বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা দয়া ও করুণার আধার। তিনি কখনই চান না তার কোনো বান্দাকে শাস্তি দিতে। বরং তিনি সবসময় চান তার বান্দাদেরকে পাপমুক্ত করে জান্নাতলাভের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে। সেজন্য তিনি ক্ষমালাভের অবাধ সুযোগ দিয়েছেন প্রতি বছর রমজানুল মোবারকের মাধ্যমে। এর মধ্যে ইফতার অন্যতম অবদান। নিচে হাদিসের আলোকে ইফতারের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো।
নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, কেউ যদি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় তাহলে ঐ ইফতার করানোটা তার গুনাহ মাফের ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং সে একটি রোজার সাওয়াব পাবে। অথচ রোজা পালনকারীর নেকি মোটেই কমানো হবে না। সাহাবীরা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের তো এমন সংস্থান নেই, যা দিয়ে আমরা কাউকে ইফতার করাতে পারি? জবাবে তিনি সা. বললেন, আল্লাহ তায়ালা তাকেও এই সাওয়াব দেবেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজা পালনকারীকে এক ঢোক দুধ অথবা একটি শুকনো খেজুর কিংবা এক চুমুক পানি দিয়েও ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে আল্লাহ তায়ালা তাকে আমার হাউজে কাওসার থেকে এমনভাবে নির্মল সুপেয় পানি পান করাবেন যার ফলে সে জান্নাতে পৌঁছা পর্যন্ত আর তৃষ্ণার্ত হবে না। (বায়হাকী শোয়াবুল ঈমান, মেশকাত ১৭৪ পৃ.)
নবী করীম সা. আরো ঘোষণা করেন, লোকেরা ততক্ষণ কল্যাণে থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার জলদি করবে। (বুখারী, মুসলিম ১ খন্ড ৩২১ পৃ; মিশকাত ১৭৫ পৃ)
হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় সেই বান্দা, যে ইফতার সঠিক সময়ে করে। (তিরমিযী ১ম খন্ড, ৮৮ পৃ; মেশকাত ১৭৫ পৃ)
সমস্ত নবীর স্বভাব ছিল ইফতারে দেরি না করা। (তাবারানী কাবীর, মাজমাউজ যাওয়ায়িদ ২য় খন্ড ১০৫ পৃ)
এ হাদীসগুলো প্রমাণ করে যে, ইফতারের নির্দিষ্ট সময় থেকে দেরি করা মোটেই উচিত নয়। যদি কেউ ইচ্ছা করে ইফতারে দেরি করে তাহলে সে রসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশ অনুযায়ী কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে এবং আল্লাহর নিকট অপ্রিয় হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফ রা. বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা রমজানে আল্লাহর রাসূল সা.-এর সাথে সফরে ছিলাম (তখন তিনি রোজা অবস্থায় ছিলেন)। অতঃপর (সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর) তিনি একজন সাহাবীকে (হযরত বেলাল রা.) বললেন, নামো এবং আমার জন্য ছাতু গুলে দাও। সাহাবী সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর) লালিমা দেখে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ যে সূর্য দেখা যাচ্ছে! তিনি আবার বললেন, তুমি নামো এবং আমার জন্য ছাতু গুলে দাও। এভাবে তিনবার বললেন। অতঃপর তিনি (বেলাল রা.) নামলেন এবং রাসূলুল্লাহ সা.-এর জন্য ছাতু গুললেন। তিনি তা পান করলেন। তারপর তিনি পূর্বদিকে ইশারা করে বললেন, যখন তোমরা দেখবে যে, রাত ঐ দিক থেকে আসছে তখন বুঝবে সিয়াম পালনকরীর ইফতারের সময় হয়ে গেছে। (বুখারী ২৬০ পৃ. মুসলিম ১ম খন্ড ৩৫১ পৃ.)
নবী করীম সা. রমজান মাসে মাগরিবের সালাত কখন পড়তেন সে সম্পর্কে রাফে ইবনে খাদীজ (রা.) বলেন, আমরা রসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে মাগরিবের সালাত আদায় করতাম। তারপর আমরা কেউ তীর ছুঁড়লে সেই তীর পড়ার জায়গাটা দেখতে পেতাম। (বুখারী, মুসলিম, মেশকাত ৬০ পৃ)
এ হাদীসটি প্রমাণ করে যে, নবী করীম সা.-এর মাগরিবের সালাত পড়ার পরও আলো থাকতো। একটু অন্ধকার হোক বলে তিনি মোটেই দেরি করতেন না।
হযরত আনাস রা. বলেন, নবী করীম সা. মাগরিবের সালাতের আগেই ইফতার করতেন। (তিরমিযী, আবু দাউদ, মেশকাত ১৭৬ পৃ)
অন্য বর্ণনায় আছে, নবীজী সা. ইফতার না করা পর্যন্ত মাগরিবের সালাত পড়তেন না। যদিও তার ইফতার এক ঢোক পানি দিয়েও হতো। (সহীহ ইবনে খুযায়মা ৩য় খন্ড ২৭৬ পৃ)
এ হাদীস দুটি প্রমাণ করে যে, মাগরিবের সালাত পড়ার আগে ইফতার করতে হবে। রাসূল সা. বলেন, আমার উম্মত ততক্ষণ আমার সুন্নাত ও নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতারের জন্য তারকা উদয়ের অপেক্ষা করবে না। (ইবনে খুযায়মা ৩য় খন্ড ২৭৫ পৃ)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, রমজানের প্রত্যেক রাতে আল্লাহ তায়ালা বহু জাহান্নামীকে মুক্তি দেন (তিরমিযী ১ম খন্ড ৮৬ পৃ, আহমাদ, মেশকাত ১৭৩ পৃ)।
অন্য হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, জাহান্নাম থেকে মুক্তি বিশেষ করে ইফতারের সময় হয়। (ইবনে মাজাহ ১২০ পৃ, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪র্থ খন্ড ১৭৬ পৃ)
রোজাদারের দোয়া সম্পর্কে নবী করীম সা. ইরশাদ করেছেন, সিয়াম পালনকারীর দোয়া ফেরত দেয়া হয় না। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা ৩য় খন্ড, ৭ম পৃ) অন্য হাদীসে বলা হয়েছে যে, বিশেষ করে ইফতারের সময় তা রদ হয় না। যেমন মহানবী সা. বলেন, ইফতারের সময়ে দোয়া খুব তাড়াতাড়ি কবুল হয়। (বায়হাকী)
উল্লেখিত হাদীসগুলো আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ইফতারের সামগ্রী সাজাতে কিংবা মিসওয়াক করতে অথবা আজেবাজে গল্পগুজবে সময় নষ্ট না করে ইফতারের ১০/১৫ মিনিট আগে ইফতারের খাদ্যদ্রব্য নিয়ে বসা এবং দোয়া তাসবীহ পাঠে রত হওয়া দরকার। এ সময় আল্লাহ তায়ালা যেহেতু প্রতিদিন অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেন। সে কারণে প্রার্থনারত রোজাদারগণ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে যেতে পারেন।
হাদীসে খেজুর ও পানি দিয়ে ইফতার শুরু করার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে ইবনে কাইয়েম রহ. চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে বলেন, খালি পেট মিষ্টি জিনিস পছন্দ করে এবং এর দ্বারা তা শক্তি সঞ্চয় করে। বিশেষ করে দৃষ্টিশক্তি এর দ্বারা সবল হয়। তাই খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করতে বলা হয়েছে। পানির ব্যাপার হলো, রোজা রাখার ফলে পেটের মধ্যে শুষ্কতা সৃষ্টি হয়। পানি দ্বারা তা সতেজ হয়। এজন্য একজন ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির উচিত খাওয়া শুরু করার আগে সামান্য পানি পান করা, তারপর খাওয়া শুরু করা। আর তা যদি খেজুর ও পানি দিয়ে হয় তাহলে হৃদয়কে সুস্থ করার ব্যাপারে একটা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। (যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ১৬০ পৃ)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন