মোস্তফা ওয়াদুদ
বিশ্ব স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টি করলেন প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) কে। জান্নাত-জাহান্নাম, লৌহ মাহফুজ, আরশে আজীম, জীন-ফেরেশতা, গাছপালা-তরুলতা, পশু-পাখি ইত্যাদি সৃষ্টি করলেন মহান রাব্বুল আলামিন। আদি পিতা আদম (আ.)কে সৃষ্টির পর আল্লাহ তাকে জান্নাতে থাকতে বললেন। হযরত আদম (আ.) দীর্ঘকাল পর্যন্ত জান্নাতে একাকী-নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করতে লাগলেন। কিন্তু নিজের জীবনে এক প্রকার শূন্যতা ও একাকিত্বতা অনুভব করছিলেন। কারো সাথে মেশার কিংবা কথা বলার কোন সঙ্গী-সাথী পেলেন না। সারাদিন-সারারাত জান্নাতে অবস্থান করতেন। কিন্তু সময় কাটানোর কোন সঙ্গী খুঁজে পেলেন না হযরত আদম (আ.)। তিনি যখন আনন্দ উল্লাস আর সুখ-শান্তির জায়গায় সঙ্গীহীন এক নিদারুণ শূন্যতায় ভোগছিলেন। সারাক্ষণ কোন একজন সঙ্গীর তালাশে জান্নাতের চারপাশ খোঁজে খোঁজে দেখছেন। বিষয়টি মোটেও আল্লাহর অজানা ছিল না। বরং এ বিশ্ব পরিম-লের সবকিছু আল্লাহর জ্ঞানে সর্বদা বিদ্যমান ছিল, আছে, থাকবে। চিরকাল। আদম (আ.)-এর যখন এ অবস্থা তখন আল্লাহ তায়ালা হজরত হাওয়া (আ.)কে সৃষ্টি করলেন। সেই থেকে পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আ.) আর পৃথিবীর প্রথম মানবী হজরত হাওয়া (আ.)। হজরত হাওয়া (আ.) আমাদের আদি মাতা। কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষের আগমন ঘটবে সবার মা। হজরত হাওয়া (আ.)-এর নামটি আরবী না অনারবী এ নিয়ে মুহাদ্দিস ওলামায়ে কেরামের মাঝে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) বলেন, এটি ‘সুরইয়ানী’ শব্দ। আরবী নয়। তবে আল্লামা জাওহারী ও জাওয়ালিকী (রহ.) বলেন, এটি ‘আরবি’ শব্দ। (কাসাসুল কোরআন, পৃষ্ঠা-২৫, খ--১ম)
হজরত আদম (আ.)-এর নাম কেনো ‘আদম’ রাখা হলো এ ব্যাপারে আল্লামা ইমাম সা’লাবী (রহ.) বলেন, যেহেতু তাকে মাটি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে আর হিব্রু ভাষায় মাটিকে বলা হয় ‘আদাম’। তাই তার নাম হলো আদম। কতিপয় ওলামায়ে কেরাম-এর সাথে একমত হয়ে বলেন, আদম (আ.)-এর দেহাবয়বের ‘খামীর’ পানি ও মাটির সংমিশ্রণে তৈরি। তাই তার নাম হলো আদম। ঠিক এভাবে হজরত হাওয়া (আ.) এর নাম ‘হাওয়া’ হলো এজন্য যে তিনি সকল জীবনধারী মানুষের মাতা। অর্থাৎ আরবী শব্দ ’হাইয়ুন ‘যার অর্থ জীবন। আর এর আরবী রূপে মুবালাগাহ বা আধিক্য ব্যাঞ্জকরূপ হিসেবে ‘হাওয়া’ রাখা হয়েছে। (কাসাসুল কোরআন, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-২৬) তবে আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর নাম এবং অর্থের মাঝে সামঞ্জস্য থাকা অতি সুক্ষ্মদর্শী বিষয়। কিন্তু কোরআনে কারীমে আল্লাহ তায়ালা প্রথম মানবকে ‘আদম’ নামেই সম্বোধন করেছেন। ইরশাদ করছেন, ‘হে আদম!’ (সূরা বাকারা) আর তাফসীরে অনুসন্ধানি দৃষ্টিদানকারীদের কাছে আদম সঙ্গীনির নাম ‘হাওয়া’ ব্যতীত অন্য কিছু চোখে পড়েনি। তাই ইতিহাসে প্রথম এই মানবী ‘হাওয়া’ নামেই প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। হযরত হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টি হয়েছে কিভাবে এ ব্যাপারে কোরআনে পাকে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। বরং সূরা নাবাতে শুধু এটুকু বলা হয়েছে, ‘আর সেই নফস (আদম) হতে তার জোড়াকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা নাবা) উপরোক্ত আয়াতে হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টির ব্যাপারে দুটি সম্ভাবনা রয়েছে। যথা- ক.) হয়তো হাওয়া (আ.) কে আদম (আ.)-এর পাঁজরের হাড় হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। খ.) অথবা আল্লাহ তায়ালা মানব বংশকে এভাবেই সৃষ্টি করেন। পুরুষের সঙ্গীনি হিসেবে আল্লাহ তায়ালা অপর একটি মাখলুক সৃষ্টি করেছেন যাকে ‘নারী’ বা ‘মা’ জাত বলা হয়। তাফসীরে ও হাদীসেপাকের বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় উপরোক্ত প্রথম মতটিই সঠিক। কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা নারীদের সাথে কোমল আচরণ করো। কারণ নারী পাঁজরের হাড় হতে সৃষ্ট।’ (বুখারী, মুসলিম) তাছাড়া তাফসীরে কুরতুবীতে আছে, আল্লাহ তায়ালা হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টি আদমের বাম পাঁজর থেকেই করেছেন। (তাফসীরে কুরতুবী) হযরত হাওয়া (আ.)-এর গায়ের রঙ ছিল দারুণ সুন্দর। শরীরের গঠন ছিল আকর্ষণীয়। চেহারার সৌন্দর্য ছিল মায়াবী। রূপলাবণ্যে ছিলেন শ্রেষ্ঠ রমণী। যেনো জান্নাতি কোনো হুর। আদম (আ.)-এর মনোবাসনা পূর্ণ করে আল্লাহ তায়ালা হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করলে হাওয়ার প্রতি আদমের মানবিক ভালবাসার সৃষ্টি হয়। আদমের কাছে হাওয়া কে ভালো লাগতে থাকে। পরে আল্লাহ তায়ালা তার কুদরতির বিশেষ প্রক্রিয়ায় উভয়কে ভালবাসার (বিয়ের) বন্ধনে আবদ্ধ হতে আদেশ করলেন-‘হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাকো এবং যেখান হতে ইচ্ছা খাও। তবে তোমরা এই বৃক্ষের নিকটে যাবে না। যদি যাও তবে জুলুমকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সূরা আ’রাফ-আয়াত : ১৯) সূরা বাকারার ৩৫নং আয়াতে একই ধরনের আদেশ ও সতর্কবাণী দেয়া হয়েছে। হযরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) পরম আনন্দে ও সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন। আল্লাহর আদেশ মতো যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াচেছন। যা ইচ্ছা পানাহার করছেন। তাদের কোনো দুঃখ নেই। বেদনা নেই। শান্তি আর শান্তি। চির শান্তি জান্নাতে তারা দারুণ আরাম-আয়েশে জীবনাতিপাত করতে লাগলেন। তাদের শান্তিতে অন্যান্য মাখলুকেরাও শান্তিতে ছিল। কারো মনে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। কিন্তু একমাত্র শয়তান যে আদমের সুখ দেখে জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছিল। সহ্য হচ্ছিল না আদমের আরাম-আয়েশ। কারণ আল্লাহ তায়ালা আদম সৃষ্টির পর ফেরেশতাদের বললেন, ‘তোমরা আদমকে সেজদা করো।’( সূরা বাকারা) তখন সবাই সেজদা করলেও করলো না পাপিষ্ঠ ইবলিস। সে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে যায় ও শয়তান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তারপর থেকে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে আদমের জন্য আমার এ করুণ পরিণতি। আমি তার শেষ দেখে নিবো। তাই সে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বরং আদমের সুখ দেখে শয়তান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। এরপর থেকে সে আদম হাওয়াকে জান্নাত থেকে বের করার বিভিন্ন ফন্দি আঁটতে লাগলো। আদম (আ.)কে সে তার ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে ফাঁসানোর অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের রূপ ধরে এসে তাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি ষড়যন্ত্রে পা দিতে রাজি নয়। আদমের ব্যাপারে শয়তানের ষড়যন্ত্র ব্যর্থমতায় পর্যবসিত হয়। তখন সে মা হাওয়া (আ.) এর পিছু নেয়। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন