শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিমানের লোকসান হজযাত্রীদের ঘাড়ে

হোসাইন আহমদ হেলাল : | প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০১৮, ১২:৩৬ এএম

হজযাত্রীদের ওপর বাড়তি বিমান ভাড়া চাপিয়ে বাংলাদেশ বিমানের লুটপাট ও শত শত কোটি টাকার লোকসান মেটানো হচ্ছে। প্রতিবছরই বাড়ানো হচ্ছে হজযাত্রীদের বিমানভাড়া। সংশ্লিষ্টদের এ ধরনের খামখেয়ালিপনা হজযাত্রীদের সঙ্গে শুধু প্রতারণাই নয়, এক ধরনের জুলুমও বটে। অনেকের মতে, হজযাত্রায় বাংলাদেশ বিমান ও সাউদিয়াসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে এক প্রকার জিম্মি পবিত্র হজ গমনেচ্ছুরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দু’টি এয়ারলাইন্স থেকে সরে এসে জেদ্দাগামী অন্যান্য এয়ারলাইন্সেও হজযাত্রী পরিবহনের সুযোগ দেয়া উচিৎ। তাহলেও তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও অত্যাচার থেকে মুক্তি মিলবে। তবে হজযাত্রী পরিবহনে আগামী বছর থেকেই ওপেন টেন্ডারের ব্যবস্থা চালু হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সউদী অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স বা সাউদিয়া সাধারণ যাত্রী প্রতি ঢাকা-জেদ্দা রুটে ভাড়া নেয় ৪৮ হাজার টাকা। এ বছর ওমরাহ উপলক্ষে বাংলাদেশ বিমান ঢাকা-জেদ্দা রুটে যাওয়া-আসার ভাড়া নেয় ৫২ হাজার টাকা। অন্যদিকে ওয়ার্কসহ অন্যান্য ভিসায় সউদী আরব গমনাগমনকারীদের টিকেটের মূল্য মাত্র ৩৬ হাজার টাকা থেকে ৩৯ হাজার টাকা। অথচ সেই ভাড়া হজের সময় ১ লাখ ২৮ হাজার ৬৫০ টাকা। যা অন্যান্য খরচসহ ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৯১ টাকা। হাজীদের জন্য এই ভাড়া অন্যান্য সময়ের ভাড়ার প্রায় তিনগুণ।
এক হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিমান ২০১১-১২ অর্থ বছরে ৬৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গত ছয় বছরে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ বিমানের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সারা বছর যে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করে, যা লোকসান হিসেবে দেখানো হয়, তা পোষাতে হজ মৌসুমকে টার্গেট করা হয়। বিমান সংশ্লিষ্টদের দাবি, হজের সময় বিমানের ফ্লাইট হজযাত্রী নিয়ে জেদ্দায় যায়। কিন্তু ফিরে আসতে হয় খালি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে হজযাত্রীদের জন্য এ বছর আরো একধাপ ভাড়া বাড়ায় (১ লাখ ২৮ হাজার ৬৫০ টাকা) বাংলাদেশ বিমান। অথচ হজযাত্রীদের পরিবহন করা বিমানের পাশের সিটেই বসা থাকা সাধারণ যাত্রীর ভাড়া ৩৬ হাজার থেকে ৩৯ হাজার টাকা। অনেকের মতে, এটা বড় ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম ও জুলুম। প্রায় তিনগুণ ভাড়া আদায়কে অনৈতিক খামখেয়ালিপনা ছাড়া কিছুই বলা যায় না। জ্বালানী তেলের দাম ইতঃপূর্বে বেশি ছিল। মাঝে কমেছে। কিন্তু ভাড়া তখনো কিন্তু কমানো-বাড়ানো হয়নি। হজ মৌসুম ছাড়া বছরের অন্য সময় ৬০ শতাংশের বেশি যাত্রী পায় না বাংলাদেশ বিমান। কিন্তু হজের সময় একবার শতভাগ সিট পূর্ণ করে যায়। ফেরার সময়ও কমপক্ষে ২০ শতাংশ যাত্রী পায়। সেই হিসাবে আসা-যাওয়ার গড় ৬০ শতাংশই দাঁড়ায়। হজযাত্রীদের জন্য ভারতে বিমান ভাড়া কমানো হচ্ছে। গত ২৬ ফেব্রæয়ারী মন্ত্রিসভায় পবিত্র হজ পালনের খরচ নির্ধারণ করে ‘হজ প্যাকেজ ২০১৮’ এর খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। সে অনুযায়ী আগামী ১৪ জুলাই বাংলাদেশ থেকে প্রথম হজ ফ্লাইট শুরু হবে। সউদী আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাত্র ৭ হাজার ১৯৮ জন। বাকিরা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়।
প্যাকেজ-১ অনুযায়ী, এবার খরচ হবে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯২৯ টাকা এবং প্যাকেজ-২ এর আওতায় ৩ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৯ টাকা। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়ও হজের খরচ ৩ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৯ টাকার কম হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিমান সরকারের লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সুতরাং হজকে কেন্দ্র করে ভাড়া না বাড়িয়ে বিমানের দুর্নীতি বন্ধ আগে প্রয়োজন। বিমানকে শুদ্ধাচারের আওতায় আনতে সরকার নানা চেষ্টা করেও সুফল পাচ্ছে না।
সূত্রমতে, গত বছরের চেয়েও চলতি বছর হজযাত্রী প্রতি বাড়তি বিমানভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৪ হাজার টাকা। সে হিসাবে এবার হাজীদের থেকে ১৫২ কোটি ৬৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। সাধারণ যাত্রীদের তুলনায় এ বাড়তি ভাড়ার পরিমাণ সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকারও বেশি। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বিমান অর্ধেক সংখ্যক হজযাত্রী বহন করবে। ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী বছরে ৭শ’ কোটি টাকা বেশি দিচ্ছেন। যা বাংলাদেশ বিমান ও সাউদিয়া ভাগাভাগি করছে। হিসাব অনুযায়ী বিমান বাংলাদেশ পাচ্ছে সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা। গত বছরও হজ প্যাকেজে বাড়তি বিমান ভাড়া নিলেও অতিরিক্ত কোন সুবিধা মেলেনি হাজীদের জন্য।
২০০৮ সালে বিমান ভাড়া ছিল ৯৮ হাজার ৯৭০ টাকা, ২০০৯ সালে বিমান ভাড়া ছিল ৯২ হাজার ২৭০ টাকা, ২০১০ সালে ছিল ৯৬ হাজার ৯২৫ টাকা, ২০১১ সালে ১ লাখ ১০ হাজার ৯৫০ টাকা, ২০১২ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬২০ টাকা, ২০১৩ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার ২৮ টাকা, ২০১৪ সালে ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৪ টাকা, ২০১৫ সালে ১ লাখ ২০ হাজার ৭৫৮ টাকা, ২০১৬ সালে ১ লাখ ২১ হাজার ২৩১ টাকা এবং ২০১৭ সালে বিমান ভাড়া ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬১ টাকা। আর ২০১৮ সালে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হজার ৬৫০ টাকা।
বর্তমানে ১৫টি আন্তর্জাতিক রুটে এবং ৭টি অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করছে বিমান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর লোকসানি রুট, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাসহ নানা কারণে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটিতে টানা লোকসান শুরু হয়। ২০০৯-১০ অর্থ বছর ৮০ কোটি, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯১ কোটি, ২০১১-১২ অর্থ বছরে ৬০০ কোটি ও ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ২১৪ কোটি টাকা লোকসান দেয় বিমান। এ ছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে বিমানের লোকসান হয় ৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর পেছনে লুটপাট, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও স্বজনপ্রীতিই কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিভিন্ন সময় চলা তদন্তের রিপোর্টে। ২০১০ সালে ৯৬ হাজার টাকা বিমান ভাড়া বেড়ে বর্তমানে ১ লাখ ২৮ হাজার ৬৫০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ ৭ বছরে বেড়েছে ৩২ হাজার টাকা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গত বুধবার হজ এজেন্সীজ অব বাংলাদেশ (হাব) সভাপতি আবদুস সোবাহান হাসান জানান, সরকার হাজীদের জন্য বিমানের ভাড়াসহ সব কিছু নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সিগুলোকে তাদের যাত্রী প্রতি ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হচ্ছে। যাতে যাত্রীদের সাথে এজেন্সীগুলো কোন ধরনের প্রতারণা করতে না পারে। তবে সাধারণ যাত্রীদের চেয়ে হজ যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি বিমান ভাড়া নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক আন্দোলন করেছি। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছি। তবে আশার কথা হচ্ছে, আগামী বছর ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে হজ যাত্রীদের বহনের ব্যবস্থা করা হবে। আশা করছি এর মাধ্যমে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়টির সুরাহা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন