সীমিত কৃষিজমি ও সীমিত সম্পদ নিয়ে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পুরণ করা আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছিল। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের বাস্তবতা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিরা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে। ধান ও মাছ উৎপাদনে স্বয়ম্বর হওয়ার পরও গরুর গোশতের চাহিদা পুরণে আমরা দীর্ঘদিন ভারতীয় গরুর উপর নির্ভরশীল ছিলাম। ভারতে বিজেপি সরকারের গোরক্ষা কর্মসূচির সুত্র ধরে বাংলাদেশে ভারতীয় গরু রফতানী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দেশীয় চাহিদা পুরনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য দেশের কৃষক ও গোখামারীরা সরকারের দিকে চেয়ে থাকেনি। তারা স্বউদ্যোগে নতুন নতুন গো-খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে অল্পদিনের মধ্যেই গুরুর গোশতে দেশকে স্বর্নিভর করে তোলার বিশাল চ্যালেঞ্জে এক সাফল্যজনক অধ্যায় সূচিত করেছে। মাত্র ৯ বছরে দেশে গরুর গোশতের উৎপাদন বেড়েছে ৭ গুণ। প্রতিবছরই গবাদিপশুর খামার এবং গোশত উৎপাদনের হার বেড়ে চলেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে গরুর গোশতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানীর সুযোগ সৃষ্টির প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ধান,আলু ও ভুট্টার মত শস্য উৎপাদনে কৃষকদের ধারাবাহিক লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম দেশের খাদ্য চাহিদা পুরণে মূল ভ‚মিকা রেখেছে। সেই সাথে আমিষের মূল উৎস হিসেবে মাছ, গোশত, পোল্ট্রি ও দুগ্ধ উৎপাদনেও সমান্তরাল ভাবেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের সংগ্রামী কৃষক ও খামারীরা। ভারত বাংলাদেশে গরু রফতানী বন্ধের ঘোষণা দিয়ে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পর গোশতের মূল্যবৃদ্ধি এবং চাহিদা পুরণের বিকল্প পন্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছুটা চিন্তিত হলেও গরু-ছাগল উৎপাদনে বাড়তি উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এ সংকট উত্তরণে বেশী সময় লাগেনি। ২০১৫ সাল থেকে ঈদুল আজহায় পশুর সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলার মধ্য দিয়ে দেশের পশু-খামারিরা যে আশা জাগিয়ে তুলেছিল তা আমাদের খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক বড় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্বল্প সময়ে ঈদের বাজারে লাখ লাখ গরু ছাগলের ঘাটতি পুরণে আমাদের কৃষক ও খামারীদের এই সাফল্যের ধারা অন্যান্য সেক্টরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষত গরু-ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দুগ্ধ উৎপাদনেও স্বর্নিভরতার পথে এগিয়ে চলেছে দেশ। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রির্পোটে জানা যায়, ২০০৮-৯ অর্থবছরে দেশে গোশত উৎপাদিত হয়েছিল ১ দশমিক ০৮ মিলিয়ন মেট্টিক টন। মাত্র ৮ বছর পরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গোশতের উৎপাদন দাঁড়ায় ৭ দশমিক ১৫ মিলিয়ন টন। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের গড়ে দৈনিক ১২০ গ্রাম হিসাবে গত অর্থবছরে ৭১ লাখ ৩৫ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত হয়েছিল ৭১ লাখ ৫৪ হাজার টন, যা’ গড় সাধারণ চাহিদার তুলনায় ১৯ হাজার মেট্টিক টন বেশী। উল্লেখ্য গত তিন বছর ধরে গোশতে চাহিদা পুরণে ভারত থেকে গরু আমদানীর কোন প্রয়োজন হয়নি।
উন্নয়নশীল ও মধ্য আয়ের বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ধান, মৎস্য, পোল্ট্রি এবং প্রাণীসম্পদ উন্নয়নে সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দেশে বাম্পার ফলনের পরও ভারত থেকে চাল আমদানীর সুযোগ অবারিত রেখে দেশের ধানচাষিদের যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে একইভাবে গোশতে স্বনির্ভরতার সাফল্য যে ভারত থেকে আবারো গরু আমদানীর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করা না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। গরুর গোশতের দাম কমানোর অজুহাত তুলে কোন পক্ষ যাতে আবারো ভারতীয় গরু আমদানীর আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের পথে না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। গরুর গোশত এবং দুগ্ধে বিদেশ নির্ভরতা থেকে স্বনির্ভরতা অর্জনের কৃতিত্বকে স্থায়ী, টেকসই ও সুপরিকল্পিত লক্ষ্যে এগিয়ে নেয়ার কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। আর মাত্র দেড়মাস পরেই ঈদুল আযহা। গত তিন বছরের ধারাবাহিকতায় আগামী কোরবানীর ঈদেও স্থানীয় কৃষক ও খামারীরা কোরবানীর জন্য প্রয়োজনীয় পশুর চাহিদা পুরণে সক্ষম হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সীমান্ত পথে গরু চোরাচালানীর কারণে যেন দেশীয় খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। একটি গরুও যেন ভারত থেকে না আসতে পারে, সেটা বিজিবিকে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে গরু রফতানী বন্ধে ভারতের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হয়েছে। বাম্পার ধান উৎপাদনের পরও চাল আমদানীর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মত দেশে পর্যাপ্ত গবাদি পশু উৎপাদনের পরও ভারত থেকে গরু আমদানী হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশীয় খামারীরা। গরু-ছাগল, পোল্ট্রি ও দুগ্ধ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা ধরে রাখার পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে পশু ও পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন ও আমদানীতে সরকারী সুযোগ সুবিধা বা প্রণোদনা থাকা আবশ্যক। উদ্বৃত্ত গোশত বিদেশে রফতানীর পাশাপাশি চামড়া ও দুগ্ধজাত শিল্পে দেশে এক নতুন সম্ভাবনা ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এ সম্ভাবনা ও সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন