থাই নেভি সিল সদস্য, এলিট ব্রিটিশ ডাইভারসহ সহস্রাধিক স্বেচ্ছাসেবকের নির্ঘুম ও শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে থাইল্যান্ডের থ্যাম লুয়াং গুহা থেকে স্থানীয় ফুটবল দল উইল্ড বোরের ১২ সদস্য ও তাদের কোচকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তিনদিনের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের শেষদিন গতকাল মঙ্গলবার কোচসহ অন্য চার কিশোরকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে থাই নেভি সিল। তবে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া ৩ নেভি সিল সদস্য এবং একজন চিকিৎসক শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গুহায় অবস্থান করছিলেন।
সর্বশেষ কোচকে বের করে আনার খবরে উল্লাস প্রকাশ করে একে অপরকে আলিঙ্গন করেন অভিযানে অংশ নেয়া সদস্যরা। উদ্ধারকারী দলের সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে থাকে টুইটার, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অভিনন্দনের জোয়ার। যোগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তিনি থাই নেভি সিল সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছেন, ‘থাইল্যান্ডের গুপ্ত গুহা থেকে ১২ জন কিশোর এবং তাদের কোচকে সফল উদ্ধারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে থাই নেভি সিল সদস্যদের জন্য অভিনন্দন। সেটি এক সুন্দর মুহূর্ত - সব মুক্ত, মহান কাজ’!
প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করেছেন এলন মাস্ক। তিনি অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছেন, ‘নিরাপদে তাদেরকে বের করে আনাটা ভাল খবর। অসাধারণ উদ্ধারকারী দলের প্রতি অভিনন্দন’। এ খবরকে স্বাগত জানিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের মুখপাত্র। স্টিভেন সেবার্ট টুইট করেছেন: ‘প্রশংসার যোগ্য অনেক কিছু: সাহসী কিশোর এবং তাদের প্রশিক্ষকের অধ্যবসায় এবং তাদের উদ্ধারকারী দলের দৃঢ়সংকল্প ও ক্ষমতা’। ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এই সাহসী শিশুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ওল্ড ট্রাফোডে। দলের ওয়েবসাইটে দেয়া বার্তায় ক্লাবটি লিখেছে, ‘ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড জানতে পেরেছে যে, থাইল্যান্ডের একটি গুহায় আটকা পড়া ১২ ফুটবলার ও তাদের কোচ এখন নিরাপদ। আমাদের চিন্তা এবং প্রার্থনা রয়েছে তাদের সঙ্গে। আসন্ন মৌসুমে ওয়াইল্ড বোয়ার্স ফুটবল ক্লাব এবং তাদের উদ্ধারকারীদের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে স্বাগত জানাতে পারলে আমরা সম্মানিত হব’।
অভিনন্দন জানিয়েছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী সেরিং তোবগে। এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘১৩ জনের উদ্ধারকে উদযাপন করছে ভুটান। অভিনন্দন থাইল্যান্ড’।
উদ্ধার অভিযানের দায়িত্বে থাকা থাই নেভি সিল বলছে, গুহায় আটকা সকলকে উদ্ধার করা হয়েছে। অসাধারণ এবং কষ্টদায়ক এই অভিযান শেষ হওয়ায় সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছে নেভি সিল।
ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে থাই নেভি সিল বলছে, ‘১২ উইল্ড বোর ও তাদের কোচ এখন গুহার বাইরে। সবাই নিরাপদ।’
গত রোববার প্রথম বারের মতো ১২ কিশোর ও তাদের কোচকে উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়। সে দিনই উদ্ধার হয় চার জন। গত সোমবার দ্বিতীয় দিনে বের করে আনা সম্ভব হয় আরো ৪ জনকে। দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ গুহায় প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গতকাল শেষ দিনে বাকি পাঁচ জনকে বের করে আনেন উদ্ধারকারীরা। এর ফলে এক দুঃসাহসিক অভিযানে সবাইকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
দেশটির উত্তরাঞ্চলের চিয়াং রাই প্রদেশের গুহায় আটকা ১২ কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচকে উদ্ধারে ১৩ বিদেশি ডুবুরি ও থাইল্যান্ডের নৌবাহিনীর অভিজাত শাখা থাই নেভি সিলের পাঁচ সদস্য কাজ করেছেন। এছাড়া গুহার ভেতরে ও প্রবেশ পথে আরো অন্তত ৯০ জন ডুবুরি উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত ছিলেন। গত ২৩ জুন থেকে গুহায় আটকা ১২ কিশোর ও তাদের কোচ আটকা ছিলেন। গত ২ জুলাই সোমবার ব্রিটিশ ডুবুরীদের একটি দল তাদের ক্ষুধার্ত ও আটকেপড়া অবস্থায় গুহার গভীরে আবিষ্কার করে। এর পর সেখানে তাদের জন্য খাবার, পানি, ফয়েলে আবৃত কম্বল ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে থাকেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা।
গুহায় আটকা কিশোরদের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছর। দীর্ঘ প্রায় ৪ কিলোমিটার সংকীর্ণ ও উঁচু-নিচু পানিমগ্ন পথ পাড়ি দিয়ে কিশোরদের উদ্ধারে রোববার অভিযান শুরু হয়। প্রথম দিকে থাই কর্তৃপক্ষ জানায়, গুহায় বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় ও বর্ষা মৌসুমে বর্ষণের কারণে তাদের এখনই উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের উদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু রোববার নাটকীয়ভাবে বন্যার পানি কিছুটা কমে যাওয়ায় এবং বর্ষণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ন্যারংস্যাক ওসোত্তানাকর্ন জানান, কিশোরদের উদ্ধারে এখনই উপযুক্ত সময়।
অবিশ্বাস্য সাহসী এবং শক্ত এই থাই শিশুরা
থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়া ১২ জন কিশোরকে বের করে আনার কাজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেসব বিদেশি বিশেষজ্ঞ ডুবুরিরা অংশ নিচ্ছেন, তাদের একজন ইভান কারাজিচ। ডেনমার্কের এই বিশেষজ্ঞ ডুবুরি থাইল্যান্ডেরই কো-তাও নামে ছোটে একটি দ্বীপে একটি গুহার ভেতরে ডাইভিং বা ডুব সাঁতার দেওয়ার একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালান। চিয়াং রাইয়ের পাহাড়ের গুহায় কিশোর ফুটবল দলটির আটকে পড়ার খবর প্রচার হওয়ার পর অন্য নানা দেশের অনেক স্বেচ্ছাসেবী ডুবুরির মতো তিনিও ছুটে গিয়ে যোগ দেন উদ্ধারকারী দলে।
বিবিসির সঙ্গে তার গত কদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কারাজিচ আটকে পড়া থাই শিশু-কিশোরদের, যাদের অধিকাংশ সাঁতারই জানতো না, সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এই বাচ্চাগুলোকে এমন কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা আগে কখনো এই বয়সের কোনো শিশুই হয়তো করেনি...১১ বছর বয়সে কেভ ডাইভিং (গুহার ভেতরে ডুব সাঁতার) চিন্তারও বাইরে।
কারাজিচ বলেন, সরু গুহায় ভারি অক্সিজেনের পাত্র পিঠে নিয়ে মাস্ক পরে ডুব সাঁতার দেওয়া যে কোনো বয়সের মানুষের জন্য বিপজ্জনক। যখন তখন বিপদ আসতে পারে, নিজের টর্চের আলো ছাড়া সবকিছু অন্ধকার।
কারাজিচ বলেন, উদ্ধারের পরিকল্পনার সময় তাদের সবচেয়ে ভয় ছিল বাচ্চাগুলো যদি মাঝপথে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, তখন কীভাবে তা সামাল দেয়া যাবে। কিন্তু যাদের বের করে নেওয়া হয়েছে তাদের তেমন কোনো বিপদের কথা উদ্ধারকারীদের কাছ থেকে শোনা যায়নি।
আমি বিশ্বাসই করতে পারি না যে এই বাচ্চাগুলো কতটা সাহসী এবং ঠান্ডা মাথার হতে পারে, ভাবতেই পারছি না... দু সপ্তাহ ধরে ঠান্ডা, অন্ধকার গুহার আটকে ছিল তারা, মাকে দেখেনি...।
ইভান কারাজিচের দায়িত্ব- গুহার মাঝামাঝি পথে অবস্থান নিয়ে অক্সিজেন-ভর্তি পাত্র পরীক্ষা করে বদলে দেয়া। রোববার প্রথম বাচ্চাটিকে তিনি যখন আসতে দেখেন, অনুভূতি কী ছিল তার? মনে মনে অনেক আশঙ্কা ছিল আমার। ৫০ মিটারের মতো দূরে প্রথম যখন একজন ডুবুরি এবং তার পেছনে বাচ্চাটি নজরে এলো, আমি তখনও নিশ্চিত ছিলাম না যে বাচ্চাটি বেঁচে আছে কিনা। যখন দেখলাম সে শ্বাস নিচ্ছে, বেঁচে আছে, দারুণ স্বস্তি পেয়েছিলাম।
নাস্তায় চকলেট চেয়েছে তারা
গতকাল মঙ্গলবার থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাও স্বস্তি প্রকাশ করছেন গত সোমবার পর্যন্ত বের করে আনা আটটি শিশুই ভালো আছে। স্বাস্থ্য সচিব জেটাসাদা চোকেদামরংসুক বলেছেন, তারা নিজেরাই সবকিছু করতে পারছে। একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সকালে কয়েকজন নাস্তার জন্য চকলেট-রুটি খেতে চেয়েছে। গত সোমবার কয়েকজন বাসিল পাতা এবং গোশত দিয়ে তৈরি ফ্রাইড রাইস খেতে চেয়েছে। বিবিসির এক সংবাদদাতা টুইট করেছেন, বলাই বাহুল্য, এই শিশুরা অসামান্য, অসাধারণ।
বিশ্বকাপের অতিথি
এই সাহসী কিশোর ফুটবল দলটিকে মস্কোতে বিশ্বকাপের ফাইনালে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ফিফা। কিন্তু থাই চিকিৎসকরা জানিয়েছে, নানা পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য কম করে হলেও এক সপ্তাহ তাদের হাসপাতালে থাকতে হবে। তার অর্থ রোববারের ফাইনাল হয়তো তাদের হাসপাতালে টিভিতে দেখতে হবে।
বিবিসির নিক বিক মজা করে ফিফাকে উদ্দেশ করে টুইট করেছেন, ২০২২ সালের বিশ্বকাপে যেন তাদের বিশেষ অতিথি করে নিয়ে যাওয়া হয়। ফিফার সাড়া অবশ্য এখনও মেলেনি। সূত্র : দি গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, বিবিসি বাংলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন