অবশেষে বন্যার কবল থেকে মৌলভীবাজার শহর রক্ষা পায়নি। শনিবার দিবাগত রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় শহরের বারইকোণাতে মনু নদীর শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ প্রায় ৩০ ফুট স্থান ভেঙ্গে মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমাঞ্চল প্লাবিত করে। রাতের বেলা আকস্মিক এই ভাঙ্গনের ফলে কয়েকশত ঘর বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে। ঘরের মূল্যবান মালামাল পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে পড়েছে।
কয়েকদিন থেকে রাত জেগে অপেক্ষা আর উৎকন্ঠা কখন বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি প্রবেশ করবে। ঠিক মধ্যরাতে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে মৌলভীবাজার পৌর এলাকার ৬,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের বাসা বাড়ি তলিয়ে গেছে। পাড়া মহল্লার রাস্তাঘাটের উপর দিয়ে বইচে বন্যার পানির স্রোত।
শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ উপচিয়ে পানি আসতে থাকলে ঝুকিপূর্ণ কয়েকটি স্থানে শনিবার থেকে সেনাবাহিনী পানি উন্নয়ন বোর্ড, পৌরসভা, জেলা প্রশাসন সহ স্থানীয় জনসাধারণ বাঁধ রক্ষায় বালি ভর্তি বস্তা ফেলে চেষ্টা করে।
ভাঙ্গা বাঁধ দিয়ে দ্রুত বেগে পানি প্রবেশ করে মৌলভীবাজার পৌরসভার, উপজেলা পরিষদ, বারইকোণা, পূর্ব ও পশ্চিম বড়হাট, বড়কাপন, পশ্চিম ও পূর্ব ধরকাপন, শেখেরগাও, দ্বারক, খিদুর, গোবিন্দশ্রী এলাকার বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে। চলাচলের সকল রাস্তা ৩ থেকে ৪ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে। বন্যা কবলিতরা নিজেদের দোতলায় কিংবা পাশ্ববর্তী আত্মীয় স্বজনের বাসাতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
গভীর রাতে বাঁধ ভাঙ্গায় কোনো দোকানীই মালামাল সরাতে পারেননি। বন্যার পানি পৌরসভার ৩টি ওয়ার্ড প্লাবিত করে নীচের দিকে গড়িয়ে গিয়ে মোস্তফাপুর ইউনিয়ন ও কনকপুর ইউনিয়ন এলাকায় পানি বাড়ছে।
জেলা শহরের চারটি সরকারী খাদ্য গুদামে বন্যার পানি ঢুকায় প্রায় আড়াই কোটি টাকার চাল ও গম ক্ষতিগ্রস্থ হবার আশংকা করছেন জেলা খাদ্য বিভাগ। জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মনোজ কান্তি দাশ চৌধুরী জানান, চারটি গুদামে ১ হাজার ৫শ’ ৬৮ মেট্রিক টন চাল ও ৪২৪ টন গম মজুদ রয়েছে। মজুদকৃত এই চাল ও গমের মূল্য প্রায় ৯ কোটি টাকা। গুদামে যে উচ্চতায় পানি ঢুকেছে তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। প্রায় ৫৫০ মেট্রিক টন ক্ষতিগ্রস্থ হবে, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা হবে।
অপর দিকে কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, রাজনগর ও সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তলিয়ে রয়েছে এ সব বাড়ি ঘর সহ রাস্তাঘাট। পানি বন্দী রয়েছে জেলায় প্রায় ৫ শত গ্রামের ৩ লাখ মানুষ। জেলা সদরের সাথে উপজেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। গত ৪ দিনে জেলার বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে ৫ জন মারা গেছে।
মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মোঃ ফজলুর রহমান জানান, রড়হাট বন্যা কবলিত হওয়ায় তার নিজের বসত ঘরে দেড় ফুট পানি। পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ এখন বন্যা কবলিত। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বন্যা কবলিত মানুষের পাশে এখন প্রশাসন নেই। তিনি বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলও বন্যার্তদের পাশে নেই। শহর রক্ষার জন্য যেখানে বালু ভর্তি বস্তা দিতে হয় সবই পৌরসভার লোকজন এবং পৌরসভার টাকা দিয়ে দৈনিক রোজে মজুর নিয়োগ করে করা হয়েছে। বিভিন্ন বাহিনী ও প্রতিষ্ঠান যে তৎপরতা করেছে সেটা লোক দেখানো ও ফেসবুক পোষ্ট দেয়ার জন্য।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা ছাড়াও, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ ও রাজনগর উপজেলার বন্যার্তদের দুর্ভোগ বেড়েছে। পানিবন্দী মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে আছেন। গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৌলভীবাজার শহরে মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ, মৌলভীবাজার সরকারী মহিলা কলেজ, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ও মৌলভীবাজার টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, মনু নদীর পানি মৌলভীবাজার শহরের কাছে চাঁদনীঘাট পয়েন্টে ১৫৪ সেন্টিমিটার ও মনু রেলওয়ে ব্রীজের কাছে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই নদী বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু কুশিয়ারা নদীতে গত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১ সেন্টিমিটার পানি কমে বর্তমানে তা বিপদসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন