পূর্ব প্রকাশিতের পর
আমি আমার জীবনে একটি বিষয় বেশী লক্ষ্য করলাম- তা হলো, কেউ তার অন্যায়, অপরাধ ও ভুলকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা। বাস্তব জীবনের অনেক ক্ষেত্রে দেখলাম, কারো কোন কাজে ভুল হয়ে গেলে, অন্যায়কে স্বীকার করে না, সে অন্যদের পরনিন্দায় লিপ্ত হয়ে বুঝাবার চেষ্টা করে এটা আমার ভুল বা অন্যায় নয়, এটা অমুকের ভুল বা অন্যায় এবং সে তার এ ভুল বা অন্যায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে আরো কিছু কল্পকাহিনীর সৃষ্টি করে।
ইদানিং আমরা বেশ ক’জন বন্ধু মাঝে-মধ্যে আড্ডায় বসি। আড্ডায় হাসি, ঠাট্টা, তামাশা, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। ক্রীড়া, সাহিত্য, সংস্কৃতি, টেলিভিশন, নাটক ও বিভিন্ন সামাজিক আলোচনা থাকলেও রাজনৈতিক আলোচনাকে আমরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যে অবশ্য দু-একজন বন্ধুর অনুপস্থিতিতে বেশ কিছু নতুন মুখের আবির্ভাব ঘটেছে। আমি কি বিবেকের আদালতে দাঁড়িয়ে এ কথাটি বলতে পারি যে আমাদের আড্ডায় পরনিন্দা হয় না? কোন বন্ধু কোন কারণে আড্ডায় অনুপস্থিত থাকলে আমরা কি তার সমালোচনায় মুখর হই না? আড্ডার কথা এ জন্য উল্লেখ করছি, আমি নিশ্চিত জানি আমাদের মতো এ রকম আড্ডা অনেকেই দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন স্থানে এরূপ আড্ডার আসরের সংবাদ আমাদের কানে আসে। অনেকে এমন আছেন আড্ডায় কোন কারণে উপস্থিত থাকতে না পারলে তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জীবনকে উপভোগ করার জন্য এ ধরণের আড্ডার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই আড্ডায় পরনিন্দায় লিপ্ত হওয়া এবং দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করা বা পরিবারকে সময় দেয়ার কথা ভুলে যাওয়া কোন অবস্থাতেই ঠিক না। কারণ একথা ভুলে গেলে চলবে না আড্ডা অনেক সময় দাম্পত্য কলহের জন্ম দিতে পারে। তাই বেয়ার্ড টেলর এর একটা বাণী আমাদের সব সময় স্মরণ রাখা উচিৎ সেটি হলো, “রাজা হোক আর প্রজা হোক সে সুখী যে তার গৃহে শান্তি খুঁজে পায়”।
আমরা সুরা হুমাযা এর প্রথম আয়াতটি বঙ্গানুবাদ করলে দেখতে পাই ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে’। শুধু এ আয়াতটি ব্যাখ্যা করতে গেলে আমরা পরনিন্দা সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারি। হুজুরে আকরাম (স.) এরশাদ করেছেন-তোমরা গীবত থেকে অত্যন্ত সতর্ক থাক, পুরাপুরিভাবে তা পরিহার কর, কেননা গীবত ব্যভিচারের চাইতে জঘন্য। কারণ ব্যভিচারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তওবা করলে তিনি ক্ষমা করে দিবেন, কিন্তু গীবতের জন্য গীবতকৃত ব্যক্তির মার্জনা ব্যতীত আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। অতএব পরনিন্দা করে থাকলে প্রথমত বান্দার নিকট থেকে ক্ষমা আদায় করে নেয়া উচিৎ। হাদিস শরীফে আছে, “কিয়ামতের দিন পরনিন্দাকারীর চেহারা পিছন দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে”।
পরনিন্দা এবং এ ধরণের আরো কিছু দোষত্রুটি কারো থাকলে অনেক সময় সহানুভ‚তির দৃষ্টি দিয়ে তাকে সংশোধন করে দেওয়া একটি মহৎ গুণ এবং মনুষ্যত্বের পরিচায়কও বটে তবে তার নিয়ম এই যে,- দোষী ব্যক্তিকে একান্ত গোপনে ডেকে কিংবা তার নিকট উপস্থিত হয়ে এরূপ বলতে হয় যে, আপনার অমুক কাজটি নিতান্ত অন্যায় বা অনুচিত, ইহা পরিহার করুন। এতে ঐ লোকের দোষমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং প্রকৃতপক্ষে এভাবে মানুষকে সংশোধন করা সম্ভব।
তবে এরূপ লোক আছে যারা সমাজের অনুসরণীয় ব্যক্তি যেমন আলেম, ফাজেল বা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি যাদেরকে মানুষ ভক্তি, শ্রদ্ধা করে এবং একান্ত মহৎ লোক বলে বিনা দ্বিধায় তাদের যাবতীয় কাজকর্ম উত্তম ও নির্দোষ ভেবে গ্রহণ করে। এরূপ লোকের মধ্যে কোন গোপন দোষ থাকলে তা দ্বারা প্রতারিত হতে পারে বলে যদি কেউ মনে করেন তাহলে মানুষের কল্যাণার্থে এদের বিষয় লোকদের জানিয়ে দিলে তাতে কোন অপরাধ হবে না বরং এটি একটি উত্তম ও সৎকার্য মনে করতে হবে। কারণ এতে মানুষ ঐ সমস্ত ভন্ড তপস্বীদের প্রবঞ্চনা থেকে রক্ষা পেতে পারে। আমাদের এটা জেনে রাখা দরকার ধর্ম, রাষ্ট্র, জাতি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর- কারো এ রকম কাজের দোষত্রুটির কথা প্রকাশ করা পরনিন্দার অন্তর্ভূক্ত নয়। অত্যাচারী শাসকের দুঃশাসনের বর্ণনা বা খোদাদ্রোহী কর্মকান্ড জনসমক্ষে তুলে ধরা পরনিন্দা নয় বরং কর্তব্য। অত্যাচারী শাসকের সামনে হক কথা বলা উত্তম ইবাদত।
পরনিন্দা সম্পর্কে এটুকু লিখে এ বিষয়ের উপর একটা উপসংহার টেনে আজকের লেখাটি শেষ করবো ভাবছি এমন সময় আমার লেখার টেবিল থেকে কিছু দূরে রাখা ষ্টীল আলমিরার সংযুক্ত আয়নাটির উপর আমার চোখ পড়লো। মনে হলো দর্পনের বিম্বিত প্রতিচ্ছবিটি আমাকে বলছে “পরনিন্দা নিয়ে অনেক কথা তো লিখলে, কুরআন, হাদীসের উদাহরণ দিলে, তুমি কি বলতে চাও তোমার মধ্যে পরনিন্দা করার স্বভাবটি নেই? তুমি কি কোন সময় কারো নিন্দা করো না? তোমার জীবনের অভিধান থেকে পরনিন্দা শব্দটি কি মুছে গেছে? তুমি কি বলতে চাও তোমার আজকের এ লেখাটার মধ্যে কারো প্রতি কোন প্রকার পরোক্ষ নিন্দা নেই এবং তোমার আগামী লেখাগুলোতে কারো প্রতি কোন প্রকার নিন্দা থাকবে না? তুমি কি ইদানিং উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়ে গেলে?” আমি চমকে উঠলাম। আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। মুহূর্ত বিলম্ব না করে আমি আয়না থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। পরনিন্দা নিয়ে আর বেশী কিছু লেখার সাহস আমি হারিয়ে ফেললাম।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন