শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

লাইলাতুল বারা’আত বা ভাগ্যরজনী : করণীয় ও বর্জনীয়

ড. মুহাম্মদ নূরুল আমিন নূরী | প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে আমাদের সমাজে ‘শবে বারাত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। ‘শবে বারাত’ শব্দটি ফার্সি শব্দ। শব অর্থ রাত্রি, আর বারাত অর্থ, বন্টন বা ভাগ্য অর্থাৎ ভাগ্যরজনী। ’ইমাম তিরমিযী এই রাতকে ‘লাইলাতুল বারা’আত’ বা ভাগ্যরজনী নামকরণ করেছেন। (তিরমিযী, খ.১, পৃ.১৫৬) বারা‘আত শব্দটির অর্থ, ভাগ্য, যেহেতু এই রাত্রিতে মানবজাতির ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। বারা‘আত-এর আর একটি অর্থ, মুক্ত হওয়া, যেহেতু এই রাত্রিতে আল্লাহ্ তা‘আলা ‘ইবাদতকারীকে গুনাহ্ থেকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু হাদীছের ভাষায় এই রাত্রিকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান’ বা ‘শা‘বানের মধ্য রাত’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। ’ইমাম তিরমিযী, ইমাম বায়হাকী, ইমাম তাবারানী এবং ’ইমাম ’ইবন মাজাহ্ এই রাত্রির লাভ ও করনীয় সম্পর্কিত হাদীছ-এর অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন ‘বাবু মা জা’আ ফী ‘লাইলাতিন্ নিসফি মিন শা‘বান’ বা শা‘বানের মধ্য রাত সম্পর্কীয় অধ্যায়। ’ইমাম তিরমিযী অত্র অধ্যায়ের টিকায় উল্লেখ করেছেন, “এই রাত হলো ‘লাইলাতুল বারা’আত’। লাইলাতুল বারা’আত সম্পর্কে যে সমস্ত হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে তা সবই বিশুদ্ধ হাদীছ। যারা বলে এ সমস্ত হাদীছ দুর্বল ও মুনকার তাদের কোন ভিত্তি নেই। এসব ভিত্তিহীন কথা।” (তিরমিযী, খ.১, পৃ.১৫৬) । ’ইমাম কুরতুবী (র.) এই রাতকে ‘লাইলাতুল বারা’আত’ নামকরণ করেছেন, তিনি বলেন, কারো কারো মত হচ্ছে, ১৫ই শা‘বান রাতই হল আল্লাহ্র বাজেটের রাত। এ রাতকে ‘লাইলাতুল বারা’আত’ এই জন্য বলে, কারণ শা‘বানের ১৫ তারিখে এই রাতেই মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ.১৬,পৃ.১২৭)। ‘আল্লামা যামাখশরী (র.) বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা পূর্ণ এক বছরের পুরা বাজেট প্রণয়নের কাজ শা‘বানের ১৫ তারিখের রজনীতে শুরু করেন। আর এটার বিবরণ ফিরিশতাদের কাছে পূর্ণাঙ্গভাবে জানিয়ে দেন লাইলাতুল কদরে। (তাফ্সীরুল কাশ্শাফ, খ.৪,পৃ.২৭৪)। হযরত ‘উছমান ইবন মুগীরাহ্ (র.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, এক শা‘বান থেকে আগামী শা‘বান পর্যন্ত মানুষের জন্ম, মৃত্যু, রিযিক ইত্যাদি বিষয়াবলি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মানুষ বিবাহ করে, সন্তান জন্ম দেয় অথচ তার নাম মৃত্যুর তালিকায় রয়েছে। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ.১৬,পৃ.১২৬-১২৭)।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, “স্পষ্ট কিতাবের শপথ, নিশ্চয়ই আমি এট্ াবরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাত্রিতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা আমার পক্ষ থেকে স্থিরীকৃত হয়।” (সূরা দুখান, ৪৪:২-৫)। আলোচ্য আয়াতে ‘বরকতময় রাত’ বলতে কোন রাতকে বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে তাফ্সীরকারগণের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। অধিকাংশ তাফ্সীরবিদের মতে এখানে ‘লাইলাতুল কদর’ বোঝানো হয়েছে, এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ্ (স.) আরও বলেন, দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলা পয়গাম্বরগণের প্রতি যত কিতাব নাযিল করেছেন, তা সবই রমযান মাসেই বিভিন্ন তারিখে নাযিল হয়েছে। হযরত কাতাদাহ্ (র.) বর্ণিত রিওয়াইতে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, হযরত ’ইবরাহীম (আ.)-এর সহীফাসমূহ রমযানের প্রথম তারিখে, তাওরাত ছয় তারিখে, যবূর বার তারিখে, ইঞ্জীল আঠার তারিখে এবং কুরআন কারীম চব্বিশ তারিখ অতিবাহিত হওয়ার পর পঁচিশের রাত্রিতে অবতীর্ণ হয়েছে। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ.১৬,পৃ.১২৬)। হযরত ’ইবন ‘আব্বাস (র.) বলেন, ‘বরকতময় রাত’ অর্থ কুরআন অবতরণের রাত্রি অর্থাৎ ‘লাইলাতুল কদরে’ সৃষ্টি সম্পর্কিত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফায়সালা স্থির করা হয়, যা পরবর্তী ‘লাইলাতুল কদর’ পর্যন্ত এক বছরে সংঘটিত হবে। অর্থাৎ এ বছর কারা কারা জন্মগ্রহণ করবে, কে কে মারা যাবে এবং এ বছর কি পরিমাণ রিযিক দেয়া হবে। কিন্তু ‘ইকরামাহ্ (র.) প্রমুখ কয়েকজন তাফসীরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, এ ’আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে, লাইলাতুল বারা’আত অর্থাৎ শা‘বান মাসের পনের তারিখের রাত্রি বোঝানো হয়েছে। যেহেতু এই রাত্রিতে জন্ম-মৃত্যুর সময় ও রিযিকের ফায়সালা লেখা হয়। পূর্ণ এক বছরের যবাতীয় বিষয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারা জীবিত থাকবে, কারা মৃত্যুবরণ করবে, কারা হজ্ব পালন করবে, এতে একজন বৃদ্ধিও করা হবে না, একজন হ্রাসও করা হবে না। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ.১৬,পৃ.১২৬,)। লাইলাতুল বারা’আত ও লাইলাতুল কদরের মধ্যে সমন্বয় করে হযরত ‘আব্দুল্লাহ্ ইবন ‘আব্বাস (র.) বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা শা‘বানের পনেরতম রাতে সিদ্ধান্তসমূহ চূড়ান্ত করেন, এবং লাইলাতুল কদরে তা বাস্তবায়নকারী ফিরিশতাদের হাতে সোপর্দ করেন। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ.২০,পৃ.১৩০)।
ফাদাইল বা লাভ : লাইলাতুল বারা’আত বা ভাগ্যরজনী সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছ ও তাফ্সীর গ্রন্থে অসংখ্য হাদীছ রয়েছে, তৎমধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো নিম্নে পেশ করা হলো, (১)- হযরত ‘আয়িশা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একরাত্রে আমি রাসূলুল্লাহ্ (স.)-কে ঘরে না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। তখন দেখলাম তিনি জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে আসমানের দিকে মাথা মুবারক উত্তোলন করে অবস্থান করছেন। আমাকে সেখানে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (স.) বললেন, হে ‘আয়িশা (র.)! তুমি কি এ ভয় করছে যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবে। তিনি বললেন, আসলে আমার কাছে এমন কিছু নেই বরং, আমি ধারণা করছি যে, আপনি আপনার কোন স্ত্রীর হুজরায় তাশরিফ নিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (স.) ’ইরশাদ করলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা শা‘বানের পনেরতম রাতে প্রথম আসমানে তাশরীফ আনেন। অতঃপর কলব গোত্রের মেষগুলোর লোম এর সংখ্যার চেয়েও অধিক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (ইবন মাজাহ, খ.১, হা.নং ১৩৮৯ পৃ.৪৪৪; তিরমিযী, খ.৩, হা.নং ৭৩৯ পৃ.১১৬; মুসনাদু ’আহমদ ইবন হাম্বল, খ.৪৩, হা.নং ২৬০১৮, পৃ.১৪৬; শু‘আবুল ’ঈমান, খ.৩, হা.নং ৩৮২৫ পৃ.৩৭৯; শারহুস সুন্নাহ, খ.১,পৃ.২৩৮; মুসান্নিফু ইবন আবী শায়বা, খ.৬, হা.নং ২৯৮৫৮ পৃ.১০৬ )। (২)- হযরত মু‘আয ’ইবন জাবাল (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (স.) থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা শা‘বানের পনেরতম রাতে স্বীয় সৃষ্টির প্রতি রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করেন। (আল-মু‘জামুল ’আওসাত, খ.৭, হা.নং ৬৭৭৬, পৃ.৩৬; আল-মু‘জামুল কাবীর, খ.২০, হা.নং ১৬৯৭২, পৃ.১০৮; ’ইবন মাজাহ, খ.১, হা.নং ১৩৯০ পৃ.৪৪৫; সাহীহ্ ’ইবন হাব্বান, খ.১২, হা.নং ৫৬৬৫ পৃ.৪৮১; মুসনাদুশ শামী’ঈন, খ.৪, হা.নং ৩৫৭০ পৃ.৩৬৫ )। (৩) হযরত ’আবূ বকর সিদ্দীক (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ’ইরশাদ করেন, যখন পনেরই শা‘বানের রাত হয়, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা প্রথম আসমানে তাশরীফ আনেন এবং সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, মুশরিক এবং অপর ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত। (মাজমা‘উয যাওয়াইদ, খ.৮, হা.নং ১২৯৫৭ পৃ.১২৫; শু‘আবুল ’ঈমান, খ.৩, হা.নং ৩৮২৭ পৃ.৩৮০; মুস্নাদুল বায্যায, খ.১, পৃ.৩০। (৪) হযরত ‘আব্দুল্লাহ্ ইবন ‘আমর (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ’ইরশাদ করেন, মহিমান্বিত আল্লাহ্ শা‘বানের পনেরতম রাতে স্বীয় সৃষ্টির প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং দু’প্রকার বান্দা ব্যতিরেকে সবাইকে ক্ষমা করে দেন। ১. হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী, ২. অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকারী। (মুসনাদু ’আহমদ ইবন হাম্বল, খ.১১, হা.নং ৬৬৪২৮, পৃ.২১৬; মাজমা‘উয যাওয়াইদ, খ.৮, হা.নং ১২৮৬১ পৃ.১২৬)। (৫) হযরত ‘আলী ইবন ’আবী তালিব (র.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ’ইরশাদ করেন, যখন শা‘বানের পনেরতম রাত হয়, তখন তোমরা রাতে নামায পড় এবং দিনে রোযা পালন কর। কেননা, ঐ দিন সূর্যাস্তের সময় আল্লাহ্ তা‘আলা প্রথম আসমানে তাশরীফ এনে বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারী কেউ আছ, আমি তাদের ক্ষমা করব, রিযিক অন্বেষণকারী কেউ আছ, আমি তাকে রিযিক দান করব, অসুস্থ কেউ আছ, আমি তাকে সুস্থতা দান করব। এভাবে অন্যান্য বিষয়েও বলতে থাকেন ফযর হওয়া পর্যন্ত। (ইবন মাজাহ, খ.১, হা.নং ১৩৮৮ পৃ.৪৪৪; শু‘আবুল ’ঈমান, খ.৩, হা.নং ৩৮২২ পৃ.৩৭৮)। (৬) হযরত ’আবূ মূসা আশ‘আরী (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (স.) থেকে বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা শা‘বানের পনেরতম রাতে সৃষ্টির প্রতি কৃপা দৃষ্টি দেন এবং সকলকে ক্ষমা করেন, মুশরিক এবং বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতিরেকে। (ইবন মাজাহ, খ.১, হা.নং ১৩৯০ পৃ.৪৪৫)। (৭) হযরত ‘আয়িশা (র.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ’ইরশাদ করেন, যখন শা‘বানের পনেরতম রাত হয় কলব গোত্রের মেষগুলোর লোম এর সংখ্যার চেয়েও অধিক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (শু‘আবুল ’ঈমান, খ.৩, হা.নং ৩৮২৪ পৃ.৩৭৯ )। (৮) হযরত ‘উছমান ইবন ’আবীল ‘আস (র.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ’ইরশাদ করেন, যখন শা‘বানের পনেরতম রাত হয়, তখন একজন ঘোষণাকারী এই মর্মে ঘোষণা করবে, ক্ষমাপ্রার্থনাকারী কেউ আছ, আমি তাদের ক্ষমা করব, যাচনাকারী কেউ আছ, আমি তার যাচনা প্রদান করব, এভাবে যে কেউ যা চায় তা তাকে প্রদান করা হয়। তবে ব্যবিচারিনী মহিলা এবং মুশরিক-এর দু‘আ কবূল হয় না। (শু‘আবুল ’ঈমান, খ.৩, হা.নং ৩৮৩৬ পৃ.৩৮৩ )। (৯) হযরত ‘আয়িশা (র.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) আমাকে বললেন,) হে ‘আয়িশা (র.)! হযরত জিবরীল (আ.) আগমন করে বললেন, এই রাত্রী শা‘বানের মধ্য রাত। এই রাত্রে কলব গোত্রের মেষগুলোর লোম এর সংখ্যার চেয়েও অধিক বান্দাকে ক্ষমা করে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু এই রাত্রে কয়েক ব্যক্তির দিকে রাহমতের দৃষ্টিতে থাকাবে না। এক. মুশরিক, দুই. হিংসুক, তিন.আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী, চার. অহংকারবশত টাখনুর নিচে যে কাপড় ঝুলায়, পাঁচ. পিতা-মাতার অবাধ্যকারী, ছয়. মদপানকারী। (শু‘আবুল ’ঈমান, খ.৩, হা.নং ৩৮৩৭ পৃ.৩৮৩; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, খ.৩, হা.নং ৩১০৩ পৃ.৬৭)। (১০) হযরত ’আবূ বকর (র.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ’ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা শা‘বানের মধ্য রাতে দুনিয়ার আকাশে চলে আসেন, প্রত্যেক মু’মিনকে ক্ষমা করে দেন, কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্য এবং হিংসুককে ক্ষমা করেন না। (কানযুল ‘উম্মাল, খ.৩, হা.নং ৭৪৫৮ পৃ.৪৬৬ )। (১১) হযরত ‘আয়িশা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাত্রে আমি রাসূলুল্লাহ্ (স.) -কে সিজদা অবস্থায় ক্রন্দন করতে দেখলাম। আমি অপেক্ষা করলাম। কিছুক্ষণ পর মাথা উত্তোলন করে বললেন, ‘আয়িশা (র.) তুমি কি জান এটি কোন রাত? তিনি (স.) বললেন, এটি হলা শা‘বানের মধ্যরাত। এই রাত্রে আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের গুনাহ্সমূহ ক্ষমা করে দেন, যদিও তা উহুদ পাহাড় পরিমাণ হয়।
ইমাম শাফি‘ (র.) বলেন, পাঁচটি রাত্র দু‘আ কবূল হয়, এক. জুমা‘আর রাত, দুই. ‘ঈদুল আদহার রাত, তিন. ‘ঈদুল ফিতরের রাত, চার. রজব মাসের প্রথম রাত, পাঁচ. শা‘আবানের মধ্য রাত। (শু‘আবুল ’ঈমান, খ.৩, হা.নং ৩৭১১ পৃ.৩৪১ )। হযরত ‘আব্দুল্লাহ্ ইবন ‘উমর (র.) বলেন, পাঁচটি রাত এমন রয়েছে যেখানে দু‘আ করলে দু‘আ ফেরত হয় না। জুমা‘আর রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শা‘বানের মধ্য রাত , দুই ‘ঈদের দুই রাত। (শু‘আবুল ’ঈমান, খ.৩, হা.নং ৩৭১৩ পৃ.৩৪২ )।
এই রাত্রে করনীয়: এই রাত দু‘আ কবূল হওয়ার রাত, ’ইবাদতের রাত, তাওবার রাত, পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করার রাত। সুতরাং আমরা এই রাত্রে তাহাজ্জদ নামাযসহ নফল নামায বেশি বেশি পড়ি, যিকর করি, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াক করি, কবর যিয়ারত করি, গরীব-মিসকীনক, অসহায়কে দান করি। সম্ভব হলে সাড়া রাত জেগে ‘ইবাদত করি, সেহরী খেয়ে পরের দিন রোযা রাখি এবং ফযরের নামায মসজিদে এসে জামা‘আতের সহিত আদায় করি। যেন এমন না হয়, সারা রাত ‘ইবাদত করতে করতে ফযরের নামায ছুটে যায়। মোটকথা হলো এই রাত্রিতে যথাসম্ভব যিকর-কুরআন তিলাওয়াত, নামাযে মশগুল থাকি। এমনিতেই প্রত্যেক মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখ রোখা রাখা সুন্নাত। আল্লাহ্ তা‘আলা প্রশংসা ও রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর উপর দরুদ পাঠ করে নিজের জন্য, সন্তান-সন্ততীর জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে, পাড়া-প্রতিবেশির জন্য, সমস্ত মু’মিন-নারী-পুরুষের জন্য লম্বা লম্বা দু‘আ করি। হযরত ‘আয়িশা (র.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) শা‘বানের মধ্য রাতে সিজদা অবস্থায় দু‘আ করতেন এবং বলতেন, হে আল্লাহ্ আমি তোমার ক্ষমার মাধ্যমে তোমার শাস্তি থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। (কানযুল ‘উম্মাল, খ.১৪, হা.নং ৭৮২৯০ পৃ.১৭৬)। এই রাত্রিতে ১.মুশরিক, ২.হিংসুক, ৩.আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী, ৪.পিতা-মাতার অবাধ্যব্যক্তি, ৫.মদপানকারী, ৬.ব্যবিচারে লিপ্ত ব্যক্তি, ৭.অহংকারবশত টাখনুর নিচে যে কাপড় ঝুলায়, ৮.যাদুকর, ৯.কৃপণব্যক্তি, ১০.বিদ্বেষ পোষণকারী, ১১.অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকারী, ১২.গীবাতকারী- এসমস্ত ব্যক্তিদেরকে এই রাত্রিতে ক্ষমা করা হবে না। সুতরাং তাদের উচিত এই রাত্রিতে একনিষ্টভাবে তাওবা করা, গুনাহের উপর লজ্জিত হওয়া, বর্তমানে এগুলো পরিত্যাগ করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এসমস্ত অপকর্ম পরিত্যাগ করার দৃঢ় পরিকল্পনা করে আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান। কাজেই আমরা এই রাত্রে ঘরে কিংবা মসজিদে নীরব জায়গায় আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে কান্নার চেষ্টা করব। কারণ, এই রাত হচ্ছে কান্নার রাত, তাওবা করার রাত। আল্লাহ্ তা‘আলা এই রাতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষকে ক্ষমা করবেন। আর আমি যেন এই লক্ষ মানুষের বাহিরে না থাকি। এ জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে ফুঁপিয়ে কাঁদতে হবে। যার চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্র“ বের হবে একমাত্র আল্লাহকে রাজি করার জন্য, কাউকে দেখানোর জন্য নয়, তাহলে সে চোখকে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা। এই রাত্রিতে কবর যিয়ারত করার চেষ্টা করব। কারণ হযরত ‘আয়িশা (র.)-এর হাদীছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, এ রাতে রাসূলুল্লাহ্ (স.) -কে জান্নাতুল বাকীতে যিয়ারত করা অবস্থায় তিনি দেখতে পেয়েছেন। হযরত ‘আয়িশা (র.) বলেন, সেই রাতে রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর আমার ঘরে রাত্রি যাপন করার পালা ছিল। অর্ধেক রাতের পর তিনি শোয়া থেকে উঠলেন। চাদর গায়ে দিতে গিয়ে দেখেন তাঁর চাদরের আঁচলটি আমার পিঠের নীচে পড়েছে। আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে মনে করে তিনি চাদরটি রেখেই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমার যেন ঘুম ভেঙ্গে সেজন্যে আস্তে করে জুতা পায়ে দিলেন, আস্তে করে দরজা খুললেন এবং আস্তে করে বাহির হয়ে গেলেন। আমি সবই দেখছিলাম। এইবার আমি উঠলাম। দূরত্ব বজায় রেখে তাঁর পিছনে পিছনে যেতে লাগলাম। দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম তিনি ‘জান্নাতুল বাকী’ কবরস্থানে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দু‘আ করছেন। দু‘আ শেষ করে পিছনের দিকে ফিতে যাবেন, তার আগেই আমি দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তিনি ঘরে এসে মুনাজাত করে আমার দিকে তাকালেন। আমি তখন হাঁপাচ্ছিলাম। তিনি জজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে ‘আয়িশা! তুমি এমন হাঁপাচ্ছো কেন?” আমি তখন সব ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বললেন, তুমি কি মনে কর আল্লাহ্ তা‘আলা এবং রাসূলুল্লাহ্ (স.) তোমার উপর অবিচার করবেন? অর্থাৎ তোমার পালার রাত্রিতে তোমার হক নষ্ট করে আল্লাহ্ তা‘আলার রাসূল কি অন্য বিবির ঘরে যাবেন? অতঃপর তিনি বললেন, আজকের রাত কিসের রাত জান আয়েশা? আজ শা‘বান মাসের পনের তারিখের রাত। আল্লাহ্ তা‘আলা এই রাতে দুনিয়ার আকাশে আগমন করেন এবং সবাইকে ক্ষমা করে দেন। আজ রাত জিবরীল (আ.) আমার নিকট আগমন করল। অতঃপর নির্দেশ দিলেন যে, আমি বাকী‘ কবরস্থানে আগমন করি অতঃপর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। (আন-নাসা’ঈ, আস-সুনানুল কুরবা, খ.৮, হানং৮৮৬১, পৃ.১৫৯)।
এই রাত্রিতে অধিক হারে নফল নামাজ আদায় করার জন্য চেষ্টা করব। দু’রাকা‘আত নফল নামাজ যদি আল্লাহ্ তা‘আলার দারবারে কবূল হয় আমরা জান্নাতে যাওয়ার জন্য সে দু‘রাকা‘আতই যথেষ্ট হয়ে যাবে। শা‘বান মাসে রাসূলুল্লাহ্ (স.) বেশি রোজা রাখতেন। বিশেষ করে মধ্য শা‘বান ১৫ তারিখের রোজা রাখার কথা হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। যেহেতু রাসূল (স.) বলেছেন, যখন শা‘বানের মধ্যরাত আসবে তখন তোমরা আল্লাহ্র দরবারে কান্নাকাটি কর, ’ইবাদতের মাধ্যমে রাতকে জাগ্রত কর। আর দিনের বেলায় রোজা রাখ। বিশেষ করে মধ্য শা‘বানের এই রাতে তাহাজ্জদ নামায যেন কারো ছুটে না যায়।
মূলত উপরোক্ত হাদীছসমূহ থেকে শা‘বানের মধ্যরজনীতে সর্বমোট চারটি আমলের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এক. ১৪ই শা‘বান দিবাগত রাত জাগরণ করে ‘ইবাদত তথা নামায, যিকির, কুরআন তিলাওয়াত, তাস্বীহাত, ’ইস্তিগ্ফার, দরুদ শরীফ বেশি বেশি করা।
দুই. ১৫ই শা‘বান দিনে রোযা রাখা।
তিন. ১৪ই শা‘বান দিবাগত রাতে তাওবা করে গোনাহ্ মুক্ত হওয়া। তবে পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য খাঁটি মনে তওবা করা জরুরী। তওবা কবূল হওয়ার জন্য চারটি শর্ত আছে। ১. অতীতে যত গোনাহ্ হয়ে গেছে তার জন্যে মনে মনে অনুতাপ করতে হবে। কৃত গোনহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। গোনাহের জন্য অনুতপ্ত না হয়ে শুধু মুখে মুখে ‘আল্লাহ্ ক্ষমা করে দাও, আল্লাহ্ ক্ষমা করে দাও’ বললে গোনাহ্ ক্ষমা হবে না। ২. যে গোনাহ্ থেকে তওবা করবে সেই গোনাহ্ ছেড়ে দিতে হবে। গোনাহ্ জারি রেখে মুখে মুখে শতবার ক্ষমা চাইলেও গোনাহ্ ক্ষমা হবে না। ৩. আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে এরূপ দৃঢ় ওয়াদা করতে হবে যে, আগামীতে আর কখনও ঐ গোনাহ্ করবো না। ৪. গোনাহ্টি যদি কোন বান্দার হক নষ্ট করার দরুন হয়ে থাকে তবে সেই বান্দার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছ থেকেও ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। বান্দা যদি ক্ষমা না করে তবে আল্লাহ্ তা‘আলাও ক্ষমা করবেন না।
চতুর্থ. কবর যিয়ারত করে মৃত ব্যক্তিদের জন্যে দু‘আ করা।
এই রাত্রিতে বর্জনীয়: মসজিদ, কবরস্থান, ঘরকে আলোকসজ্জা করা, মহিলারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া। (কারণ মহিলাদের জন্য ‘ইবাদতের সবোত্তম স্থান হলো নিজের ঘরের ভিতরের রুম।) এই মসজিদ থেকে ঐ মসজিদে যাওয়াকে ছাওয়াবের কাজ মনে করা, ইত্যাদি অপসংস্কার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরী।
উপরোক্ত হাদীছগুলো প্রমাণ বহন করে যে, শা‘বানের মধ্যরাতে ‘ইবাদত করে এবং ১৫ই শা‘বান দিনে রোযা রেখে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে নিজের গুনাহ মার্জনা করার উপযুক্ত সময়। নিজের ভাল উদ্দেশ্যগুলো আল্লাহ্ তা‘আলার দারবারে পেশ করে আদায় করে নেয়ার সময়। তাওবা করে নিজের ভূল সংশোধন করে দ্বীনদার হওয়ার সময়। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে সংশোধন হওয়ার সময়। নিজের দোষের দিকে তাকিয়ে সংশোধন হওয়ার চেষ্টা করার সময়, সর্বসময় অপরের ভাল-গুণগুলো দেখে অবলম্বনের সময়, নিজের মৃত্যুর কথা স্বরণ করার সময়, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময়।
নফল-মুস্তাহাব নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত না হয়ে, আত্মশুদ্ধি করার সময়। হিংসা-বিদ্ধেষ, গীবাত, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যা, অপবাদ, মদ পান, হারাম ভক্ষণ, যুলম-অন্যায়-অবিচার ইত্যাদি মন্দকাজগুলো পরিহার করে আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে তাওবাই নাসূহা তথা খালিছ তাওবা করার সময়। নিজের আখ্লাককে রাসূলের আখ্লাকের মত সুন্দর করার উপযুক্ত সময়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে হিদাইত দিতে চান তার বক্ষকে উম্মুক্ত করে দেন, খুলে দেন, প্রশস্ত করে দেন ইসলামের জন্য। (সূরাতুল ’আন‘আম: ৬:১২৫)। হযরত ’আবূ জা‘ফর (র.) বলেন, যখন এই ’আয়াতটি অবতীর্ণ হল, তখন সাহাবাই কিরাম (র.) বলেন, কিভাবে বক্ষ প্রশস্ত হয়? রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলেন, যখন অন্তরে আল্লাহ্র নূর আগমন করে তখন বক্ষ প্রশস্ত হয়ে যায়, তখন তারা আবার প্রশ্ন করলেন, এর কি কোন নিদর্শন রয়েছে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলেন, হ্যাঁ, চিরস্থায়ী ঘর পরকালের প্রতি মনোনিবেশ হওয়া ও প্রতারণার ঘর দুনিয়া থেকে বিমুখ হওয়া এবং মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর জন্য তৈরি করা। (তাফ্সীরুত তাবারী, খ.১২, পৃ.৯৮)। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন এবং ভাল কাজের তাওফীক দান করুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন