বিরোধ-বৈচিত্রের সৃষ্টিগত রহস্য:
সৃষ্ট জগতসমূহের স্রস্টার নিজ ‘জালাল’ (বড়ত্ব/ মহিমা/ সশ্রদ্ধভয় উৎপাদক মহত্ব) ও ‘জামাল’ (সৌন্দর্য/নান্দনিকতা) এর দীপ্তি এ জগতে প্রদর্শন করা আদি সিদ্ধান্ত ছিল। যে-কারণে তিনি মানবজাতিকে এমন বিবেক-বুদ্ধি ও মানসিকতার সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন যেন তারা সর্বদা বিরোধ তথা ভিন্ন অবস্থানে দৃষ্টিগোচর হতে পারে। এ পারস্পরিক টানাটানি অর্থাৎ সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, পাপ-পূণ্য অবস্থায় আল্লাহ্তা’লার সন্তোষ-অসন্তোষের আসবাব প্রস্তুত হতে থাকবে। যদি এ জগতে এমন বিরোধ-বৈচিত্রের উদ্ভব না ঘটতো তাহলে তো এটা হাশরের মাঠতুল্য ও মৃত্যুপুরীসম বিবেচিত হতো এবং এখানে বসবাসকারীগণ হয়তো শুধু মহান আল্লাহ্র একতরফা সন্তোষের বহিপ্রকাশ কিংবা একতরফা ক্রোধের বহিপ্রকাশরূপে গণ্য হতো। কিন্তু তাতে ফায়সালা ও অদৃষ্টের মালিক মহান সত্তার তেমন অসম্পূর্ণ ও একতরফা গুণের বহিপ্রকাশ কাম্য ছিল না। সুতরাং তিনি বিরোধ-বৈচিত্রের বহুমুখী স্বভাব মানবজাতির সৃষ্টির মূল উৎস মর্তের মাঝেই নিহিত রেখেছেন।
গ্রহণযোগ্য বিরোধের কল্যাণসমূহ:
মতভেদ ও মতবিরোধ যদি তার অনুমোদিত সীমা ও শর্তাধীনে হয় তাহলে তার অনেক কল্যাণও রয়েছে। যেমন-
একটি চিত্র/বিষয়কে বিভিন্ন আঙ্গিকে বা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার সুযোগ ঘটে।
একটি সমস্যার বিভিন্ন/একাধিক সুরাহা সামনে আসে।
যে- কোনো বিধান-সমস্যাকে প্রত্যেকটি দিক বিবেচনায় অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
প্রতিভার অনুশীলন, চিন্তা-গবেষণা ও ভাবের আদান-প্রদান অব্যাহত রাখা যায়।
বর্তমান কালের পর্যায়ক্রমিক উন্নত বিজ্ঞানের মৌলিক রহস্যও আলোচ্য মতভেদ নির্ভর। যদি মতদ্বৈততার সুযোগ না থাকতো তাহলে সকল জ্ঞান- গবেষণাই স্থবির হয়ে যেত।
ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণতা, সৌন্দর্য ও স্বয়ং-সম্পূর্ণতার মূলেও একটি দলিল হচ্ছে এটাই যে, তা গ্রহণযোগ্য মতভেদের দ্বার উন্মুক্ত রেখেছে। অবশ্য এটা সত্য যে, মতভিন্নতার গন্ডি নির্ধারণ করে না দিলে মতের বিরোধ সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদের আকার ধারণ করে, ফিতনা-ফাসাদ ও হানাহানির রূপ পরিগ্রহ করবে। মনে রাখতে হবে, মহান ¯্রষ্টা যদি তাঁর অদৃশ্য শক্তিধর ক্ষমতার মাধ্যমে বিরোধ-বিবাদের জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডুকে নিয়ন্ত্রণ না করেন তাহলে জগত অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিস্ময়কর সত্য হলো, এই বিরোধপূর্ণ জ্ঞান-বিদ্যা টিকে থাকার কারণও হচ্ছে এই একই বিরোধ-ভিন্নতা। আবার তার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াই তার পরিসমাপ্তি বা ধ্বংসেরও কারণ।
যদি অসৎ উদ্দেশ্য ও হিংসা-শত্রæতার কারণে, কেউ বিরোধের কারণে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটা বৈধ মতবিরোধের সীমা অতিক্রম করে বিবাদ-বিরোধ (‘খিলাফ’) বলে পরিগণিত হয়। তাই ‘ইখতিলাফ’ জাযেয় কিন্তু ‘খেলাফ’ তথা বিরোধিতার কারণে বিরোধিতা, নিষিদ্ধ।
(১) হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) তা নিন্দনীয় মর্মে বলেছেন-(‘আল-খিলাফু শাররুন’) “বিবাদকেন্দ্রিক বিরোধ নিন্দনীয়। ( আল-আওয়াসিম মিনাল ক্বাওয়াসিম: পৃ-৮)
আল্লামা তাকীউদ্দিন সুবুকী (র) ‘অহেতুক বিরোধ’ সম্পর্কে বলেছেন:
“রহমত-কল্যাণের দাবী হচ্ছে অপ্রয়োজনে বিরোধ না করা”।
হাদীস শরীফে এসেছে- “বনী ইসরাঈলের লোকজন তাদের নবীদের কাছে অধিক পরিমাণে প্রশ্নবাণে এবং তাঁদের সঙ্গে বিরোধের আধিক্যের কারণে ধ্বংস হয়েছে”। ( মুসনাদে আহমাদ)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, একদা দু’জন সাহাবী কোনো একটি আয়াত সম্পর্কে বিরোধ করতে গিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। তাঁদের বিতর্কের শব্দ বেশ জোরে শোনা যাচ্ছিল। তখন মহানবী (স) ক্রোধান্বিত হয়ে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন: “তোমাদের পূর্ববর্তিরাও তাদের আসমানী কিতাব প্রশ্নে বিরোধে জড়িয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।”
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স) ইরশাদ করেছেন, “ তোমরা বিরোধে জড়াবে না। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতরাও ‘ইখতিলাফ’ তথা বিরোধে লিপ্ত হয়েছিল, অতঃপর তাদের পতন হয়েছে।”
উপরিউক্ত হাদীসগুলো বিরোধিতার কারণে যে-বিরোধ করা হয়, সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাই ‘খেলাফ’ জাতীয় বিরোধ নিষিদ্ধ। আর সত্য উদঘাটনে যে গবেষণা-বিরোধ সংঘটিত হয় তা প্রশংসনীয় ও রহমতের নামান্তর। যে-কারণে অন্য হাদীসে এসেছে-
“আমার উম্মতের (প্রয়োজনীয়) বিরোধও রহমত-কল্যাণ”।
যদি নিয়্যত বিশুদ্ধ হয়, সংশ্লিষ্টদের অন্তরে নূর- জ্যোতি থাকে এবং তাঁরা কু-প্রবৃত্তি মুক্ত হন তাহলে মতভেদ সত্তে¡ও তাঁদের অন্তরে ঐক্য থাকে। মতের ভিন্নতা অন্তরের অভিন্নতাকে আহত করে না; অন্তরে ঐক্য-একতা বিদ্যমান থাকে। পক্ষদ্বয় একে-অন্যের সম্মান-মর্যাদার অকুণ্ঠ স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। বৃহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সকলে একট্টা থাকেন। সাহাবাকিরাম (রা) এর যুগে ব্যক্তিপর্যায়ে, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিরোধের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়।
সাহাবাগণের বিরোধ ও তার শিষ্টাচার
সাহাবাযুগে জাতীয় পর্যায়ের মতভেদের উদাহরণ:
প্রিয়নবী (স) এর ইন্তেকালের পর সর্ব-প্রথম বিরোধের সূচনা হয় তাঁর ওফাত শরীফের বৈশিষ্ট্য-স্বরূপ কি? Ñএ প্রশ্নে। হযরত উমর (রা) এর অভিমত ছিল প্রিয়নবী (স) ওফাত পাননি বা ইন্তেকাল করতে পারেন না। অন্যান্য সাহাবাদের মাঝেও কেউ কেউ বিষয়টি প্রশ্নে ইতস্তত পরিস্থিতিতে ভ‚গছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত আবূ বকর (রা) ভাষণ দিলেন এবং তাতে এই আয়াতটি পাঠ করলেন-
“মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র: তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি ইন্তেকাল করেন অথবা তাঁকে হত্যা করা হয় তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে?” ( আল কুরআনুল কারীম: ০৩:১৪৪ )
-এটি শুনে সকল সাহাবাকিরাম (রা) সম্বিত ফিরে পেলেন, মনের সংশয় দূরীভ‚ত হয়ে গেল।
সাহাবাদের মাঝে একটি মতবিরোধ এমন প্রশ্নেও ছিল যে, মহানবী (স)-কে দাফন করা হবে কোথায়? কারও মত ছিল, তাঁকে জান্নাতুল-বাকী‘ তে সমাহিত করা হবে। কারও মত ছিল, মসজিদে নব্বীর পাশে তাঁকে সমাহিত করা হবে। হযরত আবূ বকর (রা) একটি হাদীস শোনালেনÑ
“প্রত্যেক নবীকে সেখানে দাফন করা হয়েছে যেখানে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে।”
সাহাবাকিরাম (রা) এর মাঝে তৃতীয় আরেকটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, প্রিয়নবী (স) এর স্থলাভিষিক্ত খলীফা মুহাজিরগণের মধ্য থেকে নিযুক্ত হবেন, নাকি আনসারগণের মধ্যে থেকে নিযুক্ত হবেন? খলীফা কি একজন হবেন, নাকি একাধিক? এটা অত্যন্ত স্পর্শ্বকাতর পর্যায় ছিল। তারপরও সাহাবাকিরাম (রা) অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সর্বোত্তম প্রক্রিয়ায় আপসের বিরোধ খতম করে দিলেন এবং সকলে দলবব্ধভাবে হযরত আবূ বকর (রা) এর হাতে হাত রেখে বায়’আত করে নিলেন এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রাখলেন।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এর খেলাফত যুগে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মতভেদ জন্ম নিল, যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ-লড়াই শুরু করা প্রশ্নে। তা-ও তিনি সৎ নিয়্যত এবং পরস্পর বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে বিরোধের নীতি ও শিষ্টাচার রক্ষা করে সমস্যাটি নিষ্পত্তি করেন। মুরতাদদের বিরুদ্ধে এবং যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা প্রশ্নে সকল সাহাবা ঐকমত্যে পৌঁছেন। ওই কঠিন পরি¯ি’িততে ইসলামের বিধি-বিধান সুরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা সুসংহত রাখতে ইসলামের স্বার্থে সকলেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। এভাবে ইসলামী খেলাফত নিষ্কন্টক ও জাতীয় ঐক্য সুসংহত হয়ে গেল এবং ফিতনাবাজদের মূল উৎপাটিত হয়ে গেল।
ব্যক্তি পর্যায়ের বিরোধের কয়েকটি উদাহরণ :
সাহাবাকিরাম (রা) প্রিয়নবী (স) এর সুহবত-সাহচর্যে এতো বেশী যুগান্তকারী ফায়য-বরকত প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, মহানবী (স) এর আদর্শ ও চরিত্রে তাঁদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। প্রেম-ভালোবাসা ও ত্যাগ-তিতীক্ষার পবিত্র আবেগ-অনুভ‚তি, অভ্যাস তাঁদের দেহ-প্রাণে, রগ- রেশার রন্দ্রে রন্দ্রে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যে-কারণে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ নিজেই তাঁদের প্রশংসা করেছেন-“নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল”Ñ ( আল কুরআনুল কারীম: ৪৮:২৯)
বলে, আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে। তাঁরা পরস্পরের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন রক্ষায়, একে-অন্যের কল্যাণে, মৃত্যু-সায়াহ্নেও নিজের চেয়ে অন্যকে প্রাধান্যদানের যেসব উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন তা প্রত্যক্ষ করে জগত-জীবন হতবাক হয়ে গেছে। অথচ তাঁদের মধ্যেও জ্ঞানগত বা গবেষণাগত মতবিরোধ ছিল। অনেক সাহাবা পরস্পর জ্ঞানগত বিরোধে জড়ানো সত্তে¡ও নিজেদের মাঝে এতো গভীর সম্পর্ক, মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা, সম্মান-মর্যাদা ও আদব-শিষ্টাচার প্রদর্শন ও রক্ষায়, নজীরবিহীন আদর্শ উপহার দিয়ে গেছেন।
মন্তব্য করুন