স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রচারকাজে সংসদ সদস্যরা অংশ নিতে পারবেন কি না এ বিষয়ে বাকবিতন্ডা, আলোচনা, সমালোচনা বেশ কিছুদিন থেকে অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে এতদিন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন সময় সরকারি দল সংসদ সদস্যদের প্রচারণার সুযোগ দাবি করলেও কোন কমিশন এতদিন তা গাহ্য করেনি। কে. এম. নুরুল হুদা কমিশন সরকারের দাবি অনুসারে এ বিষয়টি বিবেচনায় নিতে চলেছে। বিরোধীদলের দাবির প্রতি উদাসীন হলেও সরকারি দলের দাবি পূরণে যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিচ্ছে বর্তমান ইসি। ১২ এপ্রিল এইচ. টি ইমামের নেতৃত্বে সরকারি দলের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সিটি কপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারণার সুযোগ দাবি করে। আর যায় কোথায়! শুরু হয় দৌড় ঝাঁপ। বিভিন্ন কর্নার থেকে আপত্তি, আহŸান, অনুরোধ থাকলেও কমিশনের সেসব বিবেচনায় নেবার ইচ্ছা ও আগ্রহ কোনটিই পরিলক্ষিত হয়নি। জাতীয় দৈনিকগুলোতে সংসদ সদস্যদের সুযোগদানের বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করে প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ হতে থাকে। সংসদ সদস্যদের সুযোগ দিলে তা হবে মারাত্মক একপক্ষীয় সুবিধাবাদের শামিল। এটি আইনের শাসনের পরিপন্থী ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। জাতীয় হোক বা স্থানীয় হোক, সকল নির্বাচনে কমিশনকে সৎ ও নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। সরকার জোর করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান করায় বর্তমানে স্থানীয় নির্বাচনেও রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ প্রতীক ব্যবহার করছে। স্থানীয় সরকার নির্বিাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের সময়ও সংসদ সদস্যদের প্রচার প্রচারণায় অংশ নেবার সুযোগ ছিল না। আর একটি ভাববার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যকোন রাজনৈতিক দল থেকে কোন দাবিও করা হয়নি। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে ও জনদাবি ছাড়া সরকারি দলের সুবিধার্থে যেভাবে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনী বিধি প্রণীত হয়েছে, ঠিক তেমনি অশুভ উদ্দেশ্য সংসদ সদস্যদের স্থানীয় নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ চাওয়া ও দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এত উদার ও ত্বরিৎকর্মা নির্বাচন কমিশন বিরোধীদলের দাবি দাওয়ার ব্যাপারে এত উদাসীন ও অনুদার কেন? বিরোধী দল, বিএনপির শত অনুরোধেও খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সেনা নিয়োগ না দেয়ায়, সরকারিদল ব্যাপক কারচুপি, জালিয়াতি, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পেরেছে। রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটিতে সরকারি দল যাতে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারে, সে লক্ষ্যে বিধি সংশোধন করে সরকারি দলকে এগিয়ে রাখা হলো। ১২ এপ্রিল আবেদন ও ২৫ মে ইসির সভায় সিদ্ধান্ত দেড় মাসেরও কম সময়ে। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ভাবতেও অবাক লাগে। ইসি ভালো করেই জানে, বিএনপি নামক বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির কোন সংসদ সদস্য নাই। বিধি সংশোধনে স্পষ্টত লাভবান হবে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ। জেনে শুনে এরূপ একপেশে ও পক্ষাপাতমূলক আচরণ অযৌক্তিক ও অনৈতিক। এতবড় অযৌক্তিক ও অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে নির্বাচন কমিশনারদের বিবেকের বিচার-বিবেচনায় বাধা আসেনি ভেবে অবাক হতে হয়। ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাসক ও বিচারক হচ্ছে তার বিবেক। বিবেক শাসিত হয়ে কর্ম করলে আলোচনা সমালোচনা, কটাক্ষ, বিদ্রæপ কোনকিছু হজম করতে হয় না। অবশ্য কমিশনার মাহবুব তালুকদার বৈঠকে লিখিত নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে দিয়েছেন। তার ভিন্নমত দেবার সিদ্ধান্তটি সর্বসম্মত হয়নি। তবে, তত্ত¡াবধায়ক পদ্ধতি বাতিলের রায়টি ৩-২ বিভক্তি ভোটে পাস হয়েছিল। পাস হওয়ায় আজ পর্যন্ত নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে ধস নেমেছে, ও সরকারি দলের অব্যাহত গতিতে বিজয় লাভকে ত্বরান্বিত করেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নাই। একটি রায়ের ফলে আজ অবধি শত শত লোকের আহত, নিহত, পঙ্গুত্ববরণ, গুম, খুন, গ্রেফতার চলছে। তত্ত¡াবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করায় রাজনৈতিক অঙ্গন অশান্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলন চরম আকার ধারণ করলে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও অমানবিক উপায়ে তা দমন করা হয়। তবে সরকারকে সমালোচনা ঠিকই হজম করতে হয়েছে। সংসদ সদস্যদের স্থানীয় নির্বাচন প্রচারণায় অংশ নিতে পারার সিদ্ধান্তে মানুষ খুশি হতে পারেনি। নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে ও হবে। কমিশন ও সরকারের বিষয়টিতে সেকেন্ড চিন্তা দেয়া উচিত।
বিষয়টি গুরুত্বহীন নয়। এতে ভারসাম্যহীন অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। এমনিতেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে, তার ওপর এ আইন পাস হলে বিরোধীদলের কোন জায়গা স্থানীয় সরকারে থাকবে না। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। সংসদ সদস্য পদটি লাভজনক কিনা, এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সব পক্ষের সঙ্গে বহু আলোচনার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রচারে সংসদ সদস্যরা অংশ নিতে পারবেন না। তারা শুধু ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন। এর কারণ হলো, সংসদ সদস্য যখন এলাকায় যান, তখন নানা ধরনের প্রভাব তৈরি হয়। বৈশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ, প্রশাসন তাদের কথা শোনে। কারণ আমাদের এখানে স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য সবকিছুর শীর্ষে থাকেন। ফলে সবকিছু নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।’ সাখাওয়াত সাহেব আরও বলেছেন এতে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন ও সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার যে ধারণা, সেদিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। এ প্রসঙ্গে আরো তিনজন বিশিষ্টজনের মতামত তুলে ধরা হলো। প্রফেসর এমাজ উদ্দীন, যিনি বিএনপি সমর্থক হলেও তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নাই। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, যিনি ইতোমধ্যে তার নিরপেক্ষতার জন্য দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আর একজন ড. শাহদীন মালিক, যার নিপেক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন না। তিনজনই রাজনীতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। প্রফেসর এমাজ উদ্দীন আহম্মদ বলেন, ‘প্রভাব তো অবশ্যই পড়বে। এমনিতেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তার উপর এমপিরা প্রচারণায় অংশ নিলে নির্বাচনের বারোাটা বাজবে, গণতন্ত্রের বারোটা বাজবে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন কেন এ সময়ে এ ধরনের একটি বিধি তৈরি করল তা তিনি বুঝতে পারছেন না। এ সিদ্ধান্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। ড. শাহদীন মালিক বলেন, এমপিরা অংশ নিলে প্রভাবতো পড়তেই পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ বিধি সংশোধনকে দূরভিসন্ধিমূলক বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন। এটি যে অশুভ উদ্দেশ্যে সরকারি দলকে সুবিধা দিতে করা হয়েছে একথা পাগলেও বোঝে। নির্বাচন কমিশন হবে সততা, নিরপেক্ষতা ও আদর্শিক একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এক পক্ষের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে অংশীদের সাথে আলোচনা ছাড়া কিছুতেই কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বা নেয়া উচিত নয়। দু’ একজন অবশ্য সংসদ সদস্যদের প্রচারে অংশগ্রহণ করা অন্যায় মনে করছেন না। তাদের কথা হলো, যখন তারা প্রচারে যাবেন সেসময় প্রটোকল নেবেন না, সরকারি গাড়ি ব্যবহার করবেন না। সিকিউরিটির জন্য মিনিমাম নিরাপত্তা নিয়ে প্রচারণা চালাতে পারবেন। এসব খোঁড়া যুক্তি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ব্যাপার। প্রটোকল না নিলে কী হবে? তিনি যে একজন সংসদ সদস্য, এটি তো তার জন্য সবচেয়ে বড় প্রটোকল। অনির্বাচিত হলেও বর্তমান সংসদ সদস্যদের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা না থাকায় তারা স্থানীয় পর্যায়ে শীর্ষে অবস্থান করে সবকিছুর ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছেন। একজন সংসদ সদস্যের কাছে ডিসি, এসপি, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসন কাতারবন্দি। তিনি এলাকার লর্ড। তার কথার বাইরে যাবার ক্ষমতা ও ইচ্ছা কোন কর্মকর্তার আছে বলে মনে হয় না। জাতীয় নির্বাচনের আগে এরূপ সিদ্ধান্ত সাংঘাতিক ক্ষতির কারণ হবে। আওয়ামী লীগের মতো একটি পুরাতন দলের স্থানীয় নির্বাচনী প্রচারণায় সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণ করতে হবে কেন? এ দলে শত শত বড় বড় নেতা রয়েছেন। এতো নেতা থাকতে সংসদ সদস্যকে প্রচারে সুযোগ দেবার অর্থ হীন উদ্দেশ্যপ্রসূত। এমনিতেই নির্বাচনী ব্যবস্থা পর্যুদস্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশনের বিভক্ত সিদ্ধান্তটি এখনও আইনে পরিণত হয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন দরকার। আমরা আশা করব, আইন মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দিয়ে ফেরত পাঠাবে। এই আইন পাস হলে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বারোটা বাজবে, কথাটি বাস্তবে সত্যে পরিণত হবে। এমনিতেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকাÐ দেখে জনগণ একে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ভাবতে পারছেন না। সরকারকে খুশি করার প্রবণতা নির্বাচন কমিশনারদের মোহগ্রস্থ করে রেখেছে। একদলীয় অনির্বাচিত, সংসদ সদস্যদের আপাতত প্রচারণা থেকে বিরত রাখাই ভালো। ভালো বা মন্দ যেমন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হোক, কমিশনকেই দায় নিতে হবে। অতএব সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়নকে এজেন্ডা না করে নিজেদের বিবেক তাড়িত ও শাসিত হবার অনুরোধ করছি। তাহলেই মানুষ খুশি হবে।
লেখক: প্রফেসর (অব.) দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন