বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সারাদেশের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছে। গত বৃহস্পতিবার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলেও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে সুশৃঙ্খলভাবে তাদের দাবী-দাওয়া আদায়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। আন্দোলনের বিশেষ দিক হচ্ছে, কোনো রূপ উছৃংখলা-বিশৃংখলা ছাড়াই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তারা সড়কে মটরসাইকেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করেছে। পাশাপাশি সড়কের কোন পাশ দিয়ে কোন ধরনের যানবাহন চলাচল করবে, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থা শিক্ষার্থীরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এতে সড়কে সাধারণ যানবাহন কমে গেলেও যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়লেও তাদের মধ্যে কোনো ধরনের বিরক্তি বা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। বরং শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে তারা স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছে। ফলে এ আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা সাধারণ মানুষের আন্দোলনেও পরিণত হয়েছে। দেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায়ও স্থান পেয়েছে। তারা বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরছে।
বেপরোয়া গাড়ি চালকদের কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বহু বছর ধরেই নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কোনোভাবেই এই বেপরোয়া গাড়িচালক ও ভুয়া লাইসেন্সধারীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এর কারণ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে বরাবরই এই চালকদের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাইতে দেখা গেছে। এমনকি তিনি, এক সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের হাত নেই বলে দায় এড়িয়ে গেছেন। বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর হাসতে হাসতে তিনি, ভারতে এক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, সেখানে এ নিয়ে তো কোনো কথা হচ্ছে না। মন্ত্রীর এ বক্তব্যে, সচেতন মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা মন্তব্য করেছেন, মন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য অপ্রত্যাশিত এবং অগ্রহণযোগ্য। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার পদত্যাগের দাবী উঠেছে। তিনি পদত্যাগ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়ে বলেছেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। যুক্তি হিসেবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগ চাননি বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, পদত্যাগের দাবী বিএনপির। অথচ আমার দেখেছি, প্রায় এক দশক আগে ভারতে যখন ট্রেন দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়, তখন সে সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। কয়েক বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফেরি ডুবিতে প্রায় তিনশ’ যাত্রীর মৃত্যু হওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। এটাই সভ্যতা এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয়। আমাদের দেশে প্রতিদিন বেপরোয়া চালকদের কারণে সড়কে মৃত্যুর মিছিল চললেও কোনো পদত্যাগ করা দূরে থাক, আহত-নিহতদের প্রতি সামান্য সহানুভূতি প্রকাশ করতে দেখা যায় না। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, দেশে সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই। সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক না কেন, সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন খাতকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনতে চরম ব্যর্থ, প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু এবং শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল আন্দোলন তা বুঝিয়ে দিয়েছে। অথচ পুরো পরিবহন খাত ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও এমপিদের কবজায়। তারা কোনো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে না। ফলে বেপরোয়া চালকরা কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছামতো যেমন খুশি তেমনভাবে সড়কে যানবাহন চালিয়ে যাচ্ছে এবং মানুষ হত্যা করছে। ঘাতক চালক জানে, দুর্ঘটনায় মানুষ আহত-নিহত হলে তাকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন। এই প্রভাবশালী রাজনীতিকরা পরিবহনের মালিক কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে থকায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ফিটনেসবিহীন, রংচটা, অনুমোদনহীন পরিবহনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ক্ষমতার ছায়ায় থাকা চালকরাও হয়ে ওঠে বেপরোয়া। এর ফলে প্রতিদিনই সড়কে অকাতরে সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, তাতে সরকার ও তার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের টনক কতটা নড়েছে তা এখনও পরিস্কার নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের সাত দফা দাবি নিয়ে সরকার কাজ করছে। তাদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে। আমরা দেখেছি, অতীতেও সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিরোধ আন্দোলনে এ ধরনের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে তা চাপা পড়ে গেছে।
শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের মাধ্যমে কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত হয়েছে। প্রথমত, সড়কে যান চলাচলে কোনো নিয়ম-নীতি নেই। তারা নিজেরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে সড়কে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা যায়। দ্বিতীয়ত, অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়ে থাকেন। এটি দেশের জন্য লজ্জার বিষয়। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন সাধারণ মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সড়ক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এখন সরকারের দায়িত্ব যুগের পর যুগ ধরে চলা এই অব্যবস্থাপনা দূর করণে দ্রæত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একটি দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা এভাবে চলতে দেয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের চলমান এ আন্দোলনে যাতে কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে বা কোনো ধরনের রাজনীতিকরণের দিকে ধাবিত না হয়, এ দিকে কঠোর দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করার প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জনকল্যাণের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি করা উচিত হবে না। বরং বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রæত সমাধানের পথে যেতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেতে পথচারি থেকে শুরু করে যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। তাদের সচেতন করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়কের নিয়ম-কানুন সম্পর্কিত বিধি-বিধান ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্য বইয়ে সংযুক্ত করা উচিত, যাতে শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীরা সচেতন হতে পারে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। তারা ধৈর্য্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। এজন্য তাদেরকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন