ফিরোজ আহমাদ
সূরা মায়েদার ৩৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, “হে মানুষ তোমরা যারা ঈমান এনেছো, মহান আল্লাহকে ভয় করো এবং তাকে পাওয়ার জন্য উপায় খোঁজতে থাকো।” আল্লাহর প্রেমিকগণ যুগে যুগে তার আপন প্রভুর সাক্ষাতের জন্য অলি-আউলিয়াদের সান্নিধ্যে গিয়ে উছিলা তালাশ করেছেন। সূরা আল ইমরানের ১০৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্য থেকে একটি দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দিবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম। আল্লাহ পাকের প্রেমিকের সন্ধানে অলি-আউলিয়ারা জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কলেমার দাওয়াত নিয়ে হিজরত করেছেন। কেউ রাসূল (সা.) কর্তৃক স্বপ্নে আর্দিষ্ট হয়ে কেউ আপন পীর মুর্শিদের নির্দেশে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে পাহাড়, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে আল্লাহর প্রেমিকগণের নিকট কলেমার দাওয়াত নিয়ে এসেছেন। সেই থেকে তিনশত ষাট আউলিয়ার বাংলাদেশ। বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম। লাল দীঘির হযরত আমানত শাহ (রহ.)। সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহ পরান (রহ.)। রাজশাহীর হযরত শাহ মাখদুম রূপোষ (রহ.)। ঢাকার হযরত শাহ আলী বোগদাদী (রহ.)। কুমিল্লার হযরত আইন উদ্দিন শাহ (রহ.) ও শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরী (রহ.)। এই রকম প্রবাদ আমাদের সমাজে প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে মদিনার কামলে ওয়ালা নবী দৈহিকভাবে সরাসরি আসেননি। তবে প্রিয় নবী আশেকের ঘুমের ঘরে বহুবার আগমন করেছেন। রাসূল (স.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে যারা বাংলাদেশে কলেমার দাওয়াত নিয়ে এসছেন এমন অসংখ্য অলি আউলিয়া গাউছ দরবেশ কতুবের মাজার দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে। ইহা নিশ্চয় আমাদের জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নেয়ামত। যে দেশে গুণীজনের কদর নেই সেখানে গুণীজন জন্মায় না। বাংলাদেশের মানুষ গুণীজনদের ভালবাসে বিধায় অসংখ্য গুণী ব্যক্তি আউলিয়ারা এসেছেন।
সূরা ইউনূছের ৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, জেনে রাখো, আল্লাহ পাকের বন্ধুদের (আউলিয়া) কোন ভয় নেই, তারা চিন্তিত হবেন না। আউলিয়াদের জীবন কোরআনি জিন্দেগী। আউলিয়াদের জীবন কেটেছে কোরআন তেলেয়াত ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে। জগৎ বিখ্যাত আউলিয়া খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি ও হযরত আবদুল বারী শাহ (রহ.) ব্যক্তি জীবনে কোরআনের হাফেজ ছিলেন। হযরত আবদুল বারী শাহ (রহ.) এতটাই শরীয়তের পাবন্দ ছিলেন যে ৫০০ গজের ব্যবধানে ২টি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। হযরত শাহানশাহ জিয়াউল হক মাইজভা-ারী দিনের পর দিন ঘরের দরজা জালানা বন্ধ করে আবদ্ধ অবস্থায় থাকতেন। কোন কোন সময় তিনি লোক সমাজের নোংরা জীবনের ভিড় থেকে নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে পরিবারের লোকজনের অজানা স্থানে চলে যেতেন। অসংখ্য আউলিয়ারা নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে পাহাড় জঙ্গলে অবস্থান করে যুগের পর যুগ কঠোর রিয়াজত করেছেন। জঙ্গলে অবস্থানকালীন সময় পেটের ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের জন্যে পেটে পাথর বেঁধেছেন। তারপরও বনের বৃক্ষ তরুলতার পাতা ছিড়ে খাননি। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে হিজরত করেছেন। প্রিয় নবীর কলেমা পৌঁছাতে গিয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। তারপরও উহ আহ শব্দ উচ্চারণ করেননি। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পাগল পাগল বলে গায়ে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেছে। দেখা যেতো বাচ্চাদের ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। সূরা আল ইমরানের ১৭০-১৭১ নং আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে আল্লাহ পাক নিজ অনুগ্রহ দিয়ে তাদের যা কিছু দান করেছেন তাতেই তারা পরিতৃপ্ত এবং যারা এখনো তাদের পেছনে রয়ে গেছে, যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হতে পারেনি, তাদের ব্যাপারেও এরা খুশী, কারণ এমন ধরনের লোকদের জন্য কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তাও করবে না। এ (ভাগ্যবান) মানুষেরা আল্লাহর পক্ষ থেকে অফুরন্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহে উৎফুল্ল ও আনন্দিত হয়। হযরত শাহজালাল (রহ.), হযরত শাহ আমানত (রহ.), হযরত জানশরীফ সুরেশ্বরী (রহ.), হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী (রহ.), হযরত শাহাজী বারি (রহ.), হযরত শাহ আলী বোগদাদী (রহ.) হযরত শরফুদ্দীন চিশতি (রহ.) সহ আরো অনেক জগত বিখ্যাত গাউস, কতুব অলি, আউলিয়ার চরিত্রের সাথে এসব নামধারী পীর, গুরু, সাঁইজিদের চরিত্রের কোন মিল নেই। হযরত শাহাজী বারি (রহ.) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে পীর নিজে বিভ্রান্ত নামাজ পড়ে না শরীয়তের হুকুম আহাকাম মেনে চলে না সে পীর কিভাবে হতে পারে। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বলেছেন, মাটির মানুষ আকাশে উড়াতে পারলে তাকে পীর বলা যায় না। কারণ অনেকে যাদু কিম্বা জ্বীনের মাধ্যমে নানা ধরনের অলৌকিক ঘটনা দেখিয়ে মানুষের মনে চমক লাগানোর চেষ্টা করেন। সুতরাং পীর, গুরু, সাঁইজিদের সহব্বত নেয়ার সময় যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে হযরত মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.) বলেন, সৎ কাজের চেয়ে সৎ লোকের সঙ্গ অনেক উত্তম।
আউলিয়াদের জীবন পুরোপুরি ত্যাগের জীবন। আউলিয়ারা জীবতবস্থায় মৃত ব্যক্তির মতো জীবন-যাপন করেছেন। এখনো মাঝে মধ্যে তাদের কাউকে দেখা যায়। তাদের চিনতে হলে বিশেষ ধরনের চোখ থাকতে হবে। তারা নোংরা জীবনের ভিড় এড়িয়ে চলেন। আমরা পীর, মাজার, আউলিয়া, গাউস, কুতুব ও গাউসূল আজম শব্দগুলোকে বুঝার চেষ্টা করি না। অনেকে মনে করেন পীর মানে আউলিয়া। পীর হলেই আউলিয়া হওয়া যায় না। পীরের কর্ম সাধনা আর আউলিয়ার কর্ম সাধনা ত্যাগের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান রয়েছে। কবরের উপর স্থাপনা নির্মাণ হলেই মাজার হয় না। বহু আউলিয়া আছেন যাদের কবরের চিহ্নও নেই। হযরত শাহাজী বারী (রহ.) বলেছেন ধানের মধ্যে চিটা থাকে। সূফীগণ প্রায়ই বলে থাকেন সাধু হও সাধু সাজিও না। আমাদের নিজেদের অনুশোচনা হওয়া প্রয়োজন। আউলিয়াকে ভালবাসার নাম করে তার মাজারের পাশে বসে নিষিদ্ধ কর্ম করা অত্যন্ত ঘৃণাযোগ্য কাজ। মাজার প্রাঙ্গণের পবিত্রতা বজায় না রাখার ফলে আউলিয়ার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে। তাদের সুন্দর কর্মময় জীবনকে কটাক্ষ করে যে কেউ সমালোচনা করার সুযোগ পায়। মাওলানা রুমীর মতে এক মিনিট আউলিয়ার নিকট বসা হাজার বছরের নফল ইবাদত করার চেয়ে উত্তম। সুতরাং নামধারী কপট সাধু ব্যক্তিকে দেখে প্রকৃত আউলিয়াদের অহেতুক সমালোচনা করা আদবের খেলাপ। আসুন আমরা সবাই মিলে পরম শ্রদ্ধেয় আউলিয়াদের মাজারের পরিবেশ সুন্দর রাখার চেষ্টা করি। মানুষকে পবিত্রতার সাথে মাজার প্রাঙ্গণে চলাফেরার জন্য উদ্ধুদ্ধ করি। আল্লাহ সবাইকে সত্যিকারের আউলিয়া চিনা জানা বুঝার সুযোগ করে দিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন