শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মতভেদ ও মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য (৩)

মুফতি মো. আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সাহাবাগণের মতবিরোধ ও প্রেম-ভালোবাসা
নি¤েœ তার কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে:
(এক) প্রথম উদাহরণঃ হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) এর মধ্যকার জ্ঞানগত মতবিরোধ
(ক) তাঁদের উভয়ের মাঝে বিজিত অঞ্চলের ভ‚মি বরাদ্দ প্রশ্নে মতভেদ ছিল। হযরত আবূ বকর (রা) তা বন্টন করে দেয়ার মত পোষণ করতেন; কিন্তু হযরত উমর (রা) তা ওয়াকফ সম্পদরূপে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রাখার পক্ষে মত পোষণ করতেন।
(খ) রাষ্ট্রীয় দান-অনুদানে কমবেশী প্রশ্নে, উভয়ের মাঝে বিরোধ ছিল। হযরত আবূ বকর (রা) সমান হারে, প্রদানের মত পোষণ করতেন; কিন্তু হযরত উমর (রা) ন্যায্যতা ভিত্তিক কমবেশী হারে প্রদানের অভিমত পোষণ করতেন।
(গ) মুরতাদ নারী বন্দীদের প্রশ্নেও উভয়ের মাঝে মতভেদ ছিল। হযরত উমর (রা) নিজ খেলাফত কালীন হযরত আবূ বকর (রা) এর সিদ্ধান্ত ও মতের বিপরীতে তাদের মুক্ত করে নিজ নিজ পুরুষ আত্মীয়-অভিভাবকদের বরাবরে সোপর্দ করে দিতেন। তবে ব্যতিক্রম করতেন তাদের বেলায় যাদের নিজ মনিবের সূত্রে সন্তান জন্ম নিত যেমন মুহাম্মদ ইবন আলী (রা) এর মা খাওলা বিনতে জা’ফর হানাফিয়্যাÑ যিনি এসব বন্দীদের অন্যতম ছিলেন।
হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) এর পরস্পর প্রেম-ভালোবাসা:
কয়েকটি বিধান-বিষয়ে মতবিরোধ বা মতভেদ থাকা সত্তে¡ও তাঁদের উভয়ের পারস্পরিক মহব্বত, আতিœক ও আন্তরিক সম্পর্ক প্রতিনিয়ত বৃদ্ধিই পেয়েছে। হযরত আবূ বকর (রা) যখন ইন্তেকালের পূর্বে প্রবীণ সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে পরবর্তী খলীফা হিসাবে হযরত উমর (রা)-কে মনোনীত করলেন তখন কয়েকজন সাহাবী তাঁকে বললেন, আপনি হযরত উমর (রা)-কে আমাদের ওপর খলীফা নিযুক্ত করে গেলেন অথচ আপনি জানেন, তিনি কত কঠোর ব্যক্তিত্ব! হাশরের দিন যদি মহান আল্লাহ আপনাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন তাহলে আপনি কি উত্তর দিবেন? হযরত আবূ বকর (রা) জবাবে বললেন, “আমি বলবো, হে আল্লাহ্! আমি আপনার বান্দাদের মধ্যকার সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ লোকটিকে খলীফা নিযুক্ত করে এসেছি।” ( তাবাকাতে ইবনে সা’দ:খ-৩,পৃ-৪২)
কেউ একবার হযরত উমর (রা)- কে বললো, “আপনি কয়েকটি ক্ষেত্রে হযরত আবু বকর (রা) থেকে শ্রেষ্ঠ।”তা শুনে হযরত উমর (রা) প্রচন্ডভাবে কাঁদতে লাগলেন, দীর্ঘক্ষণ কান্না শেষে বললেন, “আল্লাহর শপথ! হযরত আবূ বকরের একটি রাতের ইবাদত-বন্দেগী ও মহান আল্লাহর নৈকট্যার্জনের মূল্য উমর ও উমরের পরিবারস্থ সকলের চেয়েও অনেক বেশী!” ( হায়াতুস সাহাবাহ্:খ-১,পৃ-৬৪৪ )
পূর্বে আলোচিত পারস্পরিক মতভেদ সত্তে¡ও এমনই ছিল তাঁদের প্রেম শ্রদ্ধা ও আদবের উদাহরণ। মত/অভিমত প্রদানে যদিও উভয়ে ছিলেন ভিন্নমুখী কিন্তু মনে-প্রাণে ছিলেন একই। এ মহান মনীষীদের অন্তরগুলোকে আল্লাহপ্রদত্ত কুদরতি রসি এভাবেই একসঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। যে-কারণে জগতের অবস্থা তাঁদের প্রতি কোনো প্রকার মন্দ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
(দুই): দ্বিতীয় উদাহরণ:
হযরত উমর (রা) ও হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবন মাসঊদ (রা) এর বিরোধ:
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) সবচেয়ে বেশী পবিত্র কুরআন পাঠকারী এবং প্রিয়নবী (স) এর সুন্নাতসমূহ বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞাত সাহাবী ছিলেন। মহানবী (স) এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা এতো বেশী ছিল যে, অনেক সাহাবী ভাবতেন, তিনি বোধ হয় নবী-পরিবারেরই একজন সদস্য। হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা) বলেন, “আমরা ইবনে মাসঊদ (রা)ও তাঁর মা’কে নবী-পরিবারেরই অন্যতম মনে করতাম কেননা, নবী-গৃহে তাঁদের যাতায়াত অনেক বেশী ছিল।” ( মুসলিম শরীফ: আল্-আহকাম; খ-৬,পৃ-৬৩)
একদা হযরত আবূ মাসঊদ বদরী (রা) হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা)-কে আসতে দেখে বললেন, “আমার জানা মতে প্রিয়নবী (স) ঐ আগন্তুকের চেয়ে কুরআন ও সুন্নাহর অধিক জ্ঞানী আর কাউকে রেখে যাননি। আমরা অনেক সময় নবীজী (স) এর দরবারে অনুপস্থিত থাকতাম; কিন্তু তিনি সর্বদা উপস্থিত থাকতেন। আমাদেরকে অনেক সময় প্রবেশে অনুমতি দেয়া হতো না; কিন্তু তাঁকে তখনও প্রবেশের অনুমতি প্রদান করা হতো।”
অন্যদিকে হযরত উমর (রা) এর শান-মর্যাদা ও ধর্মীয় ফিকহে তাঁর উচ্চ আসন সকলের জানা। হযরত ইবন মাসঊদ (রা) ইজতিহাদ তথা গবেষণাগত অনেক ব্যাপারে হযরত উমর (রা) এর সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন। ইসলাম ধর্মে শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কিত ইতিহাসবেত্তাদের অকেইে লিখেন, হযরত ইবন মাসঊদ (রা) হযরত উমর (রা) এর দ্বারা অনেক প্রভাবান্বিত ছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের উভয়ের গবেষণা একইরূপ হয়ে থাকতো। অন্যথায় তিনি হযরত উমরের অভিমতের প্রতি একাত্বতা পোষণ করে নিজের মত প্রত্যাহার করতেন। উদাহরত, একজন মৃতের পিতার স্থলে দাদার বর্তমানে অংশ বন্টন প্রশ্নে, তিনি নিজ মত প্রত্যাহার করে হযরত উমরের (র) গবেষণা মেনে নিয়েছিলেন। এতো কিছুর পরও কয়েকটি বিষয়-বিধানে তাঁদের পরস্পর মতবিরোধ ছিল। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে তাঁদের মাঝে ১০০টি বিধানে বিরোধ ছিল। ( ই’লামুল মুকিঈন: খ-২,পৃ-২১৮ )
তার মধ্য থেকে কয়েকটি বিরোধপূর্ণ মাছআলার উদাহরণ নি¤েœ পেশ করা হলো:
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) রুকু করা কালীন দু’হাত দ্বারা হাঁটু না ধরে দু’হাতের তালু একত্র করে হাঁটুর মাঝামাঝি দু’হাত রেখে দিতেন যাকে ‘তাত্ববীক’ বলা হয়। অথচ হযরত উমর (রা) এর বিপরীতে দু’হাত দ্বারা হাঁটু চেপে ধরতেন।( ই’লামুল মুকিঈন: খ-২,পৃ-২১৮ )
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলতেন, যদি কোনো ব্যক্তি নিজ স্ত্রীকে এমনটি বলে যে, “আনতে ‘আলাইয়্যা হারামুন”(তুমি আমার জন্য হারাম হয়ে গিয়েছো)। তাহলে এক্ষেত্রে এটা শপথ বলে গণ্য হবে এবং নিজ উক্তিকে পাকাপোক্তকরন বোঝাবে; এটাকে তালাক বলে গন্য করা হবে না। পক্ষান্তরে হযরত উমর (রা) এর বক্তব্য ছিল, এটাও এক প্রকার তালাক (কিনায়া তালাক) অর্থাৎ স্বামীর নিয়্যতে যদি তালাকদানের সংকল্প থেকে থাকে এবং তিনি তার স্বীকারোক্তি দেন তাহলে এটাও ‘তালাক’ অধ্যায়ে পরিগণিত হবে, ‘শপথ’ অধ্যায়ে নয়।
হযরত ইবনে মাসঊদ (রা) বলতেন, যদি কোনো নারী-পুরুষ/যুবক-যুবতী ব্যভিচারে লিপ্ত হয় অতপর পরস্পর বিয়ে করে নেয়। তাহলে এমতাবস্থায়ও তাদের একত্রে বসবাস ও সহবাস ব্যভিচারের মধ্যেই ধর্তব্য হবে। পক্ষান্তরে হযরত উমর (রা) এর অভিমত ছিল, বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত ব্যভিচারই হবে; তবে বিয়ের পরের থেকে তা বৈধ-সহবাস বলেই গণ্য হবে।
হযরত উমর (রা) ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) এর পরস্পর মহব্বত:
একদা হযরত ইবনে মাসঊদ (রা) হযরত উমর (রা) এর খেদমতে এলে হযরত উমর (রা) বলে উঠলেন, “ধর্মীয় জ্ঞান ও ফিকহ্ জ্ঞানে কামিল ব্যক্তির আগমন ঘটেছে।” হযরত উমর (রা) এর আরেক দিনের উক্তি হচ্ছে, “তিনি ধর্মীয় জ্ঞানে এমন পরিপূর্ণ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি যে, মক্কা-মদীনার এই পবিত্র নগরিতে তাঁর তুলনায় অপর কাউকে আমি প্রাধান্য দেই না।”
একদিন হযরত ইবন মাসঊদের কাছে দু’জন লোক এলেন। তাদের একজন হযরত উমরের (রা) কাছে পবিত্র কুরআন পাঠ শিখেছিলেন এবং তিনি নিজেই বললেন, “আমি হযরত উমরের (রা) কাছে কুরআন তিলাওয়াত শিখেছি”। তা শুনে হযরত ইবনে মাসঊদ (রা) কাঁদতে শুরু করলেন। এমনকি কান্নার অশ্রæতে তাঁর জামা ভিজে গেল। তারপর তিনি সেই লোকটিকে বললেন, আপনাকে হযরত উমর (রা) যেভাবে তিলাওয়াত শিখিয়েছেন ঠিক সেভাবে আমাকে একটু পাঠকরে শোনান তো! তিনি আরও বললেন, হযরত উমর (রা) ইসলাম ধর্মের সু-রক্ষায় একটি সুদৃঢ় দূর্গের অবস্থানে ছিলেন। যেখানে কোনো ফিতনাবাজের অনুপ্রবেশ সম্ভব ছিল না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, তাঁর ইন্তেকালে সেই দূর্গে-ফাটল ধরেছে, বিচ্ছিন্নতার প্রভাব পড়ছে।”
লক্ষণীয়, ‘ইল্মী’ বা জ্ঞান-গবেষণাকেন্দ্রিক মতভেদ থাকা সত্তে¡ও, তাঁদের এমন প্রেম-ভালোবাসা, আদব-সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অসাধারণ ঘটনাগুলো আমাদের জীবনের আলোকবর্তিকা হতে পারে। এসব থেকে আমরা আমাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা উন্নত করতে পারি।
(তিন) তৃতীয় উদাহরণ:
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) ও হযরত যায়েদ ইবন সাবিত (রা) এর বিরোধ: সাহাবাকিরাম (রা) এর মাঝে হযরত যায়েদ ইবন সাবিত (রা) ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) এর ধর্মীয় গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উচ্চাসন সকল জ্ঞানীজনেরই জানা। ‘মীরাস’ তথা সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রশ্নে দু’জনের মাঝে বেশ মতবিরোধ ছিল। হযরত ইবন আব্বাসের (রা) মত ছিল, মৃতের দাদা বিদ্যমান থাকাবস্থায়, পিতা বিদ্যমান থাকলে যেমন মৃতের ভাই- বোনরা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হন; তেমনি কেবল দাদার বর্তমানেও তারা বঞ্চিত হবে। পক্ষান্তরে হযরত যায়েদ ইবন সাবিতের মত ছিল, ভাই- বোনরা দাদার সঙ্গে অংশ পাবে; যদিও তারা পিতা থাকা কালীন বঞ্চিত হয়।
হযরত ইবন আব্বাস (রা) তাঁর অভিমত যথার্থ হওয়া প্রশ্নে, জ্ঞানগত দিক থেকে এতো সংশয়হীন ও দৃঢ় ছিলেন যে, একদিন হযরত যায়েদকে বললেন, “তুমি আল্লাহকে ভয় করো না”! কারণ, তিনি পুত্রের পুত্র (মৃতের এক বা একাধিক পুত্র না থাকাবস্থায়) তথা নাতীকে পুত্রের স্থলাভিষিক্ত করে দিলেন, আর দাদাকে পিতার স্থলবর্ত্তী করেননি? অর্থাৎ পিতার অনুরূপ দাদা জীবিত থাকলে,মৃতের ভাই-বোনরা অংশ পাবে না। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন