শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

উভয় জগতে তাকওয়ার অকল্পনীয় প্রভাব

| প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

তাকওয়া অর্থ বাঁচা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা, ভয় করা। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় অপরাধ, অন্যায় এবং আল্লাহর অপছন্দনীয় কথা, কাজ ও চিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নাম তাকওয়া।
তাকওয়ার পরিধি: তাকওয়ার ক্ষেত্র সীমাহীন বিস্তৃত। এটি যেকোন ধরনের পদস্খলন থেকে মানুষকে রক্ষা করে; সব মন্দ ও অশ্লীল কথা কাজ ও পরিবেশ থেকে ফিরিয়ে রাখে। খাহেশাতে নফসানি তথা প্রবৃত্তির খেয়ালখুশি বা অভিলাষ ও দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ে নিজের ক্ষতি করা থেকে এবং পরিবার, সমাজ ও দেশের ক্ষতি করা থেকে রক্ষা করে। তাকওয়া জীবনকে এমন এক সুদৃঢ ভিত্তির ওপর স্থাপন করে, যা সব ধরনের ভীতি, লোভ-লালসা, প্ররোচনা-প্রতারণা, প্রলোভন-পদস্খলন থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে। অন্ধাকারাচ্ছন্ন গভীর সমুদ্রে কম্পাস বা দিগ্দর্শন যন্ত্র যেমন সমুদ্রাভিযাত্রীকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে, সমস্যাসংকুল জীবনপথে তাকওয়াও তেমনি মানুষকে নির্ভুল পথের সন্ধান দেয়। ভালোকে গ্রহণ করার তীব্র আগ্রহ এবং মন্দকে পরিহার করে চলার দৃঢ মনোবলই হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া মানুষের মধ্যে পরকালের ভাবনা অধিক পরিমাণে জাগিয়ে তোলে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ইমানদারগণ, তোমরা যদি তাকওয়া অবলম্বন করো তবে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী (সুরা আনফাল: ২৯) অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, প্রত্যেকের উচিত আগামীর (পরকাল) জন্য সে কী প্রেরণ করে তা চিন্তা করা। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত। (সুরা হাশর: ১৮)
তাকওয়ার গুণ না থাকলে কেউ খাঁটি মুসলমান হতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেমন ভয় করা উচিত। এবং (খাঁটি) মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সুরা আলে-ইমরান: ১০২) ইবাদতের মূলবস্তু: তাকওয়া হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগীর মূলবস্তু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের কোন মূল্য নেই, যদি সেখানে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি না থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, সে (হাবিল) বললো, আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের থেকে কবুল করেন। (সুরা মায়েদা: ২৭)
তাকওয়া অবলম্বনের প্রতিদান: প্রত্যেক মানুষ তার জীবনে প্রত্যাশা করে স্বাচ্ছন্দ, পর্যাপ্ত রিজিক, কাজকর্মে সহজসাধ্যতা, ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় নিরাপত্তা এবং পরকালের সফলতা। আর আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার মাধ্যমে মানুষের এসব চাওয়া-পাওয়া পূরণের প্রতিশ্রতি দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ করে দেন, এমনভাবে রিজেকের ব্যবস্থা করেন যে, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। (সুরা তালাক: ২-৩)
পরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন। (সুরা তালাক: ৪) শয়তানের অনিষ্ট থেকে হেফাজত: অল্লাত তায়ালা বলেন,নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্ব করে তাদেরকে শয়তান যখন কোন কুমন্ত্রণা দেয়, তখন তারা আল্লাহকে স্বরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের চোখ খুলে যায়। (সুরা আরাফ: ২০১) তাকওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহপাক আসমান ও জমিনের নেয়ামত উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, যদি জনপদের অধিবাসীরা ইমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো। তাহলে আমি তাদের প্রতি আসমান ও জমিনের কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম। (সুরা আরাফ : ৯৬) হজরত ওমর (রা.) একদা উবাই ইবনে কাব (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, তাকওয়া কী? তিনি উত্তরে বললেন, হে ওমর, পাহাড়ের দুপাশেই কাঁটাবন, মাঝখানে সরুপথ, এমন অবস্থায় কীভাবে চলতে হবে? তিনি বলেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, সেজন্য কাপড় গুটিয়ে খুব সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হবে হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বললেন, এটাই তাকওয়া। এজন্য তাকওয়া অবলম্বন করতে বর্তমান সমাজে সুদ, ঘুস ও দূর্নীতির কাঁটা থেকে একজন মুমিনকে আত্মরক্ষা করে খুব সতর্কতার সঙ্গে জীবনপথ পাড়ি দিতে হবে।
আল্লাহর ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব: তাকওয়ার গুণ অর্জন হলে আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা লাভ করা যায়। তিনি ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন। (সুরা আত-তাওবা: ৪) অন্যত্র ইরশাদ করেন, তাঁর (আল্লাহর) বন্ধু তো কেবল তাকওয়া অবলম্বকারীরা। (সুরা আনফাল; ৩৪) আল্লাহর নৈকট্য অর্জন: আল্লাহর নৈকট্য ও সহায়তা লাভের জন্য তাকওয়া অবলম্বন করা অপরিহার্য তিনি ইরশাদ করেন, তামরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন। (সুরা বাকারা: ১৯৪)
মর্যাদার মাপকাঠি: আল্লাহর নিকট তাকওয়াই হচ্ছ একমাত্র শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা লাভের মাপকাঠি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। (সুরা হুজুরাত: ১৩) জীবনের সফলতা: তাকওয়ার গুণই ইহকাল-পরকাল জীবনে সামগ্রিক সাফলতা বয়ে আনে। মহান আল্লাহ বলেন, তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য রয়েছে সফলত। (সুরা নাবা: ৩১)
জাহান্নাম থেকে মুক্তি: তাকওয়া মুমিনকে জাহান্নামের ভয়ংকর শাস্তি থেকে রক্ষা করে। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.)বলেন, ‘দুটি চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। (ক) যে চোখ আল্লাহর ভয়ে অশ্রæ ঝরায়। (খ) আর যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারা দিতে গিয়ে নিদ্রাহীন রাত কাটায়। (তিরমিজি: ১৬৬৩)
জান্নাতে দুটি উদ্যান: আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে তার প্রতিপালকের সামনে হাজির হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে দুটি উদ্যান। (সুরা আর-রাহমান: ৪৬)
আল্লাহভীতির একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত: হজরত ওমর (রা.) তার খেলাফতকালে লোকদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য রাতের বেলা মদিনা মুনাওরায় টহল দিতেন। একরাতে তাহাজ্জুদের নামাজান্তে টহল দিচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ খেয়াল করলেন, একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাধারণত কারো ব্যাক্তিগত কথা আড়ি পেতে শুনা জায়েজ নেই। তবে হ্যাঁ দায়িত্বশীল ব্যাক্তির জন্য প্রয়োজনে এর অনুমতি রয়েছে। তো কথাবার্তার ধরণ শুনে তাঁর কৌতূহল হলো। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, ‘বেটি! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। এত অল্প দুধ বিক্রি করে দিন গুজরান কষ্ট হবে। তাই দুধের সাথে একটু পানি মিশিয়ে দাও। মেয়ে উত্তরে বললো, মা আমিরুল মুমিনিন তো দুধের সাথে পানি মিশাতে নিষেধ করেছেন? বৃদ্ধা বললো, আমিরুল মুমনিন এখন কি আমাদের দেখছেন? তিনি হয়তো নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তুমি নিশ্চিন্তে পানি মেশাতে পারো। এবার মেয়ে বললো,মা! আমিরুল মুমিনিন এখানে নেই কিংবা তার কোন লোকও নেই। তিনি বা তারা আমাদের দেখছেন না সেকথা ঠিক আছে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো আছেন। তিনি তো সব দেখছেন। তাঁর কাছে আমরা কী জবাব দেব? হজরত ওমর (রাযি.) দেয়ালের ওপাশ থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। এতটুকু শুনেই তিনি চলে এলেন এবং পরদিন লোক পাঠিয়ে সে ঘরের খোঁজখবর নিলেন।
পবিত্র কোরআনের বিশেষ রীতি হলো, যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিধান নাজিলের পরই তাকওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এর কারণ হলো শত আইনকানুন, কলাকৌশল, পুলিশি পাহারা এবং চৌকিদার দিয়েও অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না অপরাধী মানসিকভাবে সেই অপরাধ বর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ ও দৃঢপ্রতিজ্ঞ হয়। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে এর সত্যতার স্বপক্ষে অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই ইসলাম অপরাধ দমনে সদিচ্ছা নিয়ে মানুষকে প্রথমে অপরাধ পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে, তারপর অপরাধের পার্থিব-অপার্থিব শাস্তি ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গেই মানুষকে আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া অর্জন করতে বলেছে। এটাই মূলত অপরাধ ও পাপাচার ত্যাগের মূলমন্ত্র। কেননা অদৃশ্যের ভয় যখন ব্যক্তির মাঝে কাজ করে, পরকালের চিন্তা যখন তাকে তাড়িত করে। তখন সে ভেতরে-বাইরে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সর্বত্রই পাপাচার বর্জন করতে সক্ষম হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন