শেখা
যেসব শিশুর কাছে নিয়মিত ভাবে পড়া হয় তারা অক্ষর চেনার আগেই শব্দ চিহ্নিত করতে পারে। এটা শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। ছবির আকারে কোনো শব্দ দেখানো হলে শিশুরা নির্দিষ্ট শব্দগুলো চিনতে শেখে। যদি কোনো বাবা-মা আপেলের ছবি দেখাতে থাকে এবং তার সাথে আপেল শব্দটি বারবার বলে তখন একটা সময় আসবে যখন শিশু আপেলের ছবি দেখা ছাড়াই এবং আপেলের বানান কিভাবে করা হয় তা না জেনেও আপেল শব্দটি চিনতে সক্ষম হবে। তবে এটা আপনাআপনি ঘটে না, এক্ষেত্রে বাবা-মার চেষ্টা দরকার হয়। বাবা-মাকে ধৈর্য না হারিয়ে অব্যাহত ভাবে শিশুকে পড়ে শোনাতে হবে। কঠোর পরিশ্রমের পরই ভালো ফল আসে।
শিশুর কাছে পড়ার নানা রকম সুফল আছে। এর পেছনের বৈজ্ঞানিক যুক্তি ব্যাখ্যা করে বহু গবেষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাবা-মা তাদের প্রিয় শিশুর জন্য তাদের সময় ব্যয় করতে এবং প্রাত্যহিক রুটিনের অংশ হিসেবে তাদের শিশুর কাছে পড়তে চান কি না তা তাদের উপর নির্ভর করে।
প্রচলিত ভাবে বাংলাদেশী বাবা-মার শিশুদের প্রথম শৈশব উন্নয়নের (আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট-ইসিডি) প্রতি গুরুত্ব¦ দানের ব্যাপার বিরল। তিন মাস বয়সী শিশুর উদ্দেশ্যে বই পড়া এক বোকামির কাজ বলে মনে করা হয়। কিন্তু সময় পাল্টাচ্ছে। আমাদের প্রজন্মের অনেক বেশি বাবা-মা ইসিডি বিষয়ে সচেতন ও যত্নবান। দুর্ভাগ্যবশত এটা সে সময় যখন আমাদের প্রত্যেকের কাছে স্মার্ট ফোন সহজলভ্য। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই সহজ পথ অবলম্বন করতে এবং শিশুদের আইপ্যাডে ব্যস্ত রাখি।
শিশুদের কার্টুন দেখতে দেয়াটা সহজ। কিন্তু শিশুকে বই পড়ে শোনানোর সময় আপনার মাথা ও হাত নাড়ানো এবং ছবির সিংহের মত গর্জন করা কঠিন। বাবা-মা’র উপরই এটা নির্ভর করে যে তারা আসলে সহজ পথ না কঠিন পথ কোনটা অবলম্বন করবেন। কিন্তু শিশুর পরবর্তী জীবনে উভয় পথেরই অত্যন্ত পৃথক ফল হয়ে থাকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন