জুয়েল মাহমুদ : শীতকালীন ছুটির পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসাতে না আসতেই শুরু হয় অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড বহাল ও বেতন কাঠামো নিয়ে সমস্যা নিরসনের দাবিতে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি। তাই শীতকালীন ছুটির পর ক্লাস কার্যক্রম থেকে বিরত ছিল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। অবশেষে টানা নয় দিন পর গত ২০ জানুয়ারি শিক্ষকরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফিরে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাই ক্যাম্পাসে বিরাজ করছে প্রাণোচ্ছল পরিবেশ। অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও বেজায় খুশি। ক্যাম্পাসে কিছুদিন আগেও নীরবতা কিংবা কোলাহলশূন্য পরিবেশ খাকলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীদের পদভারে মুখরিত ক্যাম্পাসের সর্বত্র। চারদিকে বিরাজ করছে আনন্দ-উচ্ছ্বাসময় এক কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ।
পুরোনো দৃশ্যে ফিরে গেছে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। ঢাবি’র ক্যাম্পাস শ্যাডো, মল চত্বর, লাইব্রেরি চত্বর, হাকিম চত্বর, কলা অনুষদ, বটতলা, লাইব্রেরির সামনের আমতলা, অপরাজেয় বাংলা, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, কলা অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ, ব্যবসায় অনুষদসহ প্রতিটি অনুষদের সম্মুখভাবে রয়েছে শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি। জমে উঠেছে চিরচেনা সেই আড্ডা। একই সঙ্গে ক্লাস-পরীক্ষা ও অফিশিয়াল কার্যক্রম তো চলছেই। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যায়েও একই চিত্র চোখে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে। সব চাইতে উচ্ছ্বসিত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। কেননা তাদের ক্লাস শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসের শীতকালীন অবকাসের ছুটি হয়ে যায়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল অনুষদে নিয়মিতভাবে ক্লাস শুরু হয়েছে এবং ক্যাম্পাসের সর্বত্র শিক্ষার্থীদের আনাগোনা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের লেভেল-১, সেমিস্টার-১-এর শিক্ষার্থী মাহাদী হাসান, তাপস কুমার, শারমিন ও শান্তা জানায়, অনেকদিন পর ক্লাসে এসে খুবই ভালো লাগছে। ক্যাম্পাস হলো মুক্তভাবে ঘোরাঘুরি করার উপযুক্ত স্থান। ক্লাস কিংবা হলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেই যেন সময় পার হয়ে যায়। অনেকদিন ক্লাস বন্ধ থাকায় পড়ালেখার কিছুটা বিঘœ হয়েছে। এজন্য ক্যাম্পাস সব সময় খোলা থাকা উচিত। এর ফলে পড়ালেখার পাশাপাশি মুক্ত চর্চারও সুযোগ পাওয়া যায়। তাই ক্লাস শুরুর পর পড়ালেখার চাপ বেড়ে গেছে। ক্লাস শুরুর বিষয়ে অনুভূতির কথা জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ, সোমা, রিতা, মুক্তা বলেন, ‘ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে ডিসেম্বরে। শীতকালীন ছুটিরপর ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ভয় হয়েছিল সেশনজটে ভুগতে হবে। সেটি হলো না, তাই ভালো লাগছে। এছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ক্লাসের আগে-পরে যে জম্পেশ আড্ডা জমে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। আজ থেকে সেটি শুরু হলো।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিকা, হাবিবা, জামান, রেজা বলেন, ‘পরীক্ষা শেষে ক্লাস শুরু হবে এমন মুহূর্তে আন্দোলন। ভেবেছিলাম, এভাবে চলতে থাকলে সেশনজটে পড়তে হয় কি না। ভাগ্য ভালো, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে শিক্ষকরা আন্দোলন স্থগিত করেছেন। আশা করি বিগত ৪-৫ বছরের মতো টানা সেশনজটমুক্ত থাকবে ক্যাম্পাস।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের মাস্টার্স শিক্ষার্থী সৈকত ও তন্ময় বলেন, অনেকদিন ক্লাস বন্ধ থাকায় নানাদিক থেকেই সমস্যার মধ্যে ছিলাম। ক্যাম্পাসে না থাকলেই ক্যাম্পাসকে বেশি মিসতো করিই। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার কথা কি ভুলে থাকা যায়!
আবার বিশ্ববিদ্যালয় হল জীবনের আনন্দময় আর মজার অভিজ্ঞতাও কখনো ভোলার নয়। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলে বাসায় যেন সময় আর কাটে না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাফেটেরিয়া চত্বরে গ্রুপ স্ট্যাডি করছিলেন অর্থনীতি বিভাগের জাকারিয়া, ইতি নাসিতা। ক্লাসে ফেরা সম্পর্কে তারা বলেন, আমাদের আর একমাস পরই মাস্টার্স পরীক্ষা তাই খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরেছেন আমাদের আর সেশনজটে পড়তে হবে না।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজীমা তানি, শামীমা আক্তার ও শিহাব জানায়, আমাদের ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের পদচারণায় আবার মুখরিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরাই ক্যাম্পাসের প্রাণ। শিক্ষার্থী ছাড়া ক্যাম্পাস শূন্য শূন্য মনে হয়। এবারের শীতে আমাদের ক্যাম্পাস অনাকাক্সিক্ষতভাবে বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা শীতের আমেজ অনেকটাই মিস করেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বকুল তলায় আড্ডা দিচ্ছিলেন চার বন্ধু রাজন, সায়মা, তমা ও দীপক। কথা হয় তাদের সঙ্গে। সায়মা বলেন, ‘আমরা অনাবাসিক। ক্যাম্পাসের গাড়িতে আসি। এত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ছেড়ে না যাওয়ায় আসতে পারিনি। আজকে আসতে পারলাম। ক্লাস শুরু হলো। গ্রুপ স্টাডিটা চালিয়ে নেয়া যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে বৃত্তের আকৃতিতে বসে ঘনিষ্ঠ সব বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা দিতে দেখা গেল ফাহিম অনিন্দ, ইংরেজির মেহেদী হাসান, ফুয়াদ ও ফিন্যান্সের সুমাইয়া হাফসাকে। তারা বলেন দীর্ঘ ৯ দিন পর আবার শুরু ছকবাধা ব্যস্ত জীবন। ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাব চালু হওয়াই তারা সবাই উচ্ছ্বসিত। তারা আরও বলেন, সব সময়ই দেখি শিক্ষকদের সবাই ঠকাতে চায় কিন্তু এটা ঠিক নয়। তারা এর সমাধান চান যাতে করে আর ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ না থাকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আসমা মমতাজ, নয়ন, সুমন বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আড্ডার জায়গা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বর। দুদিন আগেও যা ছিল একেবারে ফাঁকা। এছাড়াও ক্যাম্পাসে জমে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেট, আমতলা, সিনেট ভবনের পাশ, ইবলিশ চত্বর, পশ্চিম পাড়া এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ।
ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের সংকট নিরসনের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সপ্তম জাতীয় বেতনকাঠামোর অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা বহাল রেখে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে অধ্যাপকগণকে গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-১-এ উন্নীত করার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছি এবং প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ভিত্তিতে চলমান কর্মবিরতি স্থগিত রেখে গত বুধবার থেকে আমরা ক্লাসে ফিরে আসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন