বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। যখন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি মহামান্য হাইকোর্টের একটি আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত হয়ে গিয়েছিল, তখন নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি বিতর্কিত হয়ে উঠেছিল। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতেও পরিহার্য বিলম্ব করেছিল নির্বাচন কমিশন। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচন কমিশন ইনিয়ে-বিনিয়ে ওই নির্বাচন সম্বন্ধে সাফাই গাইলো। দুঃখজনক হলেও এটাই মনে হয় যে, নির্বাচন কমিশন যেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশন খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনটিকে গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানের জন্য কতটুকু পদক্ষেপ নিয়েছিল আর কতটুকু নেয়নি, সেটা খুলনা মহানগরের জনগণ উপলব্ধি করেছেন এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণ পরোক্ষভাবে হলেও উপলব্ধি করেছেন। যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকার বা আওয়ামী লীগ দলীয় পার্লামেন্ট কর্তৃক সংবিধান তাদের সুবিধার কথা খেয়াল রেখেই সংশোধন করা হয়েছে এবং যেহেতু সংবিধান মোতাবেক জাতীয় নির্বাচন বা পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেহেতু নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ভূমিকার গুরুত্ব অতীতের তুলনায় এখন বেশি।
নির্বাচন কমিশন একটি ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা বা সংলাপের আয়োজন করেছিল। একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিও সংলাপে অংশ নিয়েছিল। পার্টির পক্ষ থেকে নাতিদীর্ঘ লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছিল। আমরা যেই বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম তা হলো, নির্বাচন কমিশনের বিদ্যমান ক্ষমতা ও সক্ষমতা কার্যকর করা এবং প্রয়োজনে বৃদ্ধি করার জন্য চেষ্টা করা। এই পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দুইটি রায়ের রেফারেন্স বা সূত্র এখানে উল্লেখ করে রাখছি; কারণ, এই দুইটি রায় থেকে কিছু বাক্য বা অনুচ্ছেদ এই কলামে উদ্ধৃত আছে। প্রথমটি হলো, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী সংক্রান্ত মামলায় আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায়; ইংরেজি পরিভাষায় Constitution of Bangladesh: 13th Amendments Act Case: Appellate Division Full Judgment. এই বিখ্যাত রায়টি আইন-আদালত বিষয়ক গ্রহণযোগ্য রিপোর্টিং জার্নাল বা রেফারেন্স-জার্নালে মুদ্রিত হয়েছে; যেমনটি সচরাচর হয়। এটা হচ্ছে Special Edition. The Lawyers (A Monthly Appellate Division Law Reports). Appellate Division Cases (ADC). Volume IX(A) September 2012. এই রায়টির সঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নাম জড়িত। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত মামলায় আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায়; ইংরেজিতে Judgment on 16th Amendment of Constitution. এই রায়টিও আইন-আদালত বিষয়ক গ্রহণযোগ্য রিপোর্টিং বা রেফারেন্স জার্নাল মুদ্রিত হয়েছে। আমার সামনে এই পূর্ণাঙ্গ রায়টি তা বইয়ের মতো মুদ্রিত বাঁধাই অবস্থায় আছে এবং আমিও তা পড়েছি। এটা হচ্ছে The Apex Law Reports 2017. Volume X 2017(2). উল্লেখ্য, একটি রায় হলো- ২০১১-১২ সালের এবং অপরটি ২০১৭ সালের।
আমরা সাধারণ নাগরিক, সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী। আমাদের কথা মূল্যবান মনে হতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই অসাধারণ ব্যক্তিদের অসাধারণ কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। তাই আমি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের দুইজন প্রধান বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন সেই মন্তব্যগুলো আপনাদের নজরে আনছি। সঙ্গে আমার মন্তব্য উপস্থাপন করছি।
বিচারপতি খায়রুল হকের রায় থেকে
এ বি এম খায়রুল হকের রায়ের অনুচ্ছেদ ১১৭৭-এর সারমর্ম: এক. কারচুপিমুক্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন সত্যকার স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের একান্ত নির্ভেজাল প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমার মন্তব্য: নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আহ্বান করা সংলাপের সময়, জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বাস্তবসম্মত অনেক পরামর্শ উপস্থাপন করা হয়েছিল, ওইগুলোর ভাগ্য সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না।
দুই. এ বি এম খায়রুল হকের রায়ের অনুচ্ছেদ ১১৭৮: নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাধীন করিতে হইবে। ইহাকে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে। লোকবল নিয়োগে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করা যাইবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠান করিতে সর্বপ্রকার প্রয়োজন নিরসনকল্পে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ লইবেন। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সকল প্রকার সহায়তা সরকারের নির্বাহী বিভাগ ত্বরিত প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবেন, অন্যথায় তাহারা সংবিধান ভঙ্গ করিবার দায়ে দায়ী হইবেন। এই ব্যাপারে কোনো তরফে কোনো গাফিলতি দেখা দিলে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করিবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ত্বরিত গ্রহণ করিবেন, অন্যথায় তাহারাও সংবিধান ভঙ্গের দায়ে দায়ী হইবেন। সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ হইতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা অনুসারে, যাহারা এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাসহ সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে। নির্বাচন কমিশনাররা অন্তর্মুখী হইবেন না। যতদ্দূর সম্ভব, তাহাদের দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা বজায় রাখিবেন। সতত মনে রাখিবেন যে, জনগণের নিকটেই তাহাদের জবাবদিহিতা। তাহারা সকলে জনগণের সেবক মাত্র। তাহারা কী কাজ করিতেছেন তাহাও জনগণের জানিবার অধিকার রহিয়াছে, তাহারা কী কাজ করিতে পারিতেছেন না এবং কেন পারিতেছেন না, তাহাও জানিবার অধিকার জনগণের রহিয়াছে। নির্বাচনী আইন বা বিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনগত পদক্ষেপ ত্বরিত লইতে হইবে। এ ব্যাপারে কোনোরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন চলিবে না। শৈথিল্য প্রদর্শন করিলে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে আইন অমান্যকারী হইবেন। আমার মন্তব্য: নির্বাচন কমিশনের সাথে সরকার এবং সরকারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কতটুকু সহযোগিতা করেছেন বা করেননি, সেটা জনগণ উপলব্ধি করতে পারছেন। নির্বাচন কমিশন কেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেনাবাহিনী তলব করেননি, এর উত্তর নির্বাচন কমিশনকেই দিতে হবে। খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনই দায়ী। যদি নির্বাচন কমিশন মনে করে যে, তারা দায়ী নয়, তাহলে তার স্পষ্ট করে বলতে হবে, কাদের অসহযোগিতা বা কাদের অদক্ষতা এ জন্য দায়ী?
তিন. এ বি এম খায়রুল হক রায়ের অনুচ্ছেদ-১১৭৯: শুধু তাহাই নহে, সংবাদ মাধ্যম ও আপামর জনসাধারণ তাহাদের অধিকার সম্বন্ধে শুধু ওয়াকিবহাল নয়, সোচ্চার হইতে হইবে। তাহা হইলেই শুধু নির্বাচন কমিশন ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হইবে এবং তাহারা সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকিবেন। আমার মন্তব্য: সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন; এটাকে যদি সরকার দমন করতে চায়, তাহলে সরকার সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হওয়া উচিত।
বিচারপতি সিনহার রায় থেকে
এসকে সিনহা প্রদত্ত রায়ের অনুচ্ছেদ ১৯২-এর ভাবার্থ: এক. খায়রুল হকের নেতৃত্বে যে রায় দেয়া হয়েছিল সেই রায়ে, আশা করা হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে শক্তিশালী করবে যে, ওই নির্বাচন কমিশন ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার তথা স্বাধীন ও উন্মুক্ত বা পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে। সেই রায়ে আশা করা হয়েছিল যে, সরকারের হস্তক্ষেপ ব্যতীতই নির্বাচন কমিশনে শূন্য পদগুলো পূরণ করা হবে। এস কে সিনহার নেতৃত্বে প্রদত্ত রায়ে মন্তব্য হচ্ছে, ২০১১ বা ২০১২ সালের পরবর্তী বাংলাদেশের কোনো সরকারই ওপরে ব্যক্ত প্রত্যাশাগুলো পূরণের লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এই রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে বিরোধী দলও এই বিষয়টি পার্লামেন্টে বা অন্য কোনো ফোরামে উপস্থাপন করেনি। আরো মন্তব্য, বিরোধী দল কর্তৃক এইরূপ নিষ্ক্রিয়তা বা নিশ্চুপ থাকার ফল হলো, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। আমার মন্তব্য: খুলনা সিটি করপোরেশনের বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, দেশবাসীর সামনে পুনরায় প্রমাণিত হলো, নির্বাচন কমিশন এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, এখনো ক্ষমতাসীন সরকারের দয়া-মায়া বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
দুই. এস কে সিনহার রায়ের ১৯৩ অনুচ্ছেদের প্রথম অর্ধেকের ভাবার্থ: জাতীয় সংসদের নির্বাচন যদি স্বাধীনভাবে, পক্ষপাতহীনভাবে এবং কোনো হস্তক্ষেপ ব্যতীত অনুষ্ঠান করা না যায় বা করা না হয়, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যতীত, গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা বা গঠন করা সম্ভব নয়। ফলে আমাদের দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং পার্লামেন্ট এখনো শৈশবেই রয়ে গেল। জনগণ এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা স্থাপন করতে পারছেন না। যদি এ দুইটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিকী করণের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও সম্মান অর্জন করা না হয় তাহলে কোনো বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়। স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যতীত, জ্ঞানী বা মেধাবী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না এবং এ কারণে পার্লামেন্টের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। আমার মন্তব্য: ২০১৮ সালের শেষাংশে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু এটা কতটুকু অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে, সেটা এখনো অনিশ্চিত। সেই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু আমরা দেখছি যে, তার পক্ষ থেকে এমন কোনো আশাব্যঞ্জক প্রচেষ্টা নেই। এ অবস্থায় আগামীতে যদি পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সেটি যে অগ্রহণযোগ্য হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অগ্রহণযোগ্য বা বিতর্কিত কিংবা গোলযোগপূর্ণ হলে, এর জন্য বর্তমান নির্বাচন কমিশনই দায়ী থাকবে।
অতএব, নির্বাচন কমিশন যদি এ দায় এড়াতে চায় একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে চায় তবে তাকে আগ্রহী হতে হবে, সাহসী হতে হবে এবং ক্ষমতাসীন সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করার জন্য দৃঢ় মনেবলের অধিকারী হবে। আমি বলতে চাচ্ছি, নির্বাচন কমিশনকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আগামীতে তারা কিরূপ ভূমিকা রাখতে চায়। নির্বাচন কমিশনের ওপর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের তথা তাদের প্রতিনিধিত্বশীল অংশের আস্থা ক্ষয়িষ্ণু। এই নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠনের জন্য দাবি ইতোমধ্যেই মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের নজরে এসেছে।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন