ভারত থেকে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সঞ্চালন লাইনের জন্য ‘এইচভিডিসি ব্যাক টু ব্যাক স্টেশন নির্মান’ প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন এবং ঘাটতি মোকাবেলা সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলোর অন্যতম। গত ১০ বছর ধরে বিদ্যুত খাত নিয়ে নানাবিধ এক্সপেরিমেন্ট চলছে। এ সময়ে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগে বিদ্যুৎ খাতের যথেষ্ট উন্নতিও হয়েছে। উৎপাদন যেমন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশী সেই সাথে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বেড়েছে বিদ্যুত খাতের সরকারি ভর্তুকিও। বিদ্যুতের ঘাটতি পুরণে তাৎক্ষনিক উদ্যোগ হিসেবে বেসরকারী উদ্যোগে নির্মিত রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও বার্জমাউন্টেড বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে অনেক বেশী দামে বিদ্যুত কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। অনেক বেশী দাম ও বেশী ভর্তুকির বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হলেও জরুরী প্রয়োজনে এ ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। বিদ্যুত খাতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৫ বছরের মধ্যেই বড় বড় বিদ্যুত প্রকল্পে উৎপাদন শুরু হবে এমনটিই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরেও সরকার বিদ্যুত খাতের সেই কাঙ্খিত উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। এখন আমাদের রেন্টাল, কুইক রেন্টালের পাশাপাশি ভারত থেকে বেশী দামে বিদ্যুত আমদানী করে চাহিদা মিটাতে হচ্ছে।
ভারত থেকে এর আগে দুই দফায় আরো ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির চুক্তি হয়েছিল। ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের মূল্য দেশে সরকারী ও বেসরকারীভাবে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্যের বেশী বলে জানা যায়। বিনাশুল্কের ট্রানজিট সুবিধায় বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে ভারতের উত্তরাঞ্চলে পালটানা বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। সৌজন্য হিসেবে সেই বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেনার চুক্তিতে উপনীত হতে দরকষাকষিতে ভারতের অনড় অবস্থানের কারণে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরী হয়েছিল। অবশেষে সাড়ে ছয় টাকা ইউনিট দরে বিদ্যুত বিক্রি করতে রাজি হয় ভারত। তবে এর আগে সম্পাদিত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির চুক্তিতে ইউনিটমূল্য এর চেয়ে কিছুটা কম। উল্লেখ্য, দেশীয় বড় বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো ২ টাকা ২০ পয়সা ইউনিট মূল্যে বিদ্যুত উৎপাদন করছে। আর বেসরকারী বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচও ভারত থেকে আমদানি করা মূল্যের চেয়ে কম। বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে সরকার প্রায় ১০ বছর ধরে অবিরাম চেষ্টা চালিয়েও ভর্তুকিনির্ভর কুইকরেন্টালের নাগপাশ মুক্ত হতে পারছেনা। উপরন্তু বিদ্যুতের মত স্পর্শকাতর খাতে নতুন করে ভারতনির্ভরতা শুরু হয়েছে। দেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতার লক্ষ্য অর্জনে এটি কোন শুভ লক্ষণ নয়। এমনিতেই ভারতের সাথে বাণিজ্য বৈষম্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়েই চলেছে। বিদ্যুত খাতে নিজস্ব পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বদলে ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানির নীতি অনাকাঙ্খিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। উৎপাদন মূল্যের সাথে সামঞ্জস্যহীন বেশী মূল্যে বিদ্যুত বিক্রি কিনে ভারতকে বাণিজ্যিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানির পর থেকে গত ৫ বছরে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রীডে অন্তত দুইটি বড় ধরনের বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছে। প্রথমে ২০১৪ সালের নভেম্বরে জাতীয় গ্রীডে বিপর্যয়ের জন্য সারাদেশে নজিরবিহিন অন্ধকার নেমে আসে। গত বছরের মাঝামাঝিতে ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দেয়ার পর খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশাল জোনসহ দেশের ৩২টি জেলায় বিদ্যুত বিপর্যয় ঘটে। এই দু’টি বিদ্যুত বিপর্যয়ের ঘটনার সাথেই আন্ত:দেশীয় গ্রীডের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আমাদের বিদ্যুত সঞ্চালন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো আন্তদেশীয় গ্রীডের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষার উপযোগী নয়। জাতীয় বাজেটে বিদ্যুত ও জ্বালানিখাতের অগ্রাধিকার এবং ক্রমবৃদ্ধি ঘটলেও জাতীয় ও ভোক্তা পর্যায়ে এর কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদ্যুত ও জ্বালানী খাতে ২১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় যা আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৬ হাজার ৮২ কোটি টাকা বেশী। সরকারের বড় বিনিয়োগ ও বরাদ্দের মধ্য দিয়ে বিদ্যুত ও জ্বালানী খাতের প্রকৃত উন্নয়নের পাশাপাশি ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য সাশ্রয় হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছেনা। আরো ৭ বছর বিদ্যুত খাতে ভর্তুকি দিতে হবে বলে সম্প্রতি বিদ্যুত ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন। তবে গত ১০ বছরে বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে শুধুমাত্র এডহক ভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও আগামী দু’চার বছরের মধ্যে নতুন বড় বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। রেন্টাল, কুইক রেন্টালের পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি পুরণে টেকসই সমাধানের ক্ষেত্রকে আরো সঙ্কুচিত করে ফেলা হচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মান, পুরনো বড় বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর ওভারহোলিং ও সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবস্থার উন্নয়নে নজর দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন