শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

চরম দুর্ভোগে নগরবাসী

অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি-টানা বৃষ্টি

সায়ীদ আবদুল মালিক : | প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম


ডিএসসিসি’র দায়িত্ব নয় : সাঈদ খোকন, অব্যবস্থাপনাই একমাত্র কারণ নয় : ওয়াসা


বৃষ্টি ও যানজটের দুর্ভোগে পড়েছে রাজধানীবাসী। অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি আর টানা বর্ষণে সড়কের অবস্থাও বেহাল। রাস্তায় নেমেই নগরবাসীকে পড়তে হচ্ছে যানজটের দুর্ভোগে। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় ছিল অসহনীয় যানজট। ১০ মিটিটের পথ যেতে সময় লাগেছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। গাড়ির চাকা যেন ঘুরতেই চায় না। এক মিনিট চলেতো ২০মিনিট থেমে থাকা। স্কুলে যাওয়া শিশুরা, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া ছাত্রছাত্রী, অফিস আদালতসহ নানা প্রয়োজনে মানুষ রাস্তায় নেমেই পড়েছে দুর্ভোগে। কোথায়ও যানজট আবার কোথায়ও যানবাহনের সঙ্কট।
রাজধানীতে গত কয়েকদিন ধরে কখনও হালকা কখনও ভারি বর্ষণ হচ্ছে। এতে নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোসহ পাড়া মহল্লার রাস্তায় পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে চরম ভোগান্তির। থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার কারণে কোন কোন এলাকায় কাদা আর পানি মিলে একাকার হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে বাড়তি ভোগান্তির। বৃষ্টির কারণে যানজট শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গাবতলী থেকে সায়েদাবাদ, পুরান ঢাকা থেকে উত্তরা সবখানেই ছিল একই চিত্র। বিশেষ করে বিকেলে অফিস থেকে ঘরে ফেরা মানুষ পড়েছিল চরম দূর্ভোগে।
গতকাল বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের কাছে রাজধানীর পানিবদ্ধতা ও যানজট নিরশন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যানজট ও পানিবদ্ধতা নিরসন আমার দায়িত্ব নয়। রাজধানীতে দুই ঘণ্টা বৃষ্টি হলে শহর তলিয়ে যায় এমন দৃশ্যপটের কথা উল্লেখ করে মেয়র বলেন, রাস্তা পানির নিচে চলে গেলে তার সমাধান নগরবাসী আমার কাছে চায়। কিন্তু এর সমাধান করবে ঢাকা ওয়াসা। নগরীর যানজট সমস্যা সমাধান আমার কাছে চায়। কিন্তু এটা তো আমার দায়িত্ব নয়। অন্য সংস্থার।
তিনি বলেন, আমরা সমন্বয় সভা করি। সেখানে অনেক সেবা সংস্থা উপস্থিত থাকে না। তাদের কারণে শহরের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারছি না। কারা কারা সমন্বয় সভায় উপস্থিত থাকে না। তাদের নাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বরাবর একটা চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ সময় ওই সকল প্রতিষ্ঠানের নাম সাংবাদিকরা জানতে চাইলে এড়িয়ে যান মেয়র।
দুই বছর আগে ডিএসসিসি এলাকার সমন্বয় সভার প্রধান করা হয়েছে মেয়র সাঈদ খোকনকে। গত এ দুই বছরেও কোনো সমাধানের পথে হাঁটতে পারেনি সমন্বয় কমিটি। এর দায়িত্ব কি কমিটির প্রধান হিসেবে মেয়র নিবেন? জানতে চাওয়া হলে মেয়র বলেন, আশা করি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটা সমাধান আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সালে সংস্থাটিকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করলেও ঢাকা ওয়াসা তার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এখন কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। ওয়াসার এই ব্যর্থতার দায় যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ওপরে। এ জন্য দুই সিটি কর্পোরেশন ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা তাদের অধীনে নিতে চায়।
এ বিষয়ে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা ড্রেনের দায়িত্ব নিতে চাই, তবে তা ঠিক করে দিতে হবে। জনবল দিতে হবে। আমরা এর রক্ষণাবেক্ষণ করবো। ওয়াসা থেকে জানানো হয়, শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণেই যে ঢাকায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর পিছনে আরও অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার প্রায় ৬৭টি খালের মধ্যে আমরা ২৬ খালের দেখাশুনা করি। বাকি খালগুলোর অবস্থা ব্যহাল। যে ২৬টি খাল দেখাশুনা ওয়াসা করে সেগুলোও অর্থনৈতিক ও লোকবলের অভবে নিয়মিত খনন ও পরিস্কার করা যাচ্ছে না। এছাড়াও দখলদারদের উৎপাত তো রয়েছেই। শুধু মাত্র ওয়াসার একক চেষ্টায় ঢাকা শহরের এ সমস্যার দুর করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নরগবাসীকেও সহযোগীতা করতে হবে।
টানা তৃতীয় দিনের মতো গতকালও রাজধানীতে বৃষ্টিপাত ছিল। লঘুচাপের কারনে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বর্ষার ঝুম বৃষ্টির দেখা পেয়েছে রাজধানীবাসী। আর একটানা বৃষ্টির কারণে দুর্ভোগও বেড়েছে জনজীবনে। আগামী সপ্তাহজুড়ে এমন বর্ষাময়তা থাকবে বলেও জানা গেছে আবহাওয়া অফিস থেকে।
আবহাওয়াবিদ নিঝুম রোকেয়া আহমেদ বলেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঢাকাসহ সারাদেশে যে টানা বর্ষণ হচ্ছে, তা আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে। মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশের সর্বত্র বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়ার এই রকম অবস্থা ২৯ জুলাই পর্যন্ত থাকবে। ত্রিশ তারিখ থেকে চার পাঁচ দিন আবহাওয়া ভালো থাকবে। এর পর আবার বৃষ্টিপাত হবে বলে তিনি জানান।
গতকাল বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকার গুলশান, বনানী, উত্তরাসহ মালিবাগ, খিলগাও, রাজারবাগ, শহজাহানপুর, আগারগাঁও, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি’র বেশকিছু এলাকা ও মহাসড়কে বৃষ্টির কারণে তৈরি হয়েছে পানিবদ্ধতা। অপরিকল্পিত নগরায়নে পানি জমার সমস্যাটা দিন দিন প্রকট হচ্ছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। এদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি আর ভারি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গতকাল বুধবার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালসহ বিভিন্ন অফিস আদালতে চাকরিজিবীরা ও নানা প্রয়োজনে মানুষ ঘর থেকে বের হয়েই বিপাকে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় পানিবদ্ধতার কারণে নগরবাসীর দুর্ভোগের যেন অন্ত ছিল না। পানিবদ্ধতার কারণে জুতা খুলে যাতায়াত করতে দেখা গেছে অনেককে। কোথাও কোথাও রাস্তায় জমে থাকা পানি বাসে উঠার সিড়ি পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। এতে বাসে উঠা-নামা করার সময় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের।
পানি জমে যাওয়ায় রাস্তায় খানাখন্দকে রিকশা ভ্যান পড়ে আহত হয়েছেন আনেকে। এলাকার অনেক অলিগলির ড্রেন উপচে পড়ে রাস্তাঘাট ঘর বাড়িতে পানি একাকার হয়ে গেছে। ফলে রাস্তায় জন-সাধারণের ভোগান্তি ছিল চোখে পড়ার মতো।
এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়নে পানি জমার সমস্যাটা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এছাড়া প্রতিবছর কার্পেটিং করায় অধিকাংশ সড়ক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উঁচু হচ্ছে। আর বসত এলাকা নিচু হচ্ছে। এছাড়া পানিবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসাবে রাজধানীর অপরিকল্পিত ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা দায়ী। আর পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে রাজধানীবাসীর দুর্দশা আরো বাড়বে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
নগরীর অধিকাংশ সড়কের পাশে সিটি কর্পোরেশনের ড্রেন ও ওয়াসার পানির সংযোগ লাইনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কাজ চলমান থাকায় খোঁড়া গর্তে পানি জমে সড়কের সঙ্গে সমান হয়ে গেছে। এসব গর্তে পড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন পথচারীরা। মেট্রোরেলের কাজের কারণে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে মিরপুরবাসীর। এমনিতেই রাস্তার অর্ধেক খোঁড়া, তারমধ্যে বৃষ্টি তাদের বেশ দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মালিবাগে কথা হয় মাসুম নামের এক শিক্ষার্থীর সাথে, তিনি বলেন, বৃষ্টিতে রাস্তায় বাস কম থাকায় বাসে উঠা যাচ্ছে না। আবার রাস্তার বেহাল দশার কারণে রিকশাও যেতে চাইছে না। ভাড়া চাচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। নোংরা পানি ও কাঁদার কারণে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর।
বাড্ডা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে রাস্তায় কাঁদা ও নোংরা পানিসহ নানা সমস্যার কথা জানিয়েছেন রাসেল নামের এক কর্মজাবী। তবে শুধু বাড্ডা-মিরপুর কিংবা মালিবাগ নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট নানা দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন অনেক পথচারী।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যেখানে সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি আর অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে নগরবাসীর দুর্ভোগ যেন বেড়েই চলছে। তবে এ দুর্ভোগ লাঘবে সংশিষ্টদের কোনো তৎপরতাও চোখে পড়ে না। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার কাজ হচ্ছে না। আবার কোন কোন এলাকায় পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নেই। যে কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই পানিতে ডুবে যায়। রাজধানীর ডিএনডি বাঁধসহ বহু এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানি জমে যায়। এতে বৃষ্টির পানি জমে থাকে দিনের পর দিন। হাঁটু পানিতেই চলাচল করতে হয় ওইসব এলাকার মানুষকে। পুরান ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা সবচেয়ে অপ্রতুল। হালকা বৃষ্টি হলেই ড্রেন ভরে রাস্তায় জমে যায় পানি। দুর্গন্ধযুক্ত ও পচা পানিতেই চলতে হয়ে পুরান ঢাকাবাসীকে। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলি আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি বের হয়ে আশেপাশের খাল, বিল, নদী ও নিচু জমিতে গিয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে এই স্থানগুলো এমনিতেই পানিতে টইটুম্বুর থাকে। যে কারণে বিশেষ করে বর্ষার সময় রাজধানীর পানি স্বাভাবিকভাবে ঐ স্থানগুলোতে যেতে পারে না। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে সে পানি হাই পাওয়ারের সেচ মেশিনের মাধ্যমে নিষ্কাশন করতে হয়। ঢাকা শহর থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য যে পরিমাণ সেচ মেশিন দরকার তা আমাদের নেই। যে কারণে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করতে যে সময় লাগে সে সময় পর্যন্ত রাজধানীবাসীকে পানিবদ্ধতার দুর্ভোগ সহ্য করতে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Habibul Ahasan ২৬ জুলাই, ২০১৮, ৪:০৫ এএম says : 0
কোথাও কোন জনদুর্ভোগ সৃস্টি হয় নি! সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিভাবে শহর গুলোর সাথে সমুদ্র সৈকতের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটানো সম্ভব!
Total Reply(0)
Nayem ২৬ জুলাই, ২০১৮, ৪:০৬ এএম says : 0
নৌকা শুধু নদী আর খাল বিলের জন্যই না.... রাস্তা ঘাটে চলাচলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করেছে সরকার..... নৌকাকে জাতীয় বাহনে ঘোষনা করা হউক
Total Reply(0)
Mohammad Ayub ২৬ জুলাই, ২০১৮, ৪:০৯ এএম says : 0
জলাবদ্ধতা নিরসনে জনগন এবং সরকার উভয়কেই এক হয়ে কাজ করতে হবে।
Total Reply(0)
Tajul Islam Taj ২৬ জুলাই, ২০১৮, ৪:১০ এএম says : 0
উন্নয়নের জোয়ার এসেছে।
Total Reply(0)
Ab Jalil ২৬ জুলাই, ২০১৮, ৪:১০ এএম says : 0
ডিজিটাল দেশ ! ডিজিটাল ড্রেনেজ, ডিজিটাল রাস্তা !
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন