শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সকল ফিচার

গীবত বা পরনিন্দা: সমাজের উপর প্রভাব

| প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০১৮, ৭:৫৮ পিএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: (পূর্বে প্রকাশিতের পর)/ রাসূল (সা:) বলেছেন, যখন পাপাচারী ফাসিকের প্রশংসা করা হয় তখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। ৭। কোন ব্যক্তি দ্বারা যদি অপর কোন ব্যক্তি তার অজান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তার গীবত করা যাবে। যাতে সে অন্য লোকের ক্ষতির কারণ না হয়। যেমন কোন ব্যক্তি এর কথা ওর কানে এবং ওর কথা এর কানে দিয়ে মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে এই অবস্থায় তার গীবত করা জায়েয আছে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, কোন ব্যক্তি গোপনে কোন খারাপ কাজে লিপ্ত থাকলে এবং তার দ্বারা অপরের কোন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে সে ব্যক্তির গীবত করা জায়েয নেই। এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে- কোন বান্দা দুনিয়ার অপর কোন বান্দার দোষ গোপন রাখলে আল্লাহ তা’য়ালা কিয়ামতের দিন সেই বান্দার দোষ গোপন করে রাখবেন। ৮। কেউ যদি নিলর্জ্জভাবে প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং তাকে কেউ সতর্ক করলেও তার প্রভাব তার উপর পড়ে না এমন ব্যক্তির গীবত করা জায়েয। এ কারণে সাহাবায়ে কিরাম রাসূল (সা:) এর কলিজার টুকরা হযরত হুসাইন (রা:) এর হত্যাকারীদের গীবত করতেন এবং তাদের ভৎসনা করতেন। কেননা তারা নির্লজ্জ ও বেহায়া ছিল। শেখ সাদী (র:) তিন ব্যক্তির গীবত করা জায়েয মনে করেন। তারা হচ্ছে বেহায়া, স্বৈরাচারী শাসক ও যার পাপাচার অন্যের ক্ষতির কারণ হয়। ৯। দুঃখ ও আক্ষেপ প্রকাশের নিমিত্তে কারো গীবত করা যায়। যেমন কেউ যদি আফসোস করে বলে যে, “অমুক নামায পড়ে না, রোযা রাখে না, যাকাত প্রদান করে না, আত্মীয়ের হক আদায় করে না’’ তবে তা গীবত হবে না। এরূপ খারাপ কাজে আফসোস করা উত্তমও বটে। ১০। কেউ যদি বিশেষ কোন খারাপ উপাধিতে প্রসিদ্ধ হয় এবং সেই খারাপ উপাধি উল্লেখ করা ব্যতিত পরিচয় দেয়া সম্ভব না হয়, তবে এক্ষেত্রে খারাপ উপাধি উল্লেখ করা যাবে, এতে গীবত হবে না। যেমন কাউকে বিকলাঙ্গ, বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া। তবে এরূপ উপাধি পরিহার করা উত্তম। ১১। কোন ব্যক্তির সরাসরি নাম উল্লেখ না করে গীবত করা জায়েয আছে। ১২। ইসলামকে শক্তিশালী তথা বিজয়ী করার লক্ষ্যে গীবত করাতে কোন দোষ নেই। যেমন হাদীস বিশারদগণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ততার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বর্ণনাকারীদের কখনো মিথ্যাবাদী, তার স্মৃতিশক্তি প্রখয় নয, তিনি প্রত্যাখ্যাত ইত্যাদি বলেছেন। এভাবে বলা গীবত নয়। ১৩। মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যে জীবিত কিংবা মৃত ব্যক্তির গীবত করা জায়েয আছে। যেমন জীবিত ব্যক্তি সম্পর্কে অমুক জাহান্নামের উপযোগী, কেননা, সে বড়ই কৃপণ। অপর মৃত ব্যক্তির সম্পর্কে বলা আমি অমুক ব্যক্তিকে স্বপ্নে শাস্তি ভোগ করতে দেখেছি।
অতএব বলা যায় গীবত একটি নিষিদ্ধ চর্চা হলেও প্রয়োজনে তথা শরীআতের সীমারেখার মধ্য থেকে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা ব্যতিত সতর্কতা, সংশোধন ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান প্রদানের জন্যে গীবত করা জায়েয আছে।
গীবতমুক্ত জীবন-যাপন করতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তবেই একজন মানুষ গীবত নামক এই ভয়াবহ অপরাধ প্রবণতা থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। যেমন- ১। যথার্থ ধর্মীয় জ্ঞানানুশীলন। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবেই আমরা নিজেদের অজ্ঞান্তে গীবতে লিপ্ত হয়ে পড়ি। ধর্মীয় জ্ঞান থাকলে গীবত থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। ২। কুরআন ও হাদীসের মর্মবাণী স্মরণ। যখনই গীবত করার ইচ্ছা জাগ্রত হবে, তখনই কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত গীবতের কঠিন পরিণতির কথা স্মরণ করতে হবে। এতে গীবত করার প্রবণতা আর জাগ্রত হবে না। ৩। গীবতকারীর আমলনামা থেকে পুণ্য কর্মগুলো হ্রাস করা হয় এবং পাপ যোগ করা হয়। অর্থাৎ যার গীবত করা হবে তার পাপ গীবতকারীর আমলনামায় যোগ করে দেয়া হবে এবং গীবতকারীর পুণ্য যার গীবত করা হয়েছে তার আমলনামায় যোগ করে দেয়া হবে, একথা স্মরণ করা যেতে পারে। ৪। গীবত করার ইচ্ছা জাগ্রত হলে নিজের মধ্যে লুকায়িত দোষগুলো স্মরণ করলে অপরের দোষ চর্চার আগ্রহ থাকবে না। রাসূল (সা:) বলেছেন, সুসংবাদ সেই ব্যক্তির জন্য যাকে তার নিজের দোষত্রুটি অপরের দোষ ত্রুটি বর্ণনা থেকে বিরত রাখে। ৫। লজ্জা, অপমান ও মান-ইজ্জতের কথা স্মরণ রাখা। গীবত করার ইচ্ছা হলে তৎক্ষণাৎ কেউ যদি এভাবে চিন্তা করে যে, অমুক আমার গীবত করলে যেমন আমি লজ্জিত ও অপমানিত হবো তদ্রুপ আমিও গীবত করলে সে লজ্জিত ও অপমানিত হবে কাজেই এরূপ কাজ থেকে বিরত থাকি। ৬। ক্রোধ সংবরণ করা। ক্রোধকে ধৈর্য দিয়ে মোকাবিলা করতে পারলে গীবত করার প্রয়োজন হয় না। পরকালে ক্রোধের কারণেও মানুষ জাহান্নামে যাবে। রাসূল (সা:) বলেছেন, জাহান্নামের একটি বিশেষ দরজা আছে, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে সে ঐ দরজা দিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। ৭। অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা। অর্থাৎ যেসব সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব গীবত করাকে কোন দোষেরই ব্যাপার মনে করেন না এমন সব সহকর্মী ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা। ৮। কথা বলার সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে কথা বলা। কেননা অনেক সময় দেখা যায় কথা প্রসঙ্গে অসতর্কতা বশত: আমরা অনেক গীবত করি। যা একটু সতর্ক থাকলেই এড়ানো সম্ভব। গীবত সম্পর্কিত উপরোক্ত আল্লাহর বাণী ও রাসূল (সা:) এর হাদীস এবং দার্শনিকদের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, গীবত একটি সামাজিক ব্যাধি, নিষিদ্ধ পরচর্চা।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালবাসা, সহানুভূতি, উদারতা ইত্যাদি শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের পূর্বশর্ত। আর গীবত বা পরচর্চা সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত করে। তাই ঈমান-আমল, দুনিয়া-আখিরাত বিধ্বংসী, হিংসা-বিদ্বেষ ও অশান্তি সৃষ্টিকারী জঘন্যতম অপরাধ গীবত বা পরনিন্দা থেকে বেঁচে থাকা আমাদের কর্তব্য। গীবতের মধ্যে কোন প্রতিরোধকারী না থাকায় নীচ থেকে নীচতর ব্যক্তি কোন উচ্চতর ব্যক্তির গীবত অনায়াসে করতে পারে। প্রতিরোধ না থাকার কারণে এর ধারা সাধারণত দীর্ঘ হয়ে থাকে এবং এতে মানুষ লিপ্তও হয় বেশি। গীবত করার সময় যদি প্রতিরোধ না করা যায় অন্তত শ্রবণ করা থেকে বিরত থাকা জরুরী। কেননা ইচ্ছাকৃতভাবে গীবত শোনা ও নিজে গীবত করার মতই অপরাধ। অতএব আমরা নিন্দনীয় স্বভাব গীবত চর্চা থেকে দূরে থাকব। সম্ভব না হলে অন্তত কারো গীবতে কর্ণপাত করবো না এটাই প্রত্যাশা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন