মিনারার নজরকাড়া রূপ হঠাৎ কারোর চোখে পড়লেই ক্ষণিকের জন্য হলেও সে থমকে দাঁড়ায়। নয়নের অতৃপ্ত বাসনা নিয়েই আবার তাকে পথ চলতে হয়। অথচ অনেক আগেই সেই মেয়েরই কপাল পুড়েছে। শত চেষ্টা করেও সে তার বৈবাহিক জীবনকে ধরে রাখতে পারেনি। বিবাহের কিছুদিন পরেই তাকে বিচ্ছেদের সুধা পান করতে হয়েছিল। তার স্বামী তাকে কেন অপছন্দ করত তার প্রকৃত কারণ আজও অনেকের কাছেই অজানা। এরপর থেকে মিনারা নিজেকে অনেকখানি গুটিয়ে রাখে। তাকে দেখলে কেউ তার মনোযন্ত্রণার বিষয়টি বুঝতে পারে না। বুকের ভিতরে যে ভালোবাসার আধার ছিল তা মরিচা পড়ে কালো হয়ে গেছে। তার মনটা সারাক্ষণ ভারাক্রান্ত থাকলেও চাঁদরূপের স্নিগ্ধ আলো কখনও নিষ্প্রভ হয়নি। বাড়ি আর স্কুলের বাইরে তার বিচরণ নেই বললেই চলে। সবসময় কাজের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। যেন কিছুটা হলেও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এভাবেই তার বছর সাতেক কেটে গেল। মা-বাবা ও নিকট আত্মীয়রা তাকে পাত্রস্থ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন অনেকবার। সে মনে মনে যেন শপথ করেছে তার অভিশপ্ত জীবনে কাউকে আর জড়াবে না। বাকিটা জীবন একা একাই কাটিয়ে দেবে।
একদিন রুমকি নামে মিনারার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবি তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে তাকে অনুনয় করে বলে : কিছু মনে না করলে তোকে একটা কথা বলতে চাই।
: ঠিক আছে, বল।
: তোকে তো আগেই বলেছি। আমার বস আসিফ স্যার তোকে খুব পছন্দ করে। উনার অনুরোধ রক্ষা করতেই তোর এখানে আসা। কী করব বল? চাকরি করি। বসের কথা তো শুনতেই হবে। উনি তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তুই অনুমতি দিলে ...।
মিনারা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে, ঠিক আছে। উনাকে বলিস আমি নিজেই উনার সঙ্গে দেখা করে কথা বলব।
এরপরে চলে অপেক্ষার পালা। আসিফ অপেক্ষা করতে থাকে সেই কাঙ্খিত সময়ের জন্য। অবসর সময়ে প্রায়ই আসিফ সাহেব ভৈরব নদীর তীরে ছুটে আসেন। বসে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেন। যেখানে উনি বসেন সেখান থেকে মিনারাদের বাড়ির ছাদটা দেখা যায়। সেদিনও আসিফ সাহেব নদীর তীরে একা একা বসে সন্ধ্যার আকাশে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে কী যেন ভাবছিলেন। ক্লান্ত সূর্যটা তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছিল। এমনসময় আসিফ সাহেব দূর থেকে লক্ষ করেন, তার দিকে কোন এক মেয়ে এগিয়ে আসছে। পরনে বাসন্তি রঙের কামিজ আর লাল রঙের ওড়না। দূর থেকে তাকে দেখতে দারুণ লাগছিল। মেয়েটি যতই তার দিকে এগিয়ে আসছিল তিনি ততই তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কারণ মেয়েটি অপরিচিত নন, মিনারা। প্রফুল বদনে একটা সালাম দিয়ে মিনারা আসিফ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর বলল, “কেমন আছেন?” “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?” “এই তো মোটামুটি। ভাবছিলাম এখানে এলে আপনার সঙ্গে দেখা হবে। তাই এলাম।” “আপনি জানেন কী করে আমি এখানে আসি।” “হাসতে হাসতে মিনারা বলে আমি অনেকদিন ধরেই লক্ষ করেছি আপনি এখানে একাকী বসে থাকেন দীর্ঘসময়। জায়গাটি আমাদের ছাদ থেকেও খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। তো একা একা কী করছেন?” “মেঘমালা মেহেদি রঙের শাড়ি পরে কীভাবে ক্লান্ত সূর্যকে বিদায় জানাচ্ছে তাই দেখছিলাম। আর আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। “কী করে জানলেন যে আমি আসব।” “আমার মন বলছিল আপনি আসবেন।” এভাবেই তাদের মধ্যে কথার মালা রচিত হয়। জানা হয় দুজনারই আকাশের নীল আর মেহেদী রং খুব পছন্দ। কথাপ্রসঙ্গে আসিফ সাহেব বলেন, একদিন মার্কেটে দেখলাম রুমকি আপনার সঙ্গে কথা বলছে। তারপর একদিন জানলাম আপনারা দুজন বান্ধবী। দুই একটি কথাও হলো। আমার খুব ইচ্ছে করছিল আপনার সঙ্গে কথা বলব। তাই অনেকদিন ধরেই ওর কাছে অন্যায় আবদার করেছি। কিছু মনে করবেন না। মিনারা বিদায় নেওয়ার পর ভালোলাগার রেশটা আসিফের হৃদয় জুড়ে একাকার হয়ে যায়।
সেদিন আসিফ সাহেবের সঙ্গে দেখা করার পর মিনারার নির্ঘুম রাত কেটেছে। মমিনের সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে মিনারা আর কোন পুরুষের আবেগে সাড়া দেয়নি। দীর্ঘ সাতবছর পর এই প্রথম বারের মতো আসিফ সাহেবের সঙ্গে মিনারা আবেগপ্রবণ হয়ে কথা বলে। মনের মধ্যে উদিত হওয়া হাজার প্রশ্ন আন্দোলন করে। কিছু প্রশ্নের উত্তরও যেন মিনারাকে প্রবোধ দেয়। জীবন সঙ্গী হিসেবে মিনারা এতদিন যেরকম পুরুষের স্বপ্ন দেখেছিল সেসব বৈশিষ্ট্যগুলো একদিনের পরিচয়েই সে আসিফের মধ্যে খুঁজে পায়। তাই মন থেকে তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। একটা ভালোবাসার তাগিদ তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। নতুন করে তাকে ভাবিয়ে তোলে। পরক্ষণেই আবার তার বুকের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে। কোন ভুল করতে যাচ্ছি নাতো? ঠোঁট উল্টিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে। উত্তর না পাওয়ায় মনের মধ্যে প্রশ্নটি বার বার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। তবুও আসিফের সঙ্গে দেখা হয় বার বার। এভাবে দেখতে দেখতে আরও কয়েকমাস চলে গেল। আসিফের প্রতি তার ভেতরে এক ধরনের ভালো লাগা চেপে বসে আছে। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলেও সামনে এসে দাঁড়ায় আসিফের মায়াভরা মুখখানি। একপর্যায়ে আসিফের বিষয়টি মিনারার মা-বাবাও একদিন জানতে পারে। মা-বাবা তাদের ভালোলাগাকে অসম্মান করেননি। অবশেষে উভয় পরিবারের সম্মতিতেই তারা আবার নতুন করে জীবন শুরু করে।
বিয়ের পর আসিফ সাহেব শহরের মধ্যে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। সেখানেই তারা সাংসারটা ভালোভাবে শুরু করে। জীবনটা যে এত মধুর তা আসিফের সংস্পর্শে না এলে মিনারা বুঝত না। সারাদিন ক্লান্ত হয়ে আসিফ যখন বাসায় ফিরে আসে তখন মিনারা তার দুই কপোলে ঠোঁঠের তুলিতে চাঁদের ছবি এঁকে দেয়। আসিফও তাকে বুকে চেপে ধরে প্রাণভরে তনুর সুঘ্রাণ নিয়ে মুগ্ধ হয়। এভাবেই তাদের দাম্পত্য জীবন সুখ-শান্তিতেই কাটতে থাকে। একদিন আসিফ অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর মিনারা লক্ষ করে যে, তার চাঁদমুখে কালোমেঘের আভা। মনটা ভীষণ খারাপ। কারণ জানতে চাইলে অফিসে ঝামেলা যাচ্ছে বলে এড়িয়ে যান। মিনারাও অনধিকার চর্চা করে প্রশ্নের বানে তাকে জর্জরিত করেনি। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই মিনারা দেখে যে, আসিফের মনটা প্রায়ই খারাপ থাকে। সেসময় মিনারার সান্নিধ্যও তার কাছে বিরক্তির সৃষ্টি করে। এভাবে আরও কিছুদিন কেটে গেল।
একদিন ছুটির দিনে মিনারা ঘর গোছানের কাছে ব্যস্ত ছিল। আসিফ ছিল বাড়ির বাইরে। আসিফের একটি স্যুটকেচের ডালা উল্টাতেই পুরাতন একটা এ্যালবাম তার চোখে পড়ে। এ্যালবামের কয়েকটি পাতা উল্টাতেই সে চমকে ওঠে। মোমিনের সঙ্গে আসিফের ছবি! কবে থেকে ওর সঙ্গে পরিচয়? ও কি জানে মোমিনের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছিল? তবে কি ডিভোর্সের ঘটনা জানার পরই কি আসিফের মনটা খারাপ? এরকম হাজারও প্রশ্নের উদয় হয় তার মনের আঙ্গিনায়। খাটের উপর বসে এ্যালবামের সবকটি পাতা উল্টাতে থাকে। আরও কয়েকটি গ্রæপ ছবিতে ওদের দু’জনকে একসাথে দেখা গেল। মিনারার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কী এক অজানা গর্জনে কেঁপে ওঠে সে। চোখের জল সংবরণ করতে পারে না। তপ্ত অশ্রুতে এ্যালবামের প্রতিটি পাতা ভিজে যায়। সে মনে মনে ভাবে আসিফ বোধ হয় সবকিছু জেনে গেছে। তাই আমার সঙ্গে ইদানিং ভালো ব্যবহার করছে না। সে এই চাপা যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়- আপাতত কয়েকদিনের জন্য বাবা-মায়ের কাছে থেকে আসি। তাই সে দ্রুত জামাকাপড় গুছাতে থাকে। এমনসময় আসিফের আগমন। সে দরজায় নক করে। নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে মিনারা দরজা খুলে দেয়। স্ত্রীর অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রীর ওপর ঘন মেঘের ঘনঘটা। অপ্রসন্ন মেঘাচ্ছন্ন মুখচ্ছবি দেখে আসিফ প্রশ্ন করে- কোথাও যাচ্ছ মনে হয়? “একটু বাড়িতে যাব।” “হঠাৎ? কোন সমস্যা?” “না। এমনিতেই যাচ্ছি।” আসিফ মনে মনে ভাবে কিছু একটা হয়েছে। নইলে...। তাই সে আর ওর পথ রুদ্ধ করেনি। কোন কথা না বাড়িয়ে ওকে বাড়িতে যেতে সাহায্য করে। এতে সন্দেহের ঘুণপোকার দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়।
-অসমাপ্ত
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন