শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নারীর ক্ষমতায়নে অনুকূল পরিবেশ দরকার

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

করুণাময় নর ও নারীকে সমমর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। নতুবা সৃষ্টির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেত। নারী পুরুষের আনুপাতিক হারও প্রায় সমানÑ কোথাও কিছু বেশি, কোথাও কিছু কম এই যা। নারীকে ঘরে-বাইরে অবহেলা করে, গুরুত্বহীন করে, সঠিক মর্যাদা না দিয়ে, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, দায়িত্ব না দিয়ে, অশিক্ষিত রেখে কোন দেশের কাক্সিক্ষত উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা দূরূহ। যে দেশ ও জাতি নারীকে যত বেশি শিক্ষিত ও ক্ষমতায়ন করতে পেরেছে, তারা তত বেশি উন্নতি করেছে। বাংলাদেশেও নারী ও পুরষের সংখ্যা প্রায় সমান। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং কর্মের ক্ষেত্রে, মর্যাদার ক্ষেত্রে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নারীরা কি পুরুষের সমান হতে পেরেছে? পারেনি। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা সা¤প্রতিক সময়ে বেশ অগ্রগামি হয়েছে নানা ইনসেনটিভ দেয়ার কারণে। কিন্তু নারীর কর্মসংস্থান, মর্যাদা, নিরাপত্তা পুরুষের চেয়ে অনেক কম। প্রায় অর্ধেক। যেমন: বিবিএসের জরিপের তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর্মক্ষম শ্রমশক্তির মধ্যে ৪.৫৫ কোটি মানুষ শ্রমশক্তির মধ্যে নেই। তন্মধ্যে ৮৭% নারী ও ১৩% পুরুষ। অপরদিকে, বর্তমানে দেশে মোট কর্মসংস্থানে নারীর উপস্থিতি ৩১ শতাংশের বেশি। কিন্তু দেশের ব্যাংকিং খাতে চাকরির ক্ষেত্রে নারীরা এখনো বেশ পিছিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের ৫৭টি তফসিলি ব্যাংকে কর্মরত মোট জনবলের মাত্র ১২.৫৬% নারী। তদ্রæপ দেশের উঠতি খাত হচ্ছে তথ্য ও প্রযুক্তি। সেখানে নারীর অংশগ্রহণ অতি নগন্য। তেমনি উদ্যোক্তা হিসেবিও। দেশের কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। যেসব নারীরা কর্মক্ষেত্রে আছে, তারাও নানাভাবে বঞ্চিত। বিবিএসের তথ্যে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তিতে যারা নিয়োজিত আছে, তাদের ৮৫% অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। তাদের মধ্যে গৃহ কর্মেই বেশি। আর এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগই নারী। এছাড়া, সা¤প্রতিক সময়ে নারীরা কৃষি, চা বাগান, নির্মাণ কাজ, নানা ব্যবসা, টেইলারিং, বিউটি পার্লার ইত্যাদিতেও এগিয়ে এসেছে। এসবও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। কিন্তু দেশের অপ্রাতিষ্ঠানকি খাতের শ্রমিকের জন্য কোন বিধান নেই। ফলে তারা খুব স্বল্প মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। এছাড়া, নানা নির্যাতনেরও শিকার হয়। সর্বপরি যারা প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে, তাদের মধ্যেও পুরুষের তুলনার নারীর হার কম। যেটুকু নারী কর্মরত আছে, তারাও নিয়ম-কানুনের আওতার বাইরে রয়েছে। দেশের গার্মেন্ট খাতে প্রায় ৩০-৩৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে। যার ৯০% নারী। কিন্তু গার্মেন্টের ৭০% শ্রমিকের চাকরির কোন নিয়োগ পত্র নেই। গার্মেন্টস শিল্প অধ্যুষিত চারটি এলাকায় শ্রমিকদের উপর সমীক্ষা চালিয়ে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ জানিয়েছে, ঢাকা ও গাজীপুরে প্রায় ৭২% শ্রমিক আনুষ্ঠানিক নিয়োগপত্র পান না। আর চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে এই হার ৫৯ শতাংশের বেশি। অপরদিকে, একই সমান কাজ করেও নারী শ্রমিকের মজুরি কম পুরুষের তুলনায়। সিপিডি’র গবেষণা মতে, গত চার বছরে কর্মজীবী পুরুষের চেয়ে কর্মজীবী নারীর আয় কমেছে ১.৯%। অন্যদিকে, জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০১৩ অনুযায়ী, ৩৪.৫০ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমের সাথে যুক্ত আছে। এর মধ্যে ১২.৮০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুর কাজ সব দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সরকার এখনও গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুশ্রম ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। এই শিশু শ্রমিকদের মধ্যেও নারী শিশুর হার সর্বাধিক।
বিবিএস’র জরিপ মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে ২৬.৮০ লাখ দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে নারী-৬.৭% ও পুরুষ-৩.১%। জরিপে আরো বলা হয়েছে, দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মাঝে ১২.১% বেকার। তার মধ্যে নারী-১৫%। আর এক তথ্য মতে, দেশে কর্মক্ষম মানুষের বেকারের হার নারী-৬.৮% ও পুরুষ-৩%। স্মরণীয় যে, দেশে দিনদিন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে হ্রাস পাচ্ছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণা মতে, কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশের অভাব, বৈষম্য ও প্রকৃত আয় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় দেশের শিল্পখাতে নারী কর্মজীবীদের অংশগ্রহণ হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে ৮.৫০ লাখ। সব প্রতিষ্ঠানে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করা হযেছে। এটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে পালন করা হয়। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তেমন পালন করা হয় না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ডে কেয়ার সেন্টার চালু করার বিধান আছে। এটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দূরে থাক, সব সরকারি প্রতিষ্ঠানেও নেই। ফলে কর্মজীবী মায়ের সন্তান মাতৃদুগ্ধ হতে বঞ্চিত হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে নবজাতকদের ৫১% জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে এবং ছয় মাসের কম বয়সী ৫৫% শিশুকে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো হয়। অথচ এই হার আফগানিস্তানে-৯৮%, ভুটানে-৯৯%, নেপালে-৯৯% ও শ্রীলঙ্কায়-৯৯%। বাংলাদেশে শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার কম হওয়ার প্রধান কারণ নারীদের কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার না থাকা। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ের বুকের দুধ শিশুদের জীবন বাঁচায়, প্রাণঘাতী ব্যাধি থেকে রক্ষা করে, সুস্থ বৃদ্ধির জন্য পুষ্টি প্রদান করে ও বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি করে এবং মায়ের ক্যান্সার হওয়া হ্রাস পায়। নারীদের জন্য পৃথক টয়লেট থাকা আবশ্যক। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই তা নেই। এসব কারণে কর্মজীবী নারীরা কর্মক্ষেত্রে চরম অসুবিধার সন্মুথীন হয়। সর্বপরি নারীদের কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সনস্যা হচ্ছে যৌন হয়রানি। ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতে ৯৪% নারী কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর ৬৬% নারী ৪১-৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, পরিবহনে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎবাতি না থাকা এবং তদারকির অভাবে নারীদের প্রতি এই হয়রানি হচ্ছে। প্রায় একই অবস্থা কর্মক্ষেত্রেও। যার খবর প্রায় প্রতিদিনিই মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এসব নানা প্রতিকূলতার কারণে বাধ্য হয়ে অনেক নারীই কর্ম থেকে ঝরে পড়ছে। বাল্যবিবাহ নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান বাধা। তাই এটা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও দেশে বাল্যবিবাহের হার ব্যাপক। ইউনিসেফ প্রতিবেদন-২০১৮ মতে, বিশ্বে এক দশকে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের হার ১৫% কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বেড়েছে। বাংলাদেশে ২০১১ সালে এর হার ছিল ৫২%, এখন ৫৯%। বাংলাদেশে বছরে বাল্যবিবাহ হচ্ছে ৩৯.৩০ লাখ। এ দেশে বিবাহের পর সাধারণত নারীরা লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। এমনকি অনেকেই চাকরিও ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে, দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলে ৩০% নারীর পদ পূরণ করার জন্য ইসি বিধান করেছে। কিন্তু তা পালিত হয়নি। বড় ২/৩ দলে কিছু পদে নারী থাকলেও বেশিরভাগ দলে তা নেই। সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন আছে। তা পালিত হয়। স্থানীয় সরকারের ইউপি ও উপজেলায় নারীর জন্য নির্ধারিত আসন আছে, যা পালিত হয়। তবে এসব নারী প্রতিনিধির হাতে প্রকৃত কোন ক্ষমতা নেই। ফলে রাজনীতিতে নারীদের উৎসাহীভাব কম। এই হচ্ছে দেশের নারীর ক্ষমতায়নের খÐিত চিত্র। বিভিন্ন দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপাক বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে গেøাবাল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, জিডিপিতে নারীর অবদান থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়ায় ৩৫-৪০%। দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, ইন্দোনেশিয়ায় ৩০-৩৫%। বাংলাদেশে ১৯%, ভারতে ১৮% ও পাকিস্তানে ১০%।
সব তথ্য মতেই দেশের কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব কম। এই অবস্থায় সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করা হলে নারীর চাকরিপ্রাপ্তি আরও হ্রাস পেতে পারে। অথচ জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক হওয়ায় শুধুমাত্র পুরুষের উপার্জন দিয়ে সৎ পথে থেকে সুন্দরভাবে জীবন নির্বাহ করা এবং সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষাদান দূরূহ ব্যাপার। দেশের অর্ধেক মানুষ নারী, তাদেরকে উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। এমনকি এসডিজিও পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই নারীর ক্ষমতায়ন তথা সব নারীকে শিক্ষিত ও উৎপাদনশীল কর্মে নিয়োজিত করা জরুরি। এটা যত তাড়াতাড়ি হবে, দেশের উন্নতি তত তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাবে। এ লক্ষ্যে সব শিক্ষাঙ্গন ও কর্মক্ষেত্রেই নারীর সকল প্রতিকূলতা দূর করা আবশ্যক। প্রচলিত আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে নারীর সব বাধা অনেকাংশে দূর হয়ে যাবে। এ দেশের নারীরা খুব কর্মঠ, মেধাবী ও সাহসী। এর প্রমাণ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। সেখানে বাংলাদেশি অনেক নারী অংশগ্রহণ করেছে। তারা তাদের কর্মগুণে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। এছাড়া এ দেশের নারীরা বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত জয় করেছে, খেলাধূলা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় প্রশংসনীয়তার সাথে কাজ করছে। এমনকি বিদেশেও। এরূপ ক্ষমতা এ দেশের সব নারীরই আছে। তাই নারীদের যত বেশি কর্মে নিয়োজিত করা হবে, ততই দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন