সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ডিবির হেফাজতে মৃত্যু

| প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে একজন সন্দেহভাজন আসামীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম আসলাম। একটি অপহরণ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রোববার সকালে তাকে গ্রেফতার করে ডিবির পশ্চিমের টিম। তাকে ডিবির মিন্টু রোডের কার্যালয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে তার মৃত্যু হয়। ডিবির ভাষ্য মতে, আসলাম আগে থেকে অসুস্থ ছিলেন এবং সেটাই তার মৃত্যুর কারণ। পক্ষান্তরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকের মতে, তার হাতে ও পায়ে আঘাত এবং রক্ত জমাট বাঁধার চিহ্ন রয়েছে। পত্রিকান্তারে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত খবরে জানানো হয়েছে, ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন ডিবির কয়েকজন সদস্য। তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে ‘সাধারণ মৃত্যু’ বলে চালানোর চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত চিকিৎসক তার আগের মন্তব্য পরিবর্তন করে লেখেন, ‘আসলাম পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। এটি একটি পুলিশ কেস।’ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার ওপর কোনোরূপ নির্যাতন করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। অর্থাৎ আগের অসুস্থতাই তার মৃত্যুর কারণ। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তার হাতে ও পায়ে নির্যাতনের যে চিহ্ন পাওয়া গেছে সেটা তাহলে কী। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে? অন্যদিকে অসুস্থাতই যদি তার মৃত্যুর কারণ হয়, তবে ডিবির কথিত সদস্যরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে সাধারণ মৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন কেন? উল্লেখ করা যেতে পারে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিরপুর থানার একজন এসআই বলেছেন, আসলামের নামে মিরপুর থানায় কোনো মামলা নেই।
কথিত অপহরণের মামলার সঙ্গে আসলামের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা, তিনি দোষী বা নির্দোষ কিনা সেটা তদন্তের বিষয়, আইন ও আদালতের বিষয়। এ নিয়ে কারো কিছু বলার নেই। যে কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ সন্দেহভাজন বা অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পারে, জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারে। আইন পুলিশকে সে এখতিয়ার ও ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশ কাউকে নির্যাতন করতে পারে না। এ ব্যাপারে আইন ও উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। দুঃখের বিষয়, অনেক ক্ষেত্রেই এই নির্দেশনা মানা হয় না। সন্দেহভাজন আসামী কিংবা অপরাধীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই নির্যাতনে তার মৃত্যু পর্যন্ত হয়। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা এদেশে মোটেই বিরল কোনো ঘটনা নয়। মাঝে-মধ্যেই পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। অকথ্য নির্যাতনই যে এর কারণ, সেটা আলামতাদি থেকে প্রতীয়মান হলেও পুলিশের তরফে গতবাধাভাবে বলা হয়, ‘কোনো নির্যাতন চালানো হয়নি’, ‘পূর্বের কোনো রোগ বা তাৎক্ষণিক অসুস্থতায় মৃত্যু হয়েছে।’ এনিয়ে পরবর্তীতে তেমন কোনো তদন্ত হয় না। হলেও তা পুলিশের পক্ষে চলে যায়। কারণ, তদন্ত পুলিশই করে। নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তদন্ত না হওয়া এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা কমছে না, বরং দিনকে দিন বাড়ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘দায়মুক্তি’র এই সংস্কৃতি যদি চলতেই থাকে, তবে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু কখনোই বন্ধ হবে না। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করে আসছি, পুলিশ হেফাজতেই শুধু নয়, বিচারবহির্ভূতভাবে এবং তথাকথিত ‘বন্দুক যুদ্ধে’র নামে প্রায়ই মানুষ নিহত হচ্ছে। এসব ব্যাপারে পুলিশের বক্তব্য এক ও অভিন্ন। দেশের মানুষ এই বক্তব্য সমর্থন ও বিশ্বাস করে না। বিস্ময়কর বাস্তবতা হলো, মানুষ কী ভাবলো, না ভাবলো সেটি কোনো বিবেচনাতেই আনা হয় না।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত চার মাসে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছে ৭৩ জন এবং গুম হয়েছে ১৪ জন। অন্য এক খবরে জানা গেছে, প্রতি বছর অন্ত ১২শ’ মানুষের পরিচয়বিহীন লাশ পাওয়া যায় শুধুমাত্র ঢাকার আশেপাশে। দেশের অন্যত্রও এরকম পরিচয়বিহীন লাশ পাওয়া যায়। এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাÐ, গুম, পরিচয়বিহীন লাশ উদ্ধার, কিংবা পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাকে শুধুমাত্র আইনশৃংখলা সম্পর্কিত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। এসব মানবাধিকারের সরাসরি লংঘন হিসেবে বিবেচ্য। মানবাধিকার বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বহির্বিশ্বের কাছে অত্যন্ত নাজুক। বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন নিয়ে বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে এবং তারা সব সময়ই সোচ্চার ও সমালোচনামুখর। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও অনুরূপ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য কোনো আত্মশ্লাঘার বিষয় নয়। দেশের ও সরকারের সুনাম এর ফলে ক্ষুণœ ও অবনমিত হচ্ছে। সর্ব পর্যায়ের মানবাধিকার লংঘন বিশেষত পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাÐ, গুম, মানুষের পরিচয়বিহীন লাশে পরিণত হওয়া যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। সুশাসন ও ন্যায় বিচারের কাক্সিক্ষত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হলে এটা সম্ভব হতে পারে। র‌্যাব, ডিবি বা পুলিশÑ যাই বলি না কেন, তারা সব শ্রেণীর মানুষের আশ্রয়স্থল। যে কোনো ব্যাপারে সাহায্যের জন্য মানুষ তাদের কাছেই ছুটে যায়। সঙ্গত কারণেই তাদের কাছে মানুষ সদয় আচরণ প্রত্যাশা করে। কিছু সদস্যের অশালীন, অসভ্য ও ভয়ংকর আচরণের কারণে এসব সংস্থার দুর্নাম হোক, মানবাধিকার লংঘনের অপবাদ তাদের ওপর আরোপিত হোক, তা কারো কাম্য হতে পারে না। আমরা আশা করতে চাই, অতীতে মানবাধিকার লংঘনের যেসব ঘটনা ও অভিযোগ উঠেছে তার প্রতিটির উপযুক্ত তদন্ত করা হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন