আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে কর্মীরা : গরিব মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে -কাউন্সেলর (শ্রম)
শামসুল ইসলাম : সম্ভাবনাময় ব্রæনাইয়ের শ্রমবাজার সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রের দখলে। পাচারকারী চক্র গ্রামাঞ্চলের নিরীহ সরলমনা কর্মীদের ব্রæনাইয়ে বেশি বেতনে চাকুরি দেয়ার নাম করে দেশটিতে নিয়ে গভীর জঙ্গলে এক ধরনের টার্চার সেলে আটকে রাখছে। প্রতারক চক্র অনেক কর্মীকে এক বেলা খাবারও দিচ্ছে না। অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটায় এসব কর্মীরা। নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার কর্মীরা পালিয়ে ব্রæনাই দারুসসালামস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে আশ্রয় নিচ্ছে। ব্রæনাই একটি উদীয়মান শ্রমবাজার। বাংলাদেশ হাইকমিশন এ শ্রমবাজার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্ত দালাল-প্রতারক চক্রের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের দরুন এ শ্রমবাজার ও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি গভীর সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে । অভিজ্ঞ মহল এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে টাকা তুলতে না পেরে মানবপাচারকারী চক্রের প্রতারণার শিকার ব্রæনাইতে কর্মরত বাংলাদেশী কর্মীদের কেউ কেউ আতœহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অভিবাসী কর্মীদের অধিকার সুরক্ষা এবং শ্রমবাজার ধরে রাখার লক্ষ্যে হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে। এতে ব্রæনাই অভিবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করছে বলেও হাই কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
গত বুধবারও ব্রæনাইয়ের জঙ্গল থেকে পালিয়ে হাই কমিশনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ঝিনাইদহ জেলার কর্মী ইউনুস ও জহিরুল ইসলাম। মানবপাচারকারী’র মূল হোতা ইলিয়াস, কবির ও দালাল নূর মোহাম্মদের মাধ্যমে উল্লেখিত দু’জন কর্মী ব্রæনাইয়ে গিয়ে বিগত ১৪ মাস যাবত কোনো কাজ পাচ্ছে না। এর মধ্যে মাত্র তিন মাস পালিয়ে পালিয়ে কিছু কাজ করেছে তারা। হাই কমিশনের কাউন্সেলর (শ্রম) শফিউল আজিম এতথ্য জানিয়েছেন। হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ প্রতারণার শিকার এসব অসহায় কর্মীদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করতে হিমসিম খাচ্ছে। হাই কমিশনের উদ্যোগে চিহ্নিত মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। কেউ কেউ গ্রেফতারও হচ্ছে। গত রোববার রাতে মাদারীপুর জেলার শিবচার থানার উৎরাইল গ্রামের শামসুল বেপারী’র ছেলে মানবপাচারকারী এ এম সফিকের ভাই দালাল রফিককে থানা পুলিশ গ্রেফতার করে মাদারীপুর কারাগারে পাঠিয়েছে। প্রতারণার শিকার সালাউদ্দিনের স্ত্রী নিপা এতথ্য জানিয়েছেন। ঢাকার লালবাগের ইসলামবাগের সোনা মিয়ার ছেলে মানবপাচারকারী মনির হোসেন ও মাদারীপুরের শিবচরের উৎরাইল গ্রামের শামসু বেপারীর ছেলে এ এম সফিক শিবচরের একই এলাকার সালাউদ্দিন বেপারীকে কম্পিউটারের দোকানে ৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি দেয়ার নাম করে গত নভেম্বর মাসে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে ব্রæনাই নিয়ে যায়। একই থানার মগরা পুকুরপাড় গ্রামের মোহাম্মদ আরিফুল হককে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে গত জানুয়ারী মাসে এবং রাজৈর থানার বিদ্যানন্দী গ্রামের মো: ইমারাত হাওলাদারকে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে গত ৯ অক্টোবর ব্রæনাই নিয়ে যায়। ব্রæনাই বিমান বন্দর থেকে এদের গ্রহণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে বন্দী করে রাখে। ঐ জায়গাটি মানবপাচারকারী মনির হোসেনের ভাড়া করা জায়গা। অসহায় এসব কর্মীদের রেখে গা ঢাকা দেয় মানবপাচারকারীরা। দীর্ঘ দিন কোনো কাজ না দিয়ে তাদেরকে নানা হুমকি দেয়া হয়। মানবেতর জীবন যাপনের পর অবশেষে নিরুপায় হয়ে কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশীর সহায়তায় তারা দারুসসালামস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
গত ১০ মার্চ মানবপাচারকারী মনির হোসেন ও সফিককে হাই কমিশনে ডেকে নিয়ে প্রতারণার শিকার এসব কর্মীদের টাকা ফেরত দিতে চাপ দেয়া হয়। তারা অসহায় কর্মীদের টাকা ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করে হাই কমিশন থেকে চলে যায়। কাউন্সেলর (শ্রম) এতথ্য জানান। এ এম সফিক গত ১২ মার্চ ব্রæনাই বেরাকাস পুলিশ স্টেশনে কাউন্সেলর (শ্রম) শফিউল আজিম, নাঈম ইসলাম মাহতাবসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে মারধোর করার দাবীতে মামলা দায়ের করেছে। মামলা নং বিকেএস/সিআর/৫০২/২০১৮। সে ব্রæন্ইাস্থ রিপাস হসপিটালে ভর্তি হয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেটও পুলিশ স্টেশনে দাখিল করেছে। এ ব্যাপারে বুধবার ব্রæনাইস্থ সফিকের মোবাইল ফোনে (০০৬৭৩-৮৬৫৩০৫২ ) ও মনিরের ০০৬৭৩-৬৭৩৭১০৩২৮ মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তারা ফোন ধরেনি। হাই কমিশনের ভেতরে তাদেরকে ঐ দিন মারধোর করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সেলর (শ্রম) শফিউল আজিম। তিনি বলেন, চোর ধরা পড়লে কত মিথ্যা কথা কয় তা’ সবাই জানেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অভিযুক্তরা ব্রæনাই পুলিশ স্টেশনে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। ব্রæনাই পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি স্বীকার করেছে। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে কাতারে দায়িত্ব পালনকালেও আমি অভিবাসী কর্মীদের স্বার্থে কয়েকজন মানবপাচারকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে সুনাম অর্জন করেছিলাম । প্রতারণার শিকার সালাউদ্দিন বেপারীর স্ত্রী নিপা বুধবার কান্না জড়িত কন্ঠে ইনকিলাবকে বলেন, প্রতারক সফিক ও মনির হোসেন ব্রæনাইতে ৪০ হাজার টাকা বেতনে কম্পিউটার দোকানে চাকুরি দেয়ার কথা বলে সালাউদ্দিনকে নিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। এরা মানবতার দুশমন। তিনি এসব মানবপাচারকারীদের কঠোর শাস্তির দাবী জানান। মাদারীপুর জেলা প্রশাসসের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ফারিহা তানজিন গত ১৫ মার্চ (২০১৮) মাদারীপুর পুলিশ সুপারের কাছে এক জরুরী চিঠিতে প্রতারক মনির হোসেন ও সফিকের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন।
হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, প্রবাসাী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সংশিষ্ট জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বিমান বন্দর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইমিগ্রেশন)-এর কাছে লিখিত ভাবে প্রস্তাব প্রেরণ করেছে। কাউন্সেলর (শ্রম) শফিউল আজিম বলেন, সম্ভাবনাময় ব্রæনাইয়ের শ্রমবাজারকে নস্যাৎ করার জন্য মানবপাচারকারী চক্র দীর্ঘ দিন যাবত অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই চক্র গ্রামাঞ্চলের গরীব মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। নিরীহ কর্মীদের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা করে নিয়ে ব্রæনাইতে নিয়ে ভাল চাকুরি দেয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রæতি দিয়ে অসহায় কর্মীদের উপর স্টীম রোলার চালাচ্ছে। ব্রæনাইয়ের গভীর জঙ্গলের ভেতরে টার্চার সেলে কর্মীদের আটক রেখে মারধোর করে দেশের আতœীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা আদায় করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ব্রæনাইয়ের শ্রমবাজার রক্ষা এবং দেশের ভাব-মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে অত্যান্ত শক্তিশালী মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে হাই কমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসাইনের নিদের্শে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও কাউন্সেলর (শ্রম) শফিউল আজিম জানান। ২শ’ ব্রæনাই ডলারের বিনিময়ে হাই কমিশন থেকে কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্রে সত্যায়ন দেয়ার অভিযোগ সর্ম্পূণ মিথ্যা বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ২০১৭ সালে ব্রæনাইতে ১৭ জন কর্মী মারা গেছে। তার মধ্যে মানবপাচারকারী চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে ৪ জন কর্মীই আতœহত্যা করেছে। বি-বাড়িয়া জেলার কসবা থানার শাহপুরের বাচ্চু মিয়ার ছেলে প্রতারক আসিফ (রাব্বি) আখাউড়া থানার ভাটামাতা গ্রামের শওকত সরকার, একই গ্রামের সাহাবুদ্দিন ও মান্দাইল গ্রামের খোরশেদ আলমের কাছ থেকে জন প্রতি ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা করে নিয়ে ভাল চাকুরি দেয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রæতি দিয়ে ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল ব্রæনাই নিয়ে যায়। তাদের কোনো কাজ না দিয়ে টালবাহানা শুরু করে প্রতারক আসিফ (রাব্বি)। পরে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল হাইকমিশনে উপস্থিত হয়ে আসিফ একই মাসের ১১ তারিখের মধ্যে প্রতারণার শিকার এসব কর্মীদের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি সুরাহার অঙ্গীকার দিয়ে কর্মীদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়ে গা- ঢাকা দেয়। এ ব্যাপারে ব্রæনাইস্থ পুলিশ স্টেশনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রতারক আসিফের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের আরো অভিযোগ রয়েছে। হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল বি-বাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে মানবপাচার আইন (২০১২) অনুযায়ী কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। আখাউড়া থানার মামলা নং -১১ (০৯/০৫/১৭)এর ভিত্তিকে বি-বাড়িয়ার জেলা জজ ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর প্রতারক আসিফ (রাব্বি’র) বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে। প্রতারণার শিকার শওকত সরকারের বড় ভাই বোরহান উদ্দিন সরকার রাতে ইনকিলাবকে বলেন, হাই কমিশনের সহযোগিতায় দেশ থেকে বিমানের টাকা পাঠিয়ে উল্লেখিত তিন জনকে অনাহার-অর্ধাহারে প্রায় অসুস্থ্য অবস্থায় ৪০ দিন পরেই দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। প্রতারক আসিফ (রাব্বি) এখনো ব্রæনাইয়ে পালিয়ে রয়েছে। তিনি প্রতারক আসিফকে অবিলম্বে গ্রেফতার পূর্বক দেশে ফিরিয়ে এনে টাকা উদ্ধার এবং কঠোর শাস্তির দাবী জানিয়েছেন। এদিকে,গত ১৯ মার্চ হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ কুমিল্লা সদরের দৌলতপুর গ্রামের মহিউদ্দিনের ছেলে কবিরের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগে অভিযুক্তদের পক্ষে ব্রæনাইয়ের প্রচলিত আইন ও জনস্বার্থপন্থী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে হাই কমিশনে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন