শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

গীবত বা পরনিন্দা : সমাজের উপর প্রভাব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
দ্বীনদার ব্যক্তিদের তিনটি হলো ঃ ১। কোন দ্বীনদার ব্যক্তির ধর্মীয় কোন বিষয়ে তাঁর ত্রæটি সম্পর্কে জানার পর এভাবে বলা যে, এই লোকটি থেকে এরূপ ত্রæটি প্রকাশ পাবে তা আমি আশা করিনি। নামোল্লেখ করে এভাবে বলা গীবত হবে এবং এর জন্য মন্তব্যকারী গুনাহগার হবে। তবে নামোল্লেখ না করলে গীবত হবে না। ২। কোন ব্যক্তিকে কোনো সমালোচনা যোগ্য কোনো কাজে জড়িত হতে দেখে দুঃখ প্রকাশ পূর্বক এভাবে বলা যে, লোকটির জন্য আমার আফসোস হয়, যে এমন বিপদে জড়িয়ে পড়েছে। দুঃখ প্রকাশের দিক থেকে ব্যাপারটি যথার্থ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ঐ ব্যক্তি দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামোল্লেখ করায় তা গীবত হয়ে গেল। ৩. আল্লাহর ওয়াস্তে ক্রোধ বা অভিমান করতে গিয়েও গীবতের সূত্রপাত হতে পারে।
গীবতের ত্যাগের উপকারিতা ঃ গীবত অর্জনের বিষয় নয়, এটা বর্জন বা ত্যাগেরই বিষয়। তবুও মানুষ অসচেনতা বশত এর সাথে জড়িয়ে পড়ে, লিপ্ত হয় এই নিন্দনীয় অপরাধের সাথে প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্নভাবে। এই অপরাধ পরিত্যাগের মধ্যে কিছু উপকারিতা রয়েছে। যেমন- ১। আল কুরআনে গীবতকে মৃত মুসলমান ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমরা কি তোমাদের মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করো? আসলে তোমরা তা ঘৃণা কর। অতএব, যে ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করে সে এরূপ মারাত্মক অপরাধ থেকে বেঁচে যায়। ২। হাদীস শরীফে গীবতকে যিনা-ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ বলা হয়েছে। রাসূল (সা:) বলেছেন, আল গীবাতু আশাদ্দু মিনায যিনা-গীবত যিনার চেয়েও ভয়াবহ। কাজেই যে ব্যক্তি গীবত পরিত্যাগ করলো সে ব্যক্তি মূলত এই জঘন্য অপরাধ থেকেই নিজেকে রক্ষা করলো। ৩। গীবত রোযার মত একটি মর্যাদাপূর্ণ এবাদত ও বিনষ্ট করে দেয়। তাই যে গীবত ত্যাগ করে সে মূলত রোযার মর্যাদাই রক্ষা করে। ৪। আল কুরআনে গীবতকে হারাম করা হয়েছে। তাই গীবত ত্যাগের মাধ্যমে কবিরা গুণাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। ৫। গীবতের মাধ্যমে অপরকে আঘাত করা হয়। তাই এটা পরিত্যাগের মাধ্যমে অন্যকে আহত করার অপরাধ থেকে বেঁচে থাকা যায়। ৬। গীবতকারীর সর্বশেষ পরিণতি অপমান। অতএব গীবত ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানো যায়। ৭। রাসূল (সা:) বলেছেন, গীবত করার ফলে গীবতকারীর অন্তরে গুণাহের কালো দাগ পড়ে যায়। এটা ত্যাগের ফলে ব্যক্তির অন্তর নির্মল ও পরিচ্ছন্ন থাকে। ৮। গীবত করার অর্থ হচ্ছে কারো মান সম্মানে হস্তক্ষেপ করা। যে গীবত করে না কিয়ামতের দিন সে লজ্জিত ও অপমানিত হবে না। কেননা সে অন্যের মান সম্মানে হস্তক্ষেপ করেনি। ৯। হযরত আয়েশা (রা:) বলেছেন, ঘুমের দ্বারা যেভাবে ওযু নষ্ট হয়, তেমনি মিথ্যাচার ও গীবতের মাধ্যমেও ওযু বিনষ্ট হয়ে যায়। অতএব, যে ব্যক্তি গীবত পরিত্যাগ করলো সে ওযুকে রক্ষা করলো।
গীবত পরিত্যাগ করা ইবাদতের চেয়েও উত্তম ঃ নামায ও রোযা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু সাহাবায়ে কিরাম কয়েকটি কারণে গীবত পরিত্যাগ করাকে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মনে করতেন। কারণগুলো হচ্ছে, ১. নামায রোজা এমন ইবাদত যা কেউ পরিত্যাগ করলে কেবল আল্লাহ তা’আলাই অসন্তুষ্ট হন। তার কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু গীবত এমন একটি অপরাধ যা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা পাওয়া যায় নাই। যার গীবত করা হয়েছে তার কাছেই ক্ষমা চাইতে হয়। কেননা গীবতকারী তারই মান সম্মানে আঘাত হেনেছে। রাসূল (সা:) বলেছেন, অন্যায়ভাবে কোন মুসলমানের মান-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সুদের পাপের চেয়েও মারাত্মক। ২. পাপাচার পরিত্যাগ করা ইবাদতের চেয়েও বেশি ফযিলতপূর্ণ। এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা:) কে জিজ্ঞেস করলো- এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা:) কে জিজ্ঞেস করলো- এক ব্যক্তি বেশি বেশি ইবাদতও করে আবার বেশি বেশি পাপাচারেও লিপ্ত থাকে এবং অপর এক ব্যক্তি কম ইবাদত করে আর পাপাচারেও কম লিপ্ত থাকে, এদের মধ্যে কে উত্তম? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি কম ইবাদত করে এবং কম পাপাচারে লিপ্ত হয়। ৩. প্রতিটি অপকর্ম ব্যাধি সমতুল্য। যে ব্যাধির প্রতিশেধক সম্পর্কে মানুষ অবহিত, সে ব্যাধি তুলনামূলক কম জটিল। আর যে ব্যাধি প্রতিশেধক মানুষ এখন আবিস্কার করতে পারেনি তা বেশি জটিল। অতএব গীবত এমন ব্যাধি যার প্রতিশেধক মানুষ আজও আবিস্কার করতে পারেনি তা বেশি জটিল। অতএব, গীবত এমন ব্যাধি যার প্রতিশেধক মানুষ আজও আবিস্কার করতে পারেনি। এর পরিমাণ যে কতটা ভয়াবহ তা মানুষ অনুমান করতে পারে না।’’ অতএব, বলা যায়, গীবত যেহেতু আমাদের বাকযন্ত্র তথা মূখের দ্বারা সম্পন্ন হয় সেহেতু কথা বলার সময় মুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রাসূল (সা:) বলেছেন, আল্লাহ যাকে দুটি জিনিস থেকে বাঁচাবেন সে জান্নাতের অধিকারী হবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সে জিনিস দুটি কি কি? তিনি বললেন, একটি হলো দুই ঠোঁটের মাঝখানের জিনিস (জিহŸা) এবং অপরটি দুই পায়ের মাঝখানের জিনিস (যৌনাঙ্গ)
যে সব ক্ষেত্রে গীবত করা যায় ঃ গীবত করা হারাম এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে গীবত করা বৈধ আবার কোন কোন ক্ষেত্রে গীবত করা শুধু বৈধই নয় পুণ্যেরও কাজ বটে। ইমাম নববীং, আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী ও আব্দুল হাই লাখনাবী তেরটি ক্ষেত্রে গীবত করা বৈধ মবেন করেছেন। যেমন- ১। কোন ব্যক্তি বিচারক, মুফতী, সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী বা পদস্থ কর্মকর্তার জুলুমের শিকার হলে সে তার প্রতিকারের জন্য রাজ দরবারে নালিশ করতে পারবে। এরূপ জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে গীবত করা বৈধ। আল্লাহ বলেন, মানুষ খারাপ ব্যাপারটি বলুক তা আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যার উপর জুলুম হয়েছে তার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। ২। কোন ব্যক্তি যদি পাপাচারে লিপ্ত থাকে, তবে তাকে পাপাচার থেকে বারণ করতে উপদেশ দিতে কিংবা সংশোধনের জন্য গীবত করা জায়েজ আছে। কুফার গভর্ণর সাদ (রা:) এর বিরুদ্ধে খলীফা উমর (রা:) এর কাছে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করা হলো যে, তিনি ভাল করে নামায পড়েন না এবং যথাযথভাবে কুরআন পাঠ করেন না। উমর (রা:) অভিযোগের ভিত্তিতে সাদ (রা:)কে গভর্ণর পদ থেকে বরখাস্ত করে তদস্থলে হযরত আম্মার (রা:) কে গভর্ণর নিয়োগ করলেন। ৩। লজ্জা দিয়ে পাপাচার থেকে বিরত রাখার জন্যে গীবত করা বৈধ। জনৈক ব্যক্তি রাসূলের (সা:) কাছে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে রাসূল (সা:) বললেন, তোমার ঘরের জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে দাও। তোমার প্রতিবেশী তা দেখে লজ্জিত হয়ে তোমাকে কষ্ট দেয়া ত্যাগ করবে। রাসূল (সা:)-এর কথা মত মালপত্র রাস্তায় ফেললে লোকেরা রাস্তা অতিক্রম করার সময় তাকে মালপত্র রাস্তায় নিক্ষেপের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে, প্রতিবেশী তাকে কষ্ট দিচ্ছে। প্রতিবেশীর কাছে এ খবর পৌছলে সে লজ্জিত হয় এবং প্রতিবেশীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ৪। কোন বিজ্ঞ আলিমের কাছে মাস’আলা জানার জন্য কারো দোষ বর্ণনা করা জায়েয আছে। আবু সুফিয়ান-এর স্ত্রী হিন্দা রাসূল (সা:) এর কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে এভাবে গীবত করলো যে, তিনি খুব কৃপণ এবং স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণ পোষণ ঠিকমত প্রদান করেন না। রাসূল (সা:) বললেন, তুমি তার অজান্তে প্রয়োজনীয় মাল নিয়ে নাও। ৫। প্রয়োজনীয় উপদেশ ও সংশোধনের জন্য গীবত করা যায়। মহানবী (সা:) এর কাছে সাহাবায়ে কিরাম লোকদের দোষত্রæটি বর্ণনা করতেন। তবে মুসলমানদেরকে অপমান করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না বরং উদ্দেশ্য ছিল যাতে মহানবী (সা:) তাদেরকে নসীহত করেন এবং তারা সংশোধন হয়ে যায়। ৬। প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তির সম্পর্কে গীবত করা জায়েয। যেমন- বেনামাযী, মদ্যপায়ী ও স্বৈরাচারী শাসকের গীবত করা। এ ধরনের ব্যক্তির আল্লাহর কাছে কোন মর্যাদা নেই। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন