শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সোনায় হেরফের : বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক

| প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনার পরিমাণ ও মানের ভয়ংকর হেরফের হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পত্রিকান্তরে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জমা রাখা হয়েছিল ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের চাকতি ও সোনার আংটি, তা হয়ে গেছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট সোনা, হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। দ্বৈবচয়নভিত্তিতে নির্বাচন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি সোনা পরীক্ষা করে বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম ধরা পড়েছে। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, কোনো রকম অনিয়ম বা হেরফের হয়নি। ‘ছিল সোনার চাকতি হয়ে গেল অন্য ধাতু’, এ তথ্য সঠিক নয় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যিনি সোনার চাকতি ব্যাংকে জমা রেখেছিলেন, তিনি নিজে না এসে সেটা পরীক্ষা করে লিখিতভাবে প্রত্যায়নপত্র জমা দিয়েছেন যে, চাকতিটি যেভাবে জমা রাখা হয়েছিল সেভাবেই আছে। চাকতির বিষয়ে করণিক ভুল হয়েছে বলে জানিয়ে বলা হয়েছে, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের দেয়া সোনা জমা রাখার সময় সোনা ৪০ শতাংশ ছিল। কিন্তু ইংরেজি-বাংলার হেরফেরে সেটা ৮০ শতাংশ লিখে ভুলবশত নথিভুক্ত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত স্বর্ণকার এই ভুলটি করেছিলেন। ‘২২ ক্যারেট সোনা হয়ে গেল ১৮ ক্যারেট’, এমন তথ্যও সঠিক নয় দাবি করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত স্বর্ণকারের মাধ্যমে সোনার মান যাচাই করা হয় না। তারা কষ্টিপাথরে সোনার মান যাচাই করেন। অন্যদিকে শুল্ক গোয়েন্দারা সোনা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মেশিনের ব্যবহার করেছেন। বাইরে থেকে ভাড়া করা মেশিনের মাধ্যমে তারা সোনার মান যাচাই করেছে। তাই সোনার মানের হেরফের হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রতিবেদনে বর্ণিত অভিযোগের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া বক্তব্য কতটা সন্তোষজনক বা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের মতো করে একটা বক্তব্য বা ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র। তবে সে ব্যাখ্যা ও বক্তব্য নিঃশঙ্কচিত্তে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধানে ৮ সদস্যের কমিটি ওইসব অনিয়ম পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও উপস্থিতিতে ওই অনুসন্ধান চলেছে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে। তাদের কাছে এ বিষয়ে অসংগতি ধরা পড়লে আমাদের জানালে আমরাও কাজ করতে পারি। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের জব্দকৃত সোনা যে এই প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা হয়েছে, তা নয়। যুগ যুগ ধরে রাখা হচ্ছে। কিন্তু ইতোপূর্বে এ ধরনের অভিযোগের কথা শোনা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমর্যাদার ক্ষেত্রেও এটা বড় রকমের আঘাত বলেই মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের মতে, এ অভিযোগ অপ্রত্যাশিত ও অতিশয় বেদনাদায়ক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, করণিক ভুল আর পরিমাপের কথা হাস্যকর। এ ধরনের হাস্যকর বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা হচ্ছে। তার দাবি, কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ডাইরেক্টর জেনারেল আহসান এইচ মনসুরও অভিযোগের দ্রæত ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত দাবি করেছেন।
দেশের ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অবস্থা শোচনীয় বললেও কম বলা হয়। ব্যাংকিং খাত বড় রকমের আস্থাহীনতার শিকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও সম্প্রতি বলেছেন, ব্যাংকের কার্যক্রমে মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে, ব্যাংকগুলোর জন্য যা অশনিসংকেত। ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট এই দুর্ঘটের জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের অভাবই দায়ী বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন। বস্তুত ব্যাংকিং খাত অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থলোপাট ও অর্থপাচারের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সকল ব্যাংকের তত্ত¡াবধায়ক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধ করতে পারেনি। এতে শুধু ব্যাংকিং খাতের সর্বনাশই দ্রæতায়িত হয়নি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমর্যাদাও অবনত হয়েছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের অর্থ পাচার বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। অকল্পনীয় এই কাÐ ব্যাংকের ভাবমর্যাদায় প্রচÐ রকম ধাক্কা দিয়েছে। রিজার্ভের অর্থ পাচারের বিষয়ে এখনো কোনো কিনারা হয়নি। তবে এটা স্পষ্ট হয়েছে, ব্যাংকের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা একটি চক্রেরই কাজ এটি। বাংলাদেশ ব্যাংকেও যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায়িত্বশীলতা ও সুশাসনের অভাব রয়েছে, সেটা এতে স্পষ্ট হয়েছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভল্টে রাখা সোনার ব্যাপারে যে অভিযোগ উঠেছে তা ব্যাংকের ভাবমর্যাদাকে একেবারে তলানিতে নামিয়ে এনেছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। কদিন আগে দৈনিক ইনকিলাবে বিলাসবহুল গাড়ি উদ্ধার ও তাদের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গরমিল সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এখানে সততা ও ন্যায্যতার ব্যত্যয় ঘটেছে। বাস্তবতার এই প্রেক্ষাপটে আলোচ্য অভিযোগের একটি অনুপুংখ তদন্ত হতে হবে। বিচার বিভাগীয় তদন্তই এক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ। অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে এবং তার রিপোর্ট যত দ্রæত সম্ভব প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নির্ধারণ করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কোনোভাবেই দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অনাস্থার গহŸরে নিক্ষিপ্ত হতে দেয়া যাবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন